- ইকতেদার আহমেদ
- ০৫ জুলাই ২০২১
সাংবিধানিক পদধারীদের মধ্যে কিছু কিছু জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত; যেমন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী। এসব পদধারীর নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য সমাধা করে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীও রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত; তবে এ নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের আবশ্যকতা না থাকলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের আস্থাভাজন নন এমন কোনো ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতির পক্ষে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেয়ার সুযোগ অনুপস্থিত।
জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত নন এমন কিছু কিছু সাংবিধানিক পদধারী যেমন সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারক, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের সভাপতি ও সদস্য, অ্যাটর্নি জেনারেল প্রভৃতির নিয়োগকার্য রাষ্ট্রপতি আবশ্যিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী সমাধা করে থাকেন। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণের আবশ্যকতা না থাকলেও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারককে অতিক্রান্ত করে কনিষ্ঠ কাউকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেয়া হলে সে নিয়োগ বিষয়ে নানাবিধ প্রশ্নের উদয় হয়।
রাষ্ট্রপতির নিয়োগপ্রাপ্ত যেসব সাংবিধানিক পদধারী জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত নন এমন সব পদধারীকে সব ধরনের প্রলোভনের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য সংবিধান প্রণয়নকালে অবসর-পরবর্তী তাদের ক্ষেত্রবিশেষে স্বপদে পুনঃনিয়োগের বিধান থাকলেও প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে পুনঃনিয়োগ বারিত ছিল।
সংবিধান প্রণয়নকালে প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারকদের অবসর-পরবর্তী প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে পুনঃনিয়োগ সম্পূর্ণরূপে বারিত ছিল। পরবর্তীতে সামরিক ফরমানবলে সংবিধান দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ, ১৯৭৮ দ্বারা অবসর-পরবর্তী সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের বিচারিক বা আধাবিচারিক পদে নিয়োগের বিধান প্রবর্তনসহ হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক পদ থেকে অবসর-পরবর্তী আপিল বিভাগে ওকালতি করার যোগ্য করা হয়। দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশটি সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সাংবিধানিক বৈধতা লাভ করে। অতঃপর সংবিধান ত্রয়োদশ সংশোধন আদেশ দ্বারা সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদ থেকে অবসর-পরবর্তী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টা পদে নিয়োগের জন্য যোগ্য করা হয়।
সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল ঘোষিত হলে সাধারণ জনমানুষের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণার সৃষ্টি হয় যে, সরকার পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত দল আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ’৭২-এর সংবিধানে প্রত্যাবর্তন করবে।
’৭২-এর সংবিধানে প্রবর্তিত বিধান অনুযায়ী একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অবসর-পরবর্তী পুনঃনিয়োগ বারিত হলেও একজন নির্বাচন কমিশনারের অবসর পরবর্তী প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে পুনঃনিয়োগের বিধান অদ্যাবধি কার্যকর আছে। অনুরূপ বিধান সরকারি কর্ম কমিশনের সভাপতি ও সদস্যের ক্ষেত্রেও কার্যকর রয়েছে; তবে মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের অবসর-পরবর্তী প্রজাতন্ত্রের কর্মে লাভজনক পদে নিয়োগ সম্পূর্ণরূপে বারিতের বিধান পূর্বাপর একই রয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেলের ক্ষেত্রে পদ থেকে বিদায় পরবর্তী সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে অথবা অপর কোনো আদালতে ওকালতি করা বারিত নয় এর বিধান কখনো কোনো ধরনের বাধ্যবাধকতার মধ্যে আবদ্ধ হয়নি।
সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিলের ফলে পঞ্চদশ সংশোধনী প্রবর্তিত হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অপরাপর প্রায় সব ক্ষেত্রে ’৭২-এর সংবিধানে প্রত্যাবর্তন করা হলেও সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সুবিধাদি অক্ষুণ্ন রাখা হয়। উল্লেখ্য সুপ্রিম কোর্টে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষিত হলে উচ্চাদালতের বিচারকদের অবসর-পরবর্তী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টা পদে নিয়োগবিষয়ক বিধান আপনা আপনি রহিত হয়ে গেলে এর কার্যকারিতা বিনষ্ট নয়।
সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারকের পদে বহাল থাকাবস্থায় প্রজাতন্ত্রের কর্মে অপর কোনো পদে নিয়োগের সুযোগ না থাকলেও অতীতে দেখা গেছে, কর্মরত বিচারক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ লাভ-পরবর্তী তথা হতে অবসর নিয়েছেন অথবা সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে পুনঃপ্রত্যাবর্তন করেছেন। এর কোনোটিই সংবিধান অনুমোদন করে না। অনুরূপ সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদ থেকে অবসর-পরবর্তী বিচারিক বা আধাবিচারিক পদ ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের কর্মে অপর কোনো লাভজনক পদে নিয়োগ বারিত হলেও প্রত্যক্ষ করা গেছে যে, দীর্ঘদিন যাবৎ আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য এবং বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক পদে অবসরপ্রাপ্ত বিচারকরা সংবিধানের সুস্পষ্ট বিধানের অবজ্ঞা ও উপেক্ষায় নিয়োগ লাভ করে চলেছেন।
’৭২-এর সংবিধানে উচ্চাদালতের বিচারকদের অবসরের বয়স ছিল ৬২ বছর। সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চাদালতের বিচারকদের অবসরের বয়স ৬৫ বছরে উন্নীত করা হয় এবং অতঃপর চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৬৭তে উন্নীত করা হয়। উচ্চাদালত কর্তৃক সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল ঘোষিত হলেও ওই সংশোধনী দ্বারা বিচারকদের অবসরের বয়স বৃদ্ধি করে যে সুবিধা প্রদান করা হয় পরবর্তীতে সংবিধানের পঞ্চদশ বা ষোড়শ সংশোধনী প্রণয়নকালে তাতে হস্তক্ষেপ করা হয়নি।
বাংলাদেশ অভ্যুদ্বয়-পরবর্তী প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের অবসরের বয়স ছিল ৫৫ বছর। গণকর্মচারী (অবসর গ্রহণ) আইন, ১৯৭৪ পরবর্তী অবসর গ্রহণের বয়স ৫৭ করা হয়। অতঃপর উক্ত আইনে সংশোধনী আনয়নপূর্বক অবসর গ্রহণের বয়স ৫৯ করা হয়।
সংবিধান ও গণকর্মচারী (অবসর গ্রহণ) আইন প্রণয়ন পরবর্তী উচ্চাদালতের বিচারক ও গণকর্মচারীদের অবসর গ্রহণের বয়সের ব্যবধান ছিল পাঁচ বছর। অতঃপর এ ব্যবধান প্রথমত, আট বছরে এবং পরবর্তীতে ১০ বছরে উন্নীত হয়। সর্বশেষ গণকর্মচারীদের অবসরের বয়স ২ বছর বৃদ্ধি করায় এ ব্যবধান পুনঃ আট বছরে নেমে আসে।
উপরিউক্ত ব্যবধানদৃষ্টে প্রতীয়মান হয়, উচ্চাদালতের বিচারকরা স্বাভাবিকভাবেই গণকর্মচারীদের চেয়ে আট বছরের অধিককাল কর্মে বহাল থাকেন। গণকর্মচারীদের অতি নগণ্য সংখ্যকের অবসর-পরবর্তী এক বা দুই দফায় ১-৩ বছর পর্যন্ত চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ লাভের বিরল সুযোগ ঘটে। আবার কেছু ভাগ্যবান গণকর্মচারী সাংবিধানিক পদ যেমন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান বা মেম্বার প্রভৃতি অথবা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার মেয়াদি পদ যেমন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও মেম্বার, বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও মেম্বার, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ও মেম্বার প্রভৃতিতে দলীয় সুবিধাভোগী বা দলীয় মতাদর্শী বিবেচনায় নিয়োগ লাভের সুযোগ পেয়ে থাকেন। উপরিউক্ত সাংবিধানিক ও মেয়াদি পদগুলোর মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারের পদ ব্যতীত অপর কোনো পদ বিচারিক বা আধাবিচারিক পদ নয় কিন্তু তদসত্ত্বেও দেখা যায় সংবিধানের অবমাননায় কোনো ধরনের নীতি-নৈতিকতার বালাই না করে অবসর-পরবর্তী বাধাহীনভাবে উচ্চাদালতের দলীয় সুবিধাভোগী বা দলীয় মতাদর্শী একশ্রেণীর বিচারকদের এসব পদে নিয়োগ লাভ ঘটছে।
উচ্চাদালতের বিচারকদের অবসর-পরবর্তী ’৭২-এর সংবিধানের চেতনার আলোকে প্রজাতন্ত্রের সব ধরনের কর্মে নিয়োগ বারিত রাখা হলে কোনো বিচারকের অবসর-পূর্ববর্তী বা পরবর্তী পদ লাভের আশায় প্রলোভনের বশবর্তী হয়ে কোনো ধরনের অন্যায় বা অনৈতিক কাজ করার সুযোগ নেই। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ করা গেছে, কিছু বিচারক পদে বহাল থাকাকালীন প্রলোভনের বশবর্তী হয়ে অন্যায় প্রাপ্তির আশায় সরকারের সন্তুষ্টি অর্জনে আইন ও বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ রায় দিয়েছেন অনুরূপ পদ থেকে বিদায়-পরবর্তী নিজেকে দলের একনিষ্ঠ সমর্থক প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে দলীয় মিছিলের অগ্রভাগে অবস্থানপূর্বক বিরোধীদলীয় নেত্রীর বাসভবন ঘেরাও কাজে অংশ নিয়ে শুধু নিজেকে নয় সমগ্র বিচার বিভাগকে বিতর্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে উপরিউক্ত বিচারকরা নিজেদের যেভাবে বিতর্কিত করেছেন তাতে তাদের বিচারিক জীবনের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড মহাবিতর্কের আবর্তের মধ্যে পড়েছে। সুতরাং যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ’৭২-এর সংবিধানে অবসর-পরবর্তী সব ধরনের নিয়োগ বারিত করা হয়েছিল কোনো ঠুনকো যুক্তির অজুহাতে তা থেকে বিচ্যুত হলে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হবে।
জনগণের ভোটে নির্বাচিত নন এমন সব সাংবিধানিক পদধারীদের বিশেষ ক্ষেত্র ব্যতীত অবসর-পরবর্তী প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে পুনঃনিয়োগ যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে বারিত করা হয়েছে তা হলো তারা যেন অবসরের পূর্বমুহূর্তে প্রলোভনের বশবর্তী হয়ে এমন কিছু না করেন যাতে ক্ষমতাসীন সরকার বা ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থ সংরক্ষিত হয় এবং অন্যায়ভাবে অন্যদের স্বার্থ বিনষ্ট হয়। ’৭২-এর সংবিধানে উচ্চাদালতের বিচারকদের অবসর-পরবর্তী প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে পুনঃনিয়োগ সম্পূর্ণ বারিতের বিধান যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়েছে তা আংশিক বহাল থাকায় সে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্পষ্টত ব্যাহত। এর পরও যখন দেখা যায় সংবিধানের অবজ্ঞা ও উপেক্ষায় কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারকরা প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে নিয়োগ লাভ করেছেন তখন এ দেশের সাধারণ জনমানুষের আক্ষেপ বা দুঃখ প্রকাশ ছাড়া আর কি বা করার আছে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com