Site icon The Bangladesh Chronicle

ফুটবলার আমিনুল কি ভয়ঙ্কর অপরাধী?

আমিনুল জামিনবঞ্চিত হচ্ছেন রাজনৈতিকভাবে পীড়াদায়ক একটি সময়ে
আমিনুল জামিনবঞ্চিত হচ্ছেন রাজনৈতিকভাবে পীড়াদায়ক একটি সময়েফাইল ছবি

আমি ফুটবল-ভক্ত মানুষ। ফুটবলের সোনালি দিনে মাঠে গিয়ে খেলা দেখতাম। এখনো ফুটবলের জগতের বড় কোনো খবর থাকলে পড়ে দেখি। তবে কিছুদিন আগে হঠাৎ যা দেখলাম, তা কোনো দিন না জানলে ভালো হতো। ফেসবুকে দেখি, হ্যান্ডকাফ পরা ফুটবলার আমিনুলের ছবি। ২৮ অক্টোবর ঘটনায় নাশকতার দায়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, আদালত তাঁকে রিমান্ডে দিয়েছেন আট দিনের জন্য। এরপর তাঁকে আবারও তিন দিন রিমান্ডে নেওয়া হয়।

কোন আমিনুল তিনি? বাংলাদেশের ফুটবলে সর্বোচ্চ সাফল্য পাওয়া দলের নায়ক তিনি। ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো (এবং এখন পর্যন্ত শেষবারের মতো) সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। ফাইনাল খেলায় টাইব্রেকারে দুটি শট ঠেকিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন আমিনুল। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়ক হয়েছিলেন, এরপর এবং যত দূর মনে করতে পারি, তাঁর নৈপুণ্যের কারণে বিদেশের কিছু ক্লাবেও খেলার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন।

এখন সেই আমিনুলকে আদালতে আনা হয় হ্যান্ডকাফ পরিয়ে, পুলিশের কাছে রিমান্ডে দেওয়া হয় বারবার। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ—২৮ অক্টোবর তিনি পুলিশকে আক্রমণ, ধ্বংসযজ্ঞ, নাশকতার মতো ভয়ংকর অপরাধ করেছেন বিএনপির একজন নেতা হিসেবে। আমিনুল কি এসব অপরাধ করতে পারেন? হয়তো পারেন। আবার তিনি কি অপরাধ না করেও রাজনৈতিক কারণে মামলার শিকার হতে পারেন? এটিও অবশ্যই হতে পারে। ২৮ অক্টোবর ঘটনার আগে-পরে মামলার নামে যা হচ্ছে, তা বিবেচনায় নিলে দ্বিতীয়টি হওয়ার আশঙ্কা কোনোভাবে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।

কিন্তু তবু আমিনুলের পরিণতি নিয়ে আমাদের অধিকাংশ মূলধারার পত্রিকার কোনো অনুসন্ধান, এমনকি কৌতূহল পর্যন্ত নেই। ফুটবলার হিসেবে দেশের জন্য বিরল সম্মান বয়ে আনা মানুষটির গ্রেপ্তারে কিছু গণমাধ্যম বরং শিরোনাম করেছে ‘বিএনপি নেতা আমিনুল গ্রেপ্তার’। একটি পত্রিকা লিখেছে ‘নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে অন্য অনেক নেতার মতো এই মুহূর্তে তাঁরও স্থান কারাগারে।’

আমিনুলের বিরুদ্ধে পুলিশ এসব অভিযোগ এনেছে সত্যি, কিন্তু তিনি নাশকতায় ‘জড়িয়েছেন’ এটি কি আমরা কেউ বলতে পারি? কোনোভাবেই পারি না। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টির ভ্রান্তিগুলো ব্যাখ্যা করি। কখনো বিএনপির শাসনামলে রাজনৈতিক দমন-পীড়নের সময়ে মাশরাফির মতো কেউ গ্রেপ্তার হলে তিনি নাশকতায় জড়িত—কোনো পত্রিকা কি এটি বলবে? বা বিষয়টি কি অধিকাংশ গণমাধ্যম এড়িয়ে যাবে? আমার ধারণা, তারা এ রকম করবে না। আমিনুলের ক্ষেত্রেও তা-ই হওয়া বাঞ্ছনীয়।

আমিনুলের খেলোয়াড়ি জীবন ছিল নিষ্কলুষ। অন্য কারও মতো জুয়া বা বাজি খেলার অভিযোগ, জোচ্চুরি, অপরাধী চক্রের সঙ্গে সম্পর্ক দূরের কথা, খেলোয়াড়ি জীবনে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ পর্যন্ত কখনো ছিল না তাঁর বিরুদ্ধে। বাংলাদেশকে বিরল সম্মান এনে দেওয়া এই ক্রীড়াবিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সারবত্তা নিয়ে তাই অন্তত ক্রীড়াবিদ ও সাংবাদিকদের প্রশ্ন তোলা উচিত ছিল।

২.

আমার মনে পড়ে, আমার প্রিয় দল আবাহনীর (এবং বাংলাদেশের) চার তুখোড় ফুটবলার সালাউদ্দিন, চুন্নু, আনোয়ার ও হেলাল—এরশাদের সামরিক শাসনামলে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। মোহামেডানের বিরুদ্ধে খেলায় একটি গোলের দাবিতে এই খেলোয়াড়েরা রেফারিকে উত্তেজিতভাবে ঘিরে ফেললে ওই উত্তেজনা মাঠে ছড়িয়ে পড়ে। বহু দর্শক মাঠে ঢুকে পড়েন, অনেকে আহত হন। এ ঘটনার দায় আবাহনীর চার ফুটবলারের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার পর সারা বাংলাদেশ প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল। প্রতিদিন পত্রিকার প্রথম পাতায় তাঁদের সংবাদ প্রকাশিত হতো, ফুটবলার, ক্রীড়া সাংবাদিকসহ বহু মানুষ ও গোষ্ঠী এই প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন। সামরিক আদালতে কারাদণ্ড পাওয়ার পরও তাঁদের কিছুদিন পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।

নিশ্চয়ই কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, এই চার ফুটবলার তো আমিনুলের মতো দলের রাজনীতিতে অংশ নেননি, তাঁদের সঙ্গে আমিনুলের ঘটনা কেন তুলনীয় হবে? এই প্রশ্ন অবান্তর হবে এই বিবেচনায় যে রাজনীতি করা যেকোনো নাগরিকের মতো একজন ক্রীড়াবিদেরও সাংবিধানিক অধিকার, মাশরাফি বা সাকিব তো বটেই; বাংলাদেশের অনেক ফুটবলারও অবসরের পর (যেমন টুটুল, চুন্নু, গাফফার, আরিফ হোসেন জয়) দলীয় রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট হয়েছেন। আমিনুলের ক্ষেত্রেও এটি অপরাধ বলে বিবেচিত হতে পারে না।

আমিনুলের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় বরং হতে পারে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে। আমরা তখন বিশ্বাস করেছিলাম দর্শকদের মধ্যে মারামারির ঘটনার দায় আবাহনীর চার ফুটবলারের হতে পারে না। আমরা কি এখনো প্রশ্ন তুলতে পারি না আমিনুলের বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলা বা নাশকতার অভিযোগগুলো বিশ্বাসযোগ্য কি না?

৩.

আমিনুল গ্রেপ্তার হয়েছেন, জামিনবঞ্চিত হচ্ছেন এমন একটি সময়ে যখন বিরোধী দলের রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে অসংখ্য গায়েবি মামলা হচ্ছে, নির্বিচার শত শত ব্যক্তিকে আসামি করা হচ্ছে, আরও শত শত অজ্ঞাতনামা আসামি উল্লেখ করে তাঁদের যে কাউকে মামলায় জড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের না পেলে তাঁদের পরিবারের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, মুখোশ পরে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা, এমনকি হত্যা করা হচ্ছে। এসব বিরোধী দলের নেতা–কর্মীদের মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। নির্বাচন ও রাজনীতির মাঠ থেকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে এভাবে বিতাড়িত করার নজির বাংলাদেশে আগে কখনো দেখা যায়নি।

এসব ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে এমন অভিযোগ তোলার অবকাশ রয়েছে যে সরকার ইচ্ছেমতো নির্বাচন করার জন্য সর্বাত্মক দমননীতি প্রয়োগ করছে এবং এটি করার হাতিয়ার হিসেবে পুলিশের পাশাপাশি গোটা ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করছে। এই দমননীতি এতই বাছবিচারহীন হয়ে পড়ছে যে এ জন্য মামলার শিকার হচ্ছেন বা দণ্ড পাচ্ছেন, ইতিমধ্যে মৃত, গুমের শিকার ব্যক্তি, প্রবাসী এবং শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধীরাও।

এই প্রেক্ষাপট মনে থাকলে আমরা কীভাবে আমিনুলের কারাবাসে নির্লিপ্ত থাকতে পারি? একই ধরনের নাশকতার মামলায় বিএনপির নেতাকে জামিন পেতে এবং মুক্তিলাভ করা মাত্র আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার কথা আমরা জানি। কিন্তু নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সমঝোতা ছাড়াই শুধু বিচারিক বিবেচনায় আমিনুল বা বিএনপির হাজারো অন্তরীণ নেতা-কর্মী কি জামিন পেতে পারেন না? তাঁদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো বানোয়াট হলে তাঁরা কি এ জন্য আরও কোনো প্রতিকার আশা করতে পারেন না?

৪.

এ দেশে এখন বয়োবৃদ্ধ রাজনীতিকের বিরুদ্ধে ময়লার গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগ ওঠে, আন্তর্জাতিকভাবে প্রসিদ্ধ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মাছ চুরির মামলা হয়, সিনিয়র সম্পাদকের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনা হয়। সমাজে এর কিছু না কিছু প্রতিবাদ হয়, এসব নিয়ে আলোচনা হয়, উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। আমিনুলের ক্ষেত্রেও তা হওয়া উচিত। নির্বাচনের সময় দেখে মামলা, গ্রেপ্তার আর বিচারিক প্রক্রিয়ায় সরকারের হস্তক্ষেপ নিয়ে আমাদের প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকা ঠিক হবে না।

প্রশ্ন—ভিন্নমত আর উদ্বেগ সমাজ থেকে উঠে গেলে শুধু নির্বাচনব্যবস্থা নয়, গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা ক্ষমতাসীন দলের ক্রীড়নকে পরিণত হয়। দেশে তখন মানবাধিকার আর আইনের শাসন বলে কিছু থাকে না।

আজ বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। এই দিনে অন্তত এসব বিষয় নিয়ে আমাদের গভীর আত্মানুসন্ধানের তাগিদ থাকা উচিত। আমরা কি এটি জানি না?

● আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক

প্রথম আলো

Exit mobile version