- তৈমূর আলম খন্দকার
- ১২ নভেম্বর ২০২১
ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমান পদ্মা ব্যাংক) থেকে চার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগের মামলায় ০৯/১১/২০২১ তারিখে বাংলাদেশের আলোচিত সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে দুদক আইনের পৃথক দুটি ধারায় ১১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার বিশেষ জজ ৪ নম্বর আদালত। উল্লেখ্য, প্রভাব খাটিয়ে ফারমার্স ব্যাংক থেকে চার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের দায়ে চার বছর এবং মানি লন্ডারিংয়ের জন্য সাত বছর কারাদণ্ড ও ৪৫ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ছয় মাস কারাদণ্ডসহ তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ৭৮ লাখ টাকা বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দেয়া হয়েছে। তবে উভয় সাজা একসাথে চলায় তাকে সাত বছর সাজা খাটার কথা রয়েছে, যদি না উচ্চ আদালত বা সরকারপ্রধান ভিন্নরূপ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বাংলাদেশে তো বটেই গোটা পৃথিবীতেই কোনো প্রধান বিচারপতির সাজা হওয়া অতি বিরল একটি ঘটনা। স্বৈরশাসক ইদি আমিনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রায় দেয়ায় চার দিন পরে উগান্ডার প্রধান বিচারপতির লাশ ড্রেনে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। তবে বিচিত্র এই বাংলাদেশে প্রধান দুই দলের দুই রাষ্ট্রপতি দেশ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিতদের হাতে খুন হয়েছেন। দেশের সাংবিধানিক পটপরিবর্তনের কারণে সময়ে সময়ে আবির্ভূত সব প্রভাবশালী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী কারাবন্দী হয়েছেন। পুলিশপ্রধান, এনএসআই প্রধান জেল খেটেছেন ও এখনো খাটছেন। তবে প্রধান বিচারপতির কারাভোগের আদেশ পৃথিবীর একটি বিরল দৃষ্টান্ত।
কাগজ কলমে রয়েছে যে, বিচার বিভাগ একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, বাস্তবে কি তাই? প্রধান বিচারপতি বা বিচার বিভাগ কি জনস্বার্থে সরকার বা সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের বিপরীতে অবস্থান নিতে পারছেন? বিচার বিভাগ সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাক এটিই দেশবাসীর কামনা, তা কি হচ্ছে? সরকার আইন প্রণয়ন করে এবং সে আইনের বাস্তবায়ন ও প্রতিফলন ঘটে বিচার বিভাগের মাধ্যমে। সরকার আইন প্রণয়ন করে নিজেদের স্বার্থে, কিন্তু মানবতা ও ন্যায়পরায়ণতাবিহীন আইনের প্রয়োগ ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। ‘মানবতা’ ‘ন্যায়পরায়ণতা’ আইনে লেখা থাকে না, কিন্তু থাকতে হয় বিচারকের মন মানসিকতায়। ‘ন্যায়ভিত্তিক আইন’ ও ‘আইনভিত্তিক ন্যায়’ এক কথা নয়। এ দুটি বিষয়ে সূক্ষ্ম তারতম্য বোঝার বোধশক্তি অনেকেরই থাকে না। অনেক বিচারককে বলতে শুনেছি যে, ‘আইনের বাইরে যাওয়ার আমার সুযোগ নাই।’ বিচারকের চেয়ারে খচিত ‘দাঁড়িপাল্লা’ ন্যায়ের প্রতীক, আইনের প্রতীক নয়। বিবেচনা বোধ, সামাজিক প্রেক্ষাপট যথাযথ উপলব্ধি করার মনোবিজ্ঞানসম্পন্ন মানসিকতা বা মেরুদণ্ড সোজা রেখে সিদ্ধান্ত নেয়ার নৈতিক ক্ষমতা কতজন বিচারকের রয়েছে? এসব বিষয় এখন পাবলিক পারসেপশনে নিয়মিত পর্যালোচিত হচ্ছে। রাষ্ট্র প্রণীত ‘আইন’ যদি ‘ন্যায়ের’ সাথে সাংঘর্ষিক হয় তবে সে আইন রদ ও রহিত করাই বিচারকের দায়িত্ব বলে আমরা মনে করি।
দেশে যতবার সামরিক আইন জারি হয়েছে ততবারই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসককে শপথ করিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। ব্যতিক্রম ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী। বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ পাকিস্তানি জেনারেল টিক্কা খানকে শপথপাঠ না করিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগমান করেছিলেন। অতএব, বিচার বিভাগ সবসময় জনস্বার্থে অবস্থান নেয়নি, তা বলা যাবে না। সরকারপ্রধানের অপছন্দের লোক বা বিরোধী দলের ওপর যে পুলিশ কর্মকর্তা যত অত্যাচার নির্যাতন করতে পারে, তার তত বেশি প্রমোশন হয় এবং সরকারপ্রধানের আশীর্বাদপুষ্ট থাকায় সিনিয়র ডিঙ্গিয়ে প্রমোশন ও লোভনীয় পোস্টিং তখন ছেলের হাতের মোয়ার মতো সহজলভ্য হয়ে যায়। বিচার বিভাগের প্রমোশন অনুরূপ নীতিতে হচ্ছে বলেই গণমানুষ মনে করে।
বাংলাদেশ ৯২ শতাংশ মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা হওয়া সত্ত্বেও বিচারপতি সিনহার প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত না হওয়ায় এটিই আবারো প্রমাণ হয়েছে যে, বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, বন্ধুরাষ্ট্র ভারত যার সম্পূর্ণ বিপরীত। কিন্তু তিনি প্রধান বিচারপতির শপথ নিয়েই সুপ্রিম কোর্টের সামনে একটি মূর্তি স্থাপন করে এক বিতর্ক সৃষ্টি করে তা স্থানান্তর করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই মূর্তি এখন সারাক্ষণ পুলিশ পাহারায় রাখতে হয়। দুর্নীতি দমন অধিদফতরকে ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন বানিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করা হয়। যারা দুদককে শক্তিশালী করেছেন সেসব মন্ত্রী/এমপি/নেতা সবাইকেই দুদক আইনে জেল খাটতে হয়েছে; হয়েছেন সাজাপ্রাপ্ত। এ কারণে অনেকেই জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি।
আমলাতন্ত্র বা আমলা কী ও তাদের প্রকৃতি ও চরিত্র কী ও কত প্রকার, তা বোঝা যায় যখন একজন আমলা রিটায়ার করার পর তারই কলিগের কাছে পেনশনের টাকা আনতে যান। সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহা এখন উপলব্ধি করতে পারবেন, একজন বিচারপ্রার্থী বা আইনের বেড়াজালে আটকা পড়া একজন মানুষ কতটুকু অসহায় এবং আদালতের গণ্ডি পার হতে একজনকে কতটুকু কাঠখড় পোড়াতে হয়। বিচারপতি সিনহার কথাবার্তায় বোঝা যেত যে, তিনিই একমাত্র দেশপ্রেমিক এবং তিনি ছাড়া দুদক আইনে অভিযুক্ত সবাই দুর্নীতিবাজ। এখন তিনি বুঝবেন দুদক নখদন্তবিহীন হলেও তারা কতটুকু কী করতে পারে। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের প্রধান। দেশের প্রচলিত বিচারব্যবস্থায় তিনিই শেষ আশ্রয়। অথচ ফাঁসির আসামির আপিল তিনি নিমেষেই শেষ করে দিতেন, পূর্ণাঙ্গ শুনানি করার সুযোগ তিনি কমই দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নিয়ে তিনি বলছেন যে, ৭০ শতাংশ পোস্টমর্টেম রিপোর্টই ভুয়া; অথচ আপিল শুনানিতে পোস্টমর্টেম রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই বিচারিক সিদ্ধান্ত নিতেন।
সিনহা সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। আইনের বিধান মতে, তাকে আদালতে আত্মসমর্পণ করে মামলায় কনটেস্ট করার কথা ছিল। কিন্তু বিচার চলাকালে তিনি আত্মসমর্পণ করেননি, এখন করবেন কি না তা সময়ই বলতে পারবে। আত্মসমর্পণ না করে আইনের ভাষায় তিনি ফিউজিটিভ হয়েছেন। তিনি নিশ্চয় উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, আত্মসমর্পণ করলে সরকারের কলকাঠিতে তিনি হয়তো ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন এবং রিমান্ডসহ ন্যায়ের মানদণ্ড তার প্রতি যথাযথভাবে প্রয়োগ না-ও হতে পারে। তিনি নিজের বেলায় বিচারিক সিদ্ধান্তে ক্ষমতার প্রভাব এখন উপলব্ধি করতে পারছেন, বিরোধী দলের নেতা কর্মীদের প্রশ্নে তার সেই উপলব্ধি ছিল না কেন? নিজের বেলায় যিনি ষোলোআনা বুঝছেন, পরের বেলা তা বুঝতে তিনি কেন এত অবুঝ ছিলেন? পুলিশ রিমান্ডে পুলিশি নির্যাতনের ভয় তাকে তাড়া করার কারণে হয়তো মামলা তদন্তাধীন সময়ে আত্মসমর্পণ করেননি। প্রধান বিচারপতি থাকাবস্থায় রিমান্ডে পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।
সিনহা বাবু ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১(ক) ধারায় হাইকোর্টের ক্ষমতা তার দেয়া বিভিন্ন রায়ের মধ্য দিয়ে সঙ্কুচিত করে দুদককে করেছেন অনেক শক্তিশালী। এখন সেই দুদকের বালুচরেই তিনি আটকা পড়েছেন।
প্রধান বিচারপতির সাজা হওয়ায় বিচারিক অঙ্গন একটি মনস্তাত্ত্বিক (Conceputal) সমস্যায় পড়েছে। সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রিম কোর্টের যেকোনো বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন অধস্তন সব আদালতের জন্য অবশ্য পালনীয় হইবে।’ সাংবিধানিক বাধ্যবাদকতার কারণে সিনহা বাবুর নেতৃত্বাধীন বিচারিক বেঞ্চ আইনি ফয়সালা বা প্রদত্ত আইন নৈতিকতার পরিমাপে কতটুকু গ্রহণযোগ্য? প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি ও মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিতের দায়িত্ব পালন অন্য দিকে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা অন্য বড় কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনের একই মানদণ্ডে বিবেচিত হয় না। কারণ বিচারিক বা ধর্মীয় দায়িত্ব ও সরকারি দায়িত্ব পালন বা আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত এক কথা নয়। রাষ্ট্রপতি এরশাদের স্বাক্ষরে অনেক আইন রয়েছে, তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার পরও সে আইন চলমান, কিন্তু বিচারপতি যখন নিজেই বিচারিক সিদ্ধান্তে দোষী হয়ে পড়েন, তখন তার প্রদত্ত রায়ে সৃজিত ‘আইন’ অনুসরণ, অনুকরণ নৈতিকতার প্রশ্নে মানুষের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য বা মর্যাদাসম্পন্ন হবে, এটিই এখন পর্যালোচনার দাবি রাখে। আশা করি বিচার বিভাগ নিজেদের কারণেই বিষয়টি আমলে নেবেন।
বিচারপতি সিনহাকে পেশার সহযাত্রী আইনজীবী হিসেবে পেয়েছি, হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে তার কোর্টে ওকালতি করেছি। তার পড়াশোনা ও understanding ক্ষমতা সম্পর্কে আমার ধারণা ভালো; কিন্তু তার বিচারিক নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিএনপি চেয়ারপারসন ৭৪-৭৫ বয়স্ক অসুস্থ একজন নারী হওয়া সত্তে¡ও সিনহা বাবু প্রধান বিচারপতি থাকাবস্থায় বিচারিক সিদ্ধান্তে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া আইনি সহায়তা পাননি, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারা অনুযায়ী যা হওয়ার কথা ছিল। বিএনপি চেয়ারপারসন ও সিনহা বাবু একই আইনে অর্থাৎ দুদক আইনে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। এখন নিশ্চয় বিচারপতি সিনহার উপলব্ধি হবে বেগম খালেদা জিয়ার প্রশ্নে তার বিচারিক সিদ্ধান্ত কতটুকু নিরপেক্ষ ও মানবিক ছিল? ফলে বিচার বিভাগ থেকে তিনি এখন কতটুকু ন্যায়ভিত্তিক অথবা আইনভিত্তিক প্রতিকার প্রত্যাশা করতে পারেন?
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com