ঢাকা
জিনিসপত্রের দামের ওপর ভিত্তি করে মূল্যস্ফীতির হিসাব গণনা করা হয়। কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলো জিনিসপত্রের দামের যে হিসাব করে, তার সঙ্গে বাজারমূল্যের গরমিল আছে। দেশে মূল্যস্ফীতির হিসাব করে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। সংস্থাটি মাঠপর্যায় থেকে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দাম সংগ্রহ করে। সেই দামের ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হিসাব কষে তা প্রকাশ করা হয়।
আরেক সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) চাল, ডাল, আটা, ময়দা, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, রসুনসহ সব নিত্যপণ্যের প্রতিদিনের বাজারমূল্য প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি গণনায় বিবিএস বিভিন্ন পণ্যের যে দাম বিবেচনায় নেয়, তার সঙ্গে টিসিবির দামের মিল নেই। তাই সরকারি দুই সংস্থার দামের এই ফারাক মূল্যস্ফীতি গণনাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি দুই সংস্থা বিবিএস ও টিসিবির দুই রকম তথ্য মূল্যস্ফীতির হিসাবকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। টিসিবির দামের হিসাব বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম। আবার বিবিএস বলছে, মূল্যস্ফীতি কমেছে। তাদের হিসাবও বাজারের সঙ্গে মেলে না। বাজারের প্রকৃত দাম ধরেই মূল্যস্ফীতি গণনা করা উচিত।
বর্তমান সময়ে দেশে-বিদেশে মূল্যস্ফীতি বেশ আলোচিত বিষয়। বিবিএসের সর্বশেষ হিসাবে, গত অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশে। গত মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে মূল্যস্ফীতির এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। এর আগে আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ, ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে।
টিসিবির দামের হিসাব বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম। আবার বিবিএস বলছে, মূল্যস্ফীতি কমেছে। তাদের হিসাবও বাজারের সঙ্গে মেলে না।
তথ্যের গরমিল
জিনিসপত্রের দামে সরকারি সংস্থার তথ্যে গরমিলের কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বিবিএস মোটাদাগে ৪৭টি পণ্যের বাজারদরের ওপর ভিত্তি করে মূল্যস্ফীতি গণনা করে থাকে। একজন গরিব মানুষ চাল কিনতে তাঁর মোট ব্যয়ের ৩২ শতাংশ খরচ করেন। বিবিএসের হিসাবে গত অক্টোবর মাসে এক কেজি মোটা চালের দাম ছিল ৫৭ টাকা। অন্যদিকে টিসিবি বলছে, গত মাসে মোটা চালের দাম ওঠানামা করেছে ৪৮ থেকে ৫২ টাকার মধ্যে।
মূল্যস্ফীতি গণনায় এক কেজি আটার দাম প্রায় ৫৬ টাকা ধরেছে বিবিএস। কিন্তু টিসিবির হিসাবে তা ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা। ছোট দানার এক কেজি মসুর ডালের দাম ১৩৫ টাকা ধরে মূল্যস্ফীতির হিসাব করেছে বিবিএস। টিসিবি বলছে, অক্টোবর মাসে মসুর ডালের দাম ছিল ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা।
গত মাসে চিনি নিয়ে বেশ হইচই হয়েছে। বাজারে চিনির দাম বেশ চড়া ছিল। বিবিএসের কর্মকর্তারা মাঠে গিয়ে দেখেছেন, এক কেজি চিনির গড় দাম ছিল ৯৮ টাকা। টিসিবির হিসাবে গত মাসে চিনির দাম ছিল কেজিপ্রতি ১১০ থেকে ১১৫ টাকার মধ্যে। টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত মাসে এক কেজি দেশি পেঁয়াজের ছিল ৪৫ টাকা। বিবিএস মূল্যস্ফীতির হিসাব গণনায় পেঁয়াজের দাম ধরেছে ৫৫ টাকা। রুই মাছের কেজি ৪০০ টাকা দাম, এটা বিবিএসের তথ্য। অন্যদিকে টিসিবির তথ্য হলো গত মাসে রুই মাছের কেজিপ্রতি দাম ছিল গড়ে ৩৫০ টাকা।
এভাবে প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের দামে পার্থক্য রয়েছে বিবিএস ও টিসিবির হিসাবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় টিসিবির হিসাবটি বিবেচনায় আনে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির মতো সংবেদনশীল তথ্যের হিসাব হয় বিবিএসের কর্মকর্তাদের নেওয়া মাঠপর্যায়ের তথ্য নিয়ে।
এ বিষয়ে বিবিএসের জাতীয় আয় শাখার একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মাঠপর্যায়ে জিনিসপত্রের যে দাম পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতেই মূল্যস্ফীতির হিসাব করা হচ্ছে। বরং তিন মাস ধরে মাঠপর্যায়ের তথ্য আরও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তারা মাঠে গিয়ে মাঠকর্মীর তথ্য যাচাই-বাছাই করছেন।
মজুরির হার বৃদ্ধি নিয়ে ‘তৃপ্তির ঢেকুর’
গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশের সময় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির পাশাপাশি মজুরির হারও বেড়েছে। এ নিয়ে তিনি স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু বাস্তবতা হলো মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ছে, এর কম হারে মজুরি বাড়ছে। গরিব মানুষ বেশির ভাগই শ্রমিক শ্রেণির। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মজুরি না বাড়লে তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। তাঁরা বাজার থেকে আগের মতো পণ্য কিনতে পারেন না। অবশ্য কয়েক মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির চেয়ে মজুরি হার বৃদ্ধি কম হচ্ছে। গত অক্টোবর মাসে জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। এর মানে একজন শ্রমিক ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে ১০০ টাকা মজুরি পেলে এ বছর অক্টোবর মাসে মজুরি বেড়ে হয়েছে ১০৬ টাকা ৯১ পয়সা। কিন্তু একই সময়ে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। এ ছাড়া গত সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। তার বিপরীতে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আগস্টে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৮০ শতাংশ। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ—৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির গতি কম থাকায় অনানুষ্ঠানিক খাতের প্রায় ৫ কোটি শ্রমজীবী মানুষ বিপাকে পড়েছেন।