Site icon The Bangladesh Chronicle

প্রশাসনে কৃষ্টির সংযোগ ও কর্ম-নির্দিষ্ট নিয়োগ

প্রশাসনে কৃষ্টির সংযোগ ও কর্ম-নির্দিষ্ট নিয়োগ –

মেধাবী হলেই শিক্ষা অর্জন করা যায়; কিন্তু সাংস্কৃতিক মনন ও বোধ তৈরি করা যায় না। কৃষ্টি হলো দীর্ঘমেয়াদি এক প্রক্রিয়া। ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশে এই নীতি ভালোভাবে অনুসরণ করত। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজনও আইসিএস অফিসার রিক্রুট না হওয়ার পেছনে এটি অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। ব্রিটিশরা এই রিক্রুটমেন্টের ক্ষেত্রে শুধু প্রার্থীর শিক্ষা বিবেচনা করত না, তার পারিবারিক ঐতিহ্যও দেখত। শিক্ষার সাথে দৈহিক গড়ন ও অন্যান্য বিবেচনায় আমার বাবা একই প্রক্রিয়ায় ১৯১৯ সালে পুলিশ অফিসার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি পুলিশ একাডেমিতে ট্রেনিং নিয়ে বাড়ি এলে দাদা তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে?’ দাদার পরামর্শে তখন বাবা পুলিশের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা প্র্যাকটিস শুরু করেন। অবিভক্ত বাংলায় ১৯৩৫ সালের দিক থেকে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যাডার সার্ভিসে রিক্রুটমেন্ট শুরু হয়। পাকিস্তান হওয়ার পর একঝাঁক সিএসপি অফিসার নিয়োগ পেলেন। ১৯৪৯ সালে সিএসপি পরীক্ষায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে মরহুম শফিউল আজম প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি হয়েছিলেন। খুবই ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। তার সাথে আমার বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ করা ও কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তখন আমিও এই প্রক্রিয়ার অংশীদার ছিলাম।

 

আজকে আমাদের দেশে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যের বালাই নেই। অর্থাৎ কৃষ্টি, শিক্ষা ও প্রশাসন- এই তিনের সংযোগ নেই। তাছাড়া শিক্ষা-নির্দিষ্ট নিয়োগও এ দেশে হয় না। ঢালাওভাবে সবাইকে সব ক্যাডারে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়ায় দক্ষতার অবনমন ঘটছে। কেউ যে বিষয়ে পড়াশোনা করেছে হয়তো তার উপযুক্ত পদে ওই প্রার্থীকে বসানো হচ্ছে না। ডাক্তারি পাস করে যেমন ম্যাজিস্ট্রেট হচ্ছে, তেমনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে পুলিশে যাচ্ছে, অর্থনীতিতে পড়াশোনা করে যাচ্ছে ফরেন ক্যাডারে। এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায়।

‘জব-স্পেসিফিক রিক্রুটমেন্ট’-এর কথা বলছি। পাশাপাশি কৃষ্টিকেও রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হবে। ‘জব-স্পেসিফিক জব-ডেসক্রিপশন’ তৈরি করে প্রার্থীর আবেদনপত্রটি ওই ডেসক্রিপশনের সাথে মিলছে কি না, সে কালচারালি টিউনড কি না, তা দেখা উচিত। এটি কিভাবে করা যাবে তা খুঁজে বের করবে সরকারি কর্মকমিশন। এ জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। আমাদের কঠোর পরিশ্রম করার মানসিকতা কম। কোনো পর্যায়েই তা নেই। জব স্পেসিফিক সার্ভিস হলে মান বাড়বে, দেশের উন্নতি হবে, উন্নতি টেকসই হবে। একদিকে জব-স্পেসিফিক রিক্রুটমেন্ট হয় না অন্য দিকে শিক্ষার্থীর জ্ঞান হালনাগাদ করার ব্যবস্থা নেই। ফলে রাষ্ট্রের পয়সায় শিক্ষা অর্জন করা শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রকে তেমন কিছু দিতে পারে না। এর ফল ভোগ করতে হয় সমাজকে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় একটি সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিয়ে দাবি করে, আমরা জনশক্তি তৈরি করেছি। কিন্তু এই জনশক্তিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে চলার উপযোগী রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। কারখানায় পণ্য উৎপাদনের পর এর গায়ে যেমন ল্যাবেল লাগিয়ে দেয়া হয়, তেমনি শিক্ষার্থীর ডিগ্রিটাও যেন একটি ল্যাবেল। কিন্তু কোনো পণ্য উৎপাদনের পর সে জিনিসটি ঠিকমতো চালু রাখতে সে জন্য একটি সার্ভিসিং সুবিধা দেয়া হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো তাদের আঙ্গিনা থেকে চলে যাওয়া শিক্ষার্থী কী করছে, তার কোনো খবর রাখে না।

কোনো শিক্ষার্থী যদি কর্মজীবনে অপকর্ম-দুর্নীতি করে, তাহলে তার ডিগ্রি বাতিলের কোনো বিধান নেই। যন্ত্র নষ্ট হলে আমরা মেরামত করি। খুচরা যন্ত্রাংশ পাওয়া না গেলে বা সার্ভিসিং সুবিধা না থাকলে আমরা ওই যন্ত্রটি কিনি না। অথচ আমরা মানুষকে ‘জনশক্তি’ বললেও তার যে ‘সার্ভিসিং’ বা ‘আপগ্রেড’ করা দরকার, সে কথা কেউ বলি না। অথচ এটি হওয়া উচিত ছিল। উচিত ছিল, বিশ্ববিদ্যালয় তার যে শিক্ষার্থীকে নিয়মিত আপগ্রেড করবে না, তাকে চাকরিতে নিয়োগ দেয়া হবে না। আমেরিকায় একজন এমডি বা ডাক্তার হতে গেলে খুব কঠিন শিক্ষা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়; কিন্তু এরপরও যে ডিগ্রি তাকে দেয়া হয়, তা তার সারা জীবনের জন্য নয়; মাত্র ১০ বছরের জন্য। এই ১০ বছর পর আবার তাকে বোর্ডের সামনে হাজির হয়ে সমসাময়িক চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞানের পরীক্ষা দিতে হয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এ বিষয়টি পুরোপুরি অনুপস্থিত।

তাই বলছি, আমাদের উন্নয়নকে টেকসই করতে শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রশাসনে নিয়োগ প্রক্রিয়া ঢেলে সাজাতে হবে। সংস্কৃতির সাথে এগুলোকে সমন্বিত করতে হবে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
hmct2004@yahoo.com

Exit mobile version