প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের প্রস্তুতি শুরু করেছে সরকার। জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে পূর্ণ দ্বিপক্ষীয় ওই সফর হবে বলে আশা করছে ঢাকা। সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ৫ বছর পর অনুষ্ঠেয় প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরকে বিবেচনায় রেখে পররাষ্ট্র সচিব এরইমধ্যে বেইজিং ঘুরে এসেছেন। সেখানে এফওসি’র আওতায় দুই দেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রায় সব বিষয়ে স্টকটেকিং আলোচনা হয়েছে। যার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে সরকারপ্রধানের প্রস্তাবিত বেইজিং সফরের বিষয়টি। চীনের তরফে ৪ দিনের একটি স্লট প্রস্তাব করা হয়েছে জানিয়ে দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মানবজমিনকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর পূর্ব নির্ধারিত ভারত সফর কিংবা আচমকা আলোচনায় আসা ভারতের পুনঃনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রথম বিদেশ সফর বাংলাদেশে আসার সম্ভাব্যতা বিবেচনায় চীন প্রস্তাবিত তারিখের সঙ্গে সংযোজন-বিয়োজন হতে পারে। কিন্তু এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে, সরকার প্রধানের বেইজিং সফরটি জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহেই হবে। সফরকালে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় এবং আনুষ্ঠানিক বৈঠক হবে। তাছাড়া চীনের প্রেসিডেন্ট ও স্পিকারের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ হবে।
প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফরকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, চীনের সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্ক আরও গভীর করাই সফরটির লক্ষ্য। সেই সফরকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন।
তাছাড়া তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথাও বলেছেন। রাষ্ট্রদূত আসন্ন সফরকে বহুমাত্রিক সম্পর্কের ‘গেমচেঞ্জার’ হিসেবে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কেবলই সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সফরটি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি। রাষ্ট্রদূত ইয়াও বাংলাদেশের ‘রূপকল্প ২০৪১’ ও ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের আকাক্সক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও সাংস্কৃতিক বিনিময় সম্প্রসারণে এই সফরের তাৎপর্যের ওপর জোর দেন। চলতি মাসে ঢাকায় সেমিনারে আসন্ন সফর বিষয়ে রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, এটি হবে আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর মাধ্যমে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে। কূটনৈতিক সূত্র বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকে সামনে রেখে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত এফওসিতে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় সফরকে কেন্দ্র করে বেইজিং একপ্রস্ত ফর্দ দিয়েছে, যা তাদের অগ্রাধিকার।
এদিকে ওই সফর নিয়ে ইতিমধ্যে ঢাকায় কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। যেখানে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও প্রকল্প সহায়তাসহ চীনের বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে কথা হয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং সাময়িক যে সহায়তাগুলো দরকার তাতে ফোকাসের বিষয়ে একমত হয়েছেন সবাই। দু’পক্ষের মধ্যে আট থেকে ১০টি সমঝোতা স্মারক নিয়ে কাজ হচ্ছে, তবে শেষ পাঁচ থেকে ছয়টি সই হতে পারে জানিয়ে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, তবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে, প্রস্তাবিত সব চুক্তি বা সমঝোতা সই না হলেও এ নিয়ে দুই প্রধানমন্ত্রী যৌথ ঘোষণায় পরবর্তী আলোচনার সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকবে। স্মরণ করা যায়, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের বিশাল অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশকে ৯৮ শতাংশ পণ্যের ওপর শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় চীন। কিন্তু পণ্যের বৈচিত্র্যতা না থাকায় চীনে রপ্তানি তেমন বাড়েনি। গত বছর বাংলাদেশ প্রায় ৭০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে এবং আমদানি হয়েছে ২ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি মূল্যের পণ্য।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ৯৮ শতাংশ পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধার পুনঃপর্যালোচনা দাবি করেছে ঢাকা। সেই সঙ্গে ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলেও চীন যেনো ৯৮ শতাংশ পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা বহাল রাখে সেটাই চায় বাংলাদেশ। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অর্থ-পরিশোধে ভারতের সঙ্গে টাকা-রুপি’র বদলে যে অ্যারেঞ্জমেন্ট আছে, সেটির আদলে টাকা-রেনমিনবি (চীনা মুদ্রা) চালু করার চিন্তাও রয়েছে ঢাকার। চীন থেকে বাজেটারি সাপোর্ট এবং বাণিজ্য সাপোর্ট পেতে আগ্রহী বাংলাদেশ। দেশটির সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সইয়ের বিষয়েও ইতিবাচক ঢাকা। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরের সময়ে নেয়া ২৭টি প্রকল্পের মধ্যে ১৫টি সম্পন্ন হয়েছে, ছয়টির কাজ চলমান আছে এবং বাকি ছয়টির বদলে নতুন প্রকল্প করার চিন্তা রয়েছে বাংলাদেশের। চীনের ঋণ পরিশোধের সময় ২০ বছর থেকে বাড়ানো এবং সুদের হারে বিশ্বের অন্যান্য ঋণের সুদের হারের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা বিধানের দাবি রয়েছে ঢাকার। মিয়ানমারে বিবদমান পক্ষগুলোর ওপর চীনের প্রভাব থাকার বিষয়টি স্বীকার করে ঢাকা বলছে, বাংলাদেশ লাগোয়া আরাকানে যেন নতুন করে যুদ্ধ না হয় এবং সেখানে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা যেনো ফিরতে পারে সেই পরিবেশ নিশ্চিতে বেইজিংকে কাজ করার অব্যাহত অনুরোধ জানাচ্ছে বাংলাদেশ।
manabzamin