ফরহাদ মজহার – “ছাত্র অধিকার পরিষদ” নামের সংগঠনটি ছাত্রশিবিরের…….

“ছাত্র অধিকার পরিষদ” নামের সংগঠনটি ছাত্রশিবিরের পুনর্বাসনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে — ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন।
— এই একই অভিযোগে বুয়েটের আবরার শহিদকে ছাত্রলীগ নামধারীরা পিটিয়ে হত্যা করে। গতকাল সেই চেষ্টাই প্রকাশ্যে আবার দেখা গেল।
কাল দ্রুত চলে যায়।
১. আবরার ফাহাদ হত্যার তিন বছর শেষ হোল।  রাজু ভাস্কর্যের সামনে ছাত্র অধিকার পরিষদ শহিদ আবরার ফাহাদের স্মৃতি পালনের উদ্দেশ্যে যে সভা ডেকেছিল সেখানে লোহার রড নিয়ে মারাত্মক হামলা করেছে ছাত্রলীগ। বলাবাহুল্য তাদের টার্গেট বিশেষ ভাবে দিল্লীর আগ্রাসন বিরোধী সেই সকল তরুণ ছাত্র নেতা যারা বাংলাদেশে নরেন্দ্র মোদী বিরোধী সংগ্রামে  নেতৃত্ব দিয়েছে এবং ফ্যাসিস্ট সরকারের জুলুম সহ্য করেছে। তাদের রিমান্ডে নিয়ে,  কারাগারে নির্যাতন করে ও নানান শাস্তি দিয়েও নিরস্ত করা যায় নি। মামলা মাথায় নিয়েও তারা দিল্লীর আগ্রাসন ও হিন্দুত্ববাদ বিরোধী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেফতার না করে আকরাম, আখতার ও ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতাদের ধরে নিয়ে গিয়েছে। তাদের অবলম্বে মুক্তি দিতে হবে।
২.  বুয়েটের শেরেবাংলা হল থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় আবরারের বাবা চকবাজার থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত শেষে বুয়েটের ২৫ ছাত্রলীগ কর্মীর বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দেয়।  গত বছরের ৮ ডিসেম্বর আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান। এ মামলায় ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ফ্যাসিস্ট আমলে বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির নামে যে খুনি বাহিনীর জন্ম হয়েছে তার জন্য এই দেশের জনগণকে অনেক মূল্য দিতে হচ্ছে, আরও দিতে হবে।
৩. বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির অংকুরোদ্গম ঘটিয়ে দিয়ে গিয়েছে আবরার। তরুণরা তাদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা্র জীবন্ত ইশতেহার রচনা করেছে আট দফা দাবি সম্বলিত ‘আবরার স্মৃতিস্তম্ভ’ বানিয়ে। সেটা ভেঙে দিয়ে শহিদ আবরার স্মৃতিস্তম্ভকে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী করে দিয়েছে ফ্যাসিস্ট সরকার। এর মধ্য দিয়ে ছাত্র অধিকার পরিষদেরও বিবর্তন ঘটেছে জাতীয় রাজনীতিতে। গণ আধিকার পরিষদ এখন বাংলাদেশের গণরাজনীতির পরিচিত আন্দোলনের সংস্থা। একই ভাবেই তরুণ ছাত্রছাত্রীদের  লড়াই আগামি দিনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। রাখবে।
৪. এই লড়াই পুরা উপমহাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ লড়াই। বাংলাদেশে দিল্লীর আগ্রাসন বিরোধী লড়াইয়ের গুরুত্ব হচ্ছে এটা সুনির্দিষ্ট ভাবে উপমহাদেশে হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ ও শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই। এই হিন্দুত্ববাদী শক্তিই বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট ক্ষমতার ভিত্তি। চিনের উত্থান, রুশ-চীন জোট এবং ইউক্রেনে পতনশীল  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটের ‘প্রক্সি ওয়ার’ বিবেচনায় নিলে আমরা বুঝব পুরা উপমহাদেশ পুনর্গঠনের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন বিরোধী লড়াই কেন এখন গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন নেতৃত্বাধীন এক কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার ভাঙনের মুখে দক্ষিণ এশীয়ার জনগণকে অবশ্যই পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে হবে এবং দক্ষণ এশিয়ার অর্থনৈতিক বিকাশের উপর জোর দিতে হবে।
৫. বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই কোনভাবেই ভারত বা ভারতের জনগণ বিরোধী লড়াই নয়। সেটা কোন ভাবেই হিন্দুর বিরুদ্ধে লড়াই হতে পারে না। হিন্দুত্ববাদ পুরা উপমহাদেশ ব্যাপী ইসলাম নির্মূল এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে। বাঙালী জাতিবাদীরা বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলমানদের  বিরুদ্ধে একটি দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।  বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্র লীগের গৌরব জনক ইতিহাস আছে। কিন্তু লোহার রড ও লাঠি হাতে যেসব ছাত্রলয়গ নামধারী কর্মী আবরারা ফাহাদ স্মৃতি দিবস অনুষ্ঠানে হামলা করেছে মোদি-অমিত শাহের সেই সকল সৈনিকদের চেনা তাই মোটেও কঠিন নয়। হাতিড়ি, হ্যামলেট ও লোহার রড লীগ আর ছাত্র লীগ সমার্থক নয়। এটা বোঝার মতো কাণ্ডজ্ঞান আমাদের থাকা উচিত।
৭. বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই আমরা তখনই স্পষ্ট করতে পারব যখন আমরা প্রমাণ করতে পারব ‘ইসলাম’ মানে হিন্দু বিদ্বেষ কিম্বা সনাতন ধর্মের মানুষদের বিপরীতে ‘মুসলাম’ নামক কোন জাতিবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি না। আল্লা প্রতিটি জনগোষ্ঠির কাছে পথ প্রদর্শক পাঠিয়েছেন — এই শিক্ষা থেকে চ্যূত হওয়া যাবে না। এই শিক্ষাই তরুণদের সুনির্দিষ্ট ভাবে  ‘হিন্দু, হিন্দি, হিন্দুস্তান’ নামক হিন্দুত্ববাদী  মতাদর্শ, দক্ষণ এশিয়ার দিল্লীর আগ্রাসী ভূমিকা এবং বাংলাদেশে নানান কিসিমের হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন মোকাবিলার নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত করবে। পাশাপাশি বাংলাদেশকে সৌদি আরব, ইরান, তুরস্ক আফগানিস্তান বানাবার ফিকিরও বন্ধ হবে। যার সম্ভাবনা আমরা তরুণদের রাজনীতিতে দেখছি। । আবরার ফাহাদ এই লড়াইয়ের প্রতীক হয়েছেন ঠিক এ কারণেই।
৮. তো পরিষ্কার যে এই লড়াই মোদি-অমিত শাহ ও হিন্দুত্ববাদ এবং তাদের স্থানীয় গুণ্ডা বাহিনী ও হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই। এর অনুরণন ভারতের জনগণের মধ্যেও আমরা দেখছি। ভারতের জনগণকেও হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। শহিদ আবরার দিল্লীর আগ্রাসন বিরোধিতাকে বিমূর্ত ভাবে নয়, সুনির্দিষ্ট ভাবে বাংলার পানি, ভূগোল, যাতায়ত ব্যবস্থা, প্রাণ, প্রাণ সম্পদ এবং ভাষা ও সংস্কৃতি সুরক্ষার লড়াইয়ের কর্তব্য সামনে নিয়ে এসেছে। তাই আবরারা মোদী-অমিত শাহের দিল্লীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রথম শহিদ।
৯. কাল দ্রুত চলে যায়, কিন্তু যারা পিটিয়ে আবরারকে হত্যা করেছে তারাই লোহার রোড হাতে প্রকাশ্যে ছাত্র অধিকার পরিষদের সভায় হামলা করেছে। এবার প্রকাশ্যেই তরুণ নেতাদের হত্যার প্রচেষ্টা চালাতে দ্বিধা করে নি। যে যুক্তিতে তারা আবরারকে হত্যা করেছে, একই যুক্তি তারা গত কালের হত্যা প্রচেষ্টাতেও দিয়েছে। এটা বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয় বিষয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন প্রথম আলোকে পরিষ্কার বলেছে, “ছাত্র অধিকার পরিষদ” নামের সংগঠনটি ছাত্রশিবিরের পুনর্বাসনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, … বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশকে তারা বিনষ্ট করার চেষ্টা করে। ” ।
মনে রাখতে হবে আবরার ‘ছাত্র শিবির’ করে — এই অভিযোগেই আবারারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, কারন আবরাররা  নাকি বুয়েটের পরিবেশ নষ্ট করে । সেই একই অভিযোগে গতকাল ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতৃবৃন্দকে হত্যার জন্য লাঠি রড হাতে হামলা হয়েছে। এই ন্যক্কারজনক ঘটনা নিন্দার ভাষা আমাদের জানা নাই। মনে রাখতে হবে ছাত্র অধিকার পরিষদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নতুন কিছু নয়।  ফ্যাসিস্ট শক্তির সঙ্গে যুক্ত গণমধ্যমগুলো বারবারই  নুরু, রাশেদদের ‘শিবির’ বলে অভিযুক্ত করেছে।
জনগণকে বোকা ভাববার কোন কারণ নাই।