Site icon The Bangladesh Chronicle

ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতি আরো বেড়েছে

দেশের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট বা আর্থিক হিসাবের ঘাটতি আরো বড় হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাস (জুলাই-নভেম্বর) শেষে এ ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৩৯ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। তীব্র ডলার সংকট সত্ত্বেও গত অর্থবছরের একই সময়ে আর্থিক হিসাবে ১২৬ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। দেশের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যসংক্রান্ত (ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা বিওপি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

আর্থিক হিসাবে ঘাটতি বাড়ায় থামছে না বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ ঘাটতি ক্রমাগত সম্প্রসারণ হওয়ার অর্থ হলো দেশে যে পরিমাণ ডলার ঢুকছে, তার চেয়ে বেশি বেরিয়ে যাচ্ছে। দেশের ইতিহাসে আর্থিক হিসাবে এত বড় ঘাটতি এর আগে কখনই দেখা যায়নি। ডলার সংকট তীব্র হয়ে ওঠার পেছনে এ ঘাটতির প্রভাবই সবচেয়ে বেশি।

দেশে বিদেশী বিনিয়োগ আসছে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি মিলছে না রফতানি ও প্রবাসী আয়ে। পুঁজিবাজারসহ অন্যান্য খাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে বিদেশী বিনিয়োগ। বিদেশী ঋণপ্রবাহও কমে গেছে। নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডলার সংকট। কমেছে বিদেশী দান-অনুদানও। মোটা দাগে এসব কারণকেই আর্থিক হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন অর্থনীতিবিদরা। একই কথা বলছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকসংশ্লিষ্টরাও।

কোনো দেশে আন্তর্জাতিক সম্পদের মালিকানা হ্রাস-বৃদ্ধির বিষয়টি পরিমাপ করা হয় ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট বা আর্থিক হিসাবের মাধ্যমে। এ হিসাবে ঘাটতি তৈরি হলে দেশের রিজার্ভ ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর চাপ বাড়ে। চলতি শতকের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ সময়ই উদ্বৃত্তে ছিল বাংলাদেশের আর্থিক হিসাব। বিশেষ করে ২০১০ সাল-পরবর্তী এক যুগে কখনই আর্থিক হিসাবে ঘাটতি দেখা যায়নি। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরেও দেশের আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬৬৯ কোটি ১০ লাখ ডলার। কিন্তু ডলার সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) প্রথম এ ঘাটতি দেখা দেয়। গত অর্থবছর শেষে আর্থিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২০৭ কোটি ৮৪ লাখ ডলারে।

এরপর চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ১৬০ শতাংশ। এ ঘাটতির ঊর্ধ্বগতিকে জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌আমাদের ইতিহাসে এমন উল্লম্ফনের গতি আর কখনো দেখা যায়নি। এর অর্থ হলো দুটি ঘটনা পাল্লা দিয়ে ঘটছে। প্রথমত, দেশ থেকে প্রচুর অর্থ বেরিয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের ঋণ বাড়ছে। আমরা গত কয়েক বছরে চারটি জায়গায় বড় উল্লম্ফন দেখেছি। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি হঠাৎ করে বেড়ে গেল। তারপর দেখলাম রফতানি নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার তথ্যে ব্যবধান বেড়ে গেল, যার দায়িত্ব কেউ নিতে চায় না। ঋণের পরিমাণ বাড়ল। এটা কোথায়-কীভাবে বাড়ল এবং কে এর সুবিধাভোগী, তা কেউ জানে না। এ তথ্য আমাদের জানা জরুরি। বিষয়টি নিয়ে বারবার বলা সত্ত্বেও অতি প্রয়োজনীয় ফরেনসিক অডিট কখনো করা হয়নি। এরপর এখন দেখা যাচ্ছে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি সম্প্রসারণ হচ্ছে অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে। এগুলো কেন, কী জন্য, কীভাবে এবং কার জন্য বাড়ল এ তথ্য আমাদের জানা প্রয়োজন।’

এ অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, ‘‌অতীতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে কখনই এ ধরনের তথ্য জানানো হয়নি। ফলে তথ্যের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ কারণেই এখন এসব ঘটতে দেখছি আমরা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জ্বালানিসহ অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বকেয়া বেড়ে যাওয়া। সব মিলিয়ে গোটা বিষয়টি এখন আমাদের জন্য মারাত্মক রূপ নিয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা না নিলে সার্বিক লেনদেন ভারসাম্যের ওপর নিম্নমুখী চাপ আরো ঘনীভূত হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি হুমকিতে পড়বে সামষ্টিক অর্থনীতি।’

দেশে ডলার সংকট কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরের মাঝামাঝি সময় থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়। ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির কঠোর পদক্ষেপের কারণে গত অর্থবছরে আমদানি ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ কমে যায়। আমদানি নিয়ন্ত্রণের এ ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) আমদানি কমেছে ২০ দশমিক ৯৪ শতাংশ। রেকর্ড পরিমাণ আমদানি কমিয়ে আনার পরও দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ প্রত্যাশা অনুযায়ী কমাতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। স্থবিরতা চলছে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুই উৎস রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ১৯ শতাংশ। একই সময়ে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র দশমিক ১৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২১ শতাংশ আমদানি কমে যাওয়ার পরও চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ৪৭৬ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ১৮২ কোটি ডলার। বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমে আসার প্রভাবে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স বা চলতি হিসাবের ভারসাম্য ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। চলতি বছরের পাঁচ মাস শেষে চলতি হিসাবে ৫৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত রয়েছে। চলতি হিসাব উদ্বৃত্তের ধারায় ফিরলেও ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের বড় ঘাটতি দেশের বিওপির ঘাটতিকে বড় করছে। নভেম্বর শেষে বিওপির ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৮৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌নানা কারণে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতি কমানো সম্ভব হয়নি। সুদের হার অনেক বাড়িয়ে দেয়ায় বিদেশী বিনিয়োগ এখন যুক্তরাষ্ট্রমুখী। আন্তর্জাতিক বাজারে সুদহার না কমলে বাংলাদেশে বিদেশী ঋণের প্রবাহ বাড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এ কারণে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতি কমানো যাচ্ছে না। তবে আশা করছি, জাতীয় নির্বাচনের পর এ পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। এরই মধ্যে রিজার্ভ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমদানি কমে আসায় চলতি হিসাব উদ্বৃত্তের ধারায় ফিরেছে। বিওপির ঘাটতিও কমে এসেছে।’

আর্থিক হিসাবের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই), পোর্টফোলিও বিনিয়োগ, অন্যান্য বিনিয়োগ এবং রিজার্ভ অ্যাসেট বিবেচনা করা হয়ে থাকে। অন্যান্য বিনিয়োগের মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক সহায়তা, সরকারের মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, ঋণের কিস্তি পরিশোধ, বাণিজ্যিক দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ, ট্রেড ক্রেডিট বা রফতানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থ এবং অন্যান্য সম্পদ ও দায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে দেশে ডলার প্রবাহের প্রায় সবক’টি খাতই সংকুচিত হয়েছে।

ডলার প্রবাহ কমে যাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বড় ধরনের ক্ষয় হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০২১ সালের আগস্টে দেশের গ্রস রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। এরপর থেকে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমেছে। গত ৩০ নভেম্বর দেশের গ্রস রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে প্রাপ্ত ঋণ ও বাজার থেকে ডলার কিনে রিজার্ভ প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ২৭ ডিসেম্বর গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ২৬ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার দেখানো হয়েছে। ওইদিন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) দেশের গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ২১ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। তবে একই দিন দেশের নিট রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৭ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। মূলত আইএমএফ থেকে ঋণ প্রাপ্তির শর্ত পূরণ করার জন্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কেনা বাড়িয়ে দিয়েছিল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি দায় পরিশোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যয় হবে প্রায় ১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। আবার দেশের ব্যাংকগুলো থেকে কেনা ডলারের একটি অংশ ১০ জানুয়ারির মধ্যে ফেরত দিতে হবে। ওই সময়ে ফেরত দেয়ার শর্তে কিছু ব্যাংক থেকে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ডলার কেনা হয়েছিল। সব মিলিয়ে ২০২৪ সালের প্রথম মাস তথা জানুয়ারিতেই রিজার্ভের আকার ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বনিক বার্তা

Exit mobile version