- অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম
- ০৮ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:১৯, আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:৫৩
মহাকালে হারিয়ে গেল ২০২২ সাল। সাফল্য-ব্যর্থতা, বিচ্ছেদ, বেদনা, সফলতার সোনালি পালক মোড়া দুঃখ বেদনার আবহ ছড়িয়ে বিদায় নিয়েছে বছরটি। ২০২৩ সালের সূর্য নতুন আলোর রঙধনু ছড়িয়ে অনেক আশা-ভরসা ও সফলতার হাতছানি দিয়ে উদিত হয়েছে। ২০২২ সালের আশাহত বেদনার্ত জনপদ নতুন বছরে স্বপ্ন দেখবে আশা পূরণের, এটিই স্বাভাবিক!
করোনা পরবর্তী সময়ে সামগ্রিকভাবে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা জাতির অদম্য মনোভাবের প্রকাশ। ছড়িয়ে ছিল ২২ সালের পুরো সময়। শিক্ষাঙ্গনগুলো শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর ছিল না বলতে গেলে। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে ততধিক সংক্ষিপ্ত পরীক্ষার আয়োজন ও ফল ঘোষণা ছিল উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ব্যাপারটি অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। তবে প্রশ্ন জেগেছে, কোনো কোনো বিষয়ে সারা বছর কোনো ক্লাস না নিয়ে পরীক্ষা নেয়ায়। পড়ানোর বালাই নেই অথচ পরীক্ষা হলো, পরীক্ষার্থীরা ভালো করল, এটি শিক্ষার্থীদের মন ও মানসে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে তা অবশ্যই ভাববার বিষয়। নৈতিকভাবে শিক্ষার্থীর ওপর এর প্রভাব আশঙ্কার সৃষ্টি করে বৈকি। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পরিবর্তে ব্যস্ত ছিল বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। চর দখলের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব মতের দখলদারি অত্যন্ত কদর্যভাবে জাতি প্রত্যক্ষ করেছে বছরজুড়ে। সাথে জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়েছে কমবেশি সবাই। শিক্ষাঙ্গনে পড়াশোনার মানের ব্যাপারে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে সাবধানবাণী উচ্চারণ করতে হয়েছে। তথ্যমন্ত্রীকে আক্ষেপ করতে হয়েছে।
ব্যাংক খাত বছরে বেশ একটি উল্লেখযোগ্য সময় ধরে জনগণকে আতঙ্কিত রেখেছে। ব্যাংক ব্যবস্থার জনগণের ভরসার জায়গায় একটি বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন তৈরি হয়েছে যা এখনো মোছেনি। অর্থপাচার সারা বছরই জনগণকে হতচকিত ও হতবাক করেছে। রিজার্ভ সঙ্কট মানুষের চিন্তাকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে। শঙ্কার কালোমেঘ ছড়িয়েছে। দ্রব্যমূল্যের উল্লম্ফন জনজীবন তছনছ করেছে গোটা বছর। ওএমএসের ক্রমদীর্ঘমান লাইন ও লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলোর ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত মুখগুলো অসহায়ত্বের মানচিত্র রচনা করেছে পুরো ২২ সাল। শহর ছেড়ে গ্রামের যাত্রায় মানুষের সারি দীর্ঘতর হয়েছে।
জনগণের সেবার জন্য প্রতিষ্ঠান এবং এর সদস্যদের জনগণের ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনা ঘটেছে বারবার। রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা অসহায় জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে ভাষাহীন যন্ত্রণায়। সাগরে মরুভূমিতে এ দেশের তরুণদের ঠিকানা হারানোর খবর প্রচারমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে বারবার। রোহিঙ্গা সমস্যা বারবার ঘুরপাক খেয়েছে; বিভিন্ন সময়ে তাদের প্রত্যাবাসনের প্রতিশ্রুতিগুলো মরীচিকা হয়ে হারিয়ে গেছে।
রাজনীতির মাঠজুড়ে অসহিষ্ণুতাই শুধু নয়, অবলীলায় যেভাবে ভাষার চর্চা হয়েছে তার প্রতিফলন যুবসমাজ অনুসরণ ও অনুকরণ করলে সৃষ্ট পরিস্থিতির কথা ভাবা যায় না। বিভিন্ন নামে অভিহিত নানান কিসিমের বেসরকারি বাহিনীর তাণ্ডব দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে অসহায়ভাবে।
২০২২ সালের ফেলে আসা ক্যানভাসের বিপরীতে প্রত্যাশা শিক্ষাঙ্গনগুলো শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর হোক। সবার হাতে বই উঠুক। সৃষ্টি চেতনার নৈতিকতার পথে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হোক তারুণ্য। শিক্ষাঙ্গনগুলো শিক্ষা আর গবেষণার আধারে পরিণত হোক। মনুষ্যত্ব ও মানবিক মূল্যবোধের চর্চার কেন্দ্রে পরিণত হোক। নৈতিকতার শক্তিতে, অদম্য চারিত্রিক চর্চা বিকশিত হোক। ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা হোক শিক্ষার্থীরা। জাতিকে পথ দেখানোর, নেতৃত্ব দেয়ার, যোগ্য নাগরিক তৈরির কারখানা হোক শিক্ষাঙ্গন। দেশপ্রেম ও সংবিধানে বর্ণিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হোক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। ইতিহাসের সঠিক আলোকে ভবিষ্যৎ রচনার কেন্দ্রবিন্দু হোক এ দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলো। সৎ, দেশপ্রেমিক, সৃষ্টিমুখী জাতি তৈরির মহৎ কাজে অনুপ্রাণিত হোক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।
দেশের যুব মানসে তৈরি হোক আত্মবিশ্বাস, পরোপকার, শ্রদ্ধাবোধ আর পরমতসহিষ্ণুতা। দেশের পথগুলো মুক্ত হোক অসহায় পথশিশুদের দুঃখভরা কাতর চোখের চাহনি থেকে। অর্থনীতি সবল ভিত্তির ওপর স্থিত হোক। থেমে যাক মূল্যস্ফীতির কালো মেঘ। স্বস্তি ফিরে পাক সাধারণ মানুষ। দুর্নীতির অন্ধকার থেকে উঠে আসুক দেশ। সম্পদের সুষম বণ্টনে অন্তত এক ধাপ এগিয়ে যাক বৈষম্য দূরীকরণে। সুবিচারের ব্যাপারে কেউ যেন কোনো অভিযোগের আঙুল তুলতে না পারে এ পরিবেশ সবারই কাম্য।
মানবাধিকার হোক চেতনার আধার। মানবিক চেতনা হোক উচ্চকিত ও বিকশিত। রাজপথের মৃত্যুর মিছিলের অপ্রতিহত গতি রুদ্ধ হোক, বন্ধ হোক সড়কে মৃত্যু আর পঙ্গুত্বের অসহনীয় যন্ত্রণা। বন্ধ হোক সীমান্ত হত্যা। প্রতিবেশীরা বৈরী না হয়ে বন্ধুত্বের গভীর বন্ধনে আবদ্ধ হোক। সমুদ্রের সীমাহীন জলরাশি, মরুভূমির তপ্ত বালিয়াড়িতে কেউ যেন অকালে হারিয়ে না যায় এই প্রত্যাশা। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ এবং নারী ও শিশু পাচারের ঘটনাগুলো যেন আর ফিরে না আসে। আমাদের মায়েরা, বোনেরা, মেয়েরা স্বকীয়তায় নির্ভাবনায় যেন পথ চলতে পারে, নিশ্চিত হোক। পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্র যেন এ বছর সঙ্কুচিত হয়ে ওঠে। আমাদের শিশুরা, বয়স্করা যেন বুক ভরে বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিতে পারে। বিশ্বসভায় আরো উজ্জ্বল হোক দেশের আসন। মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হোক দেশ ও দেশের মানুষ। অভিন্ন জাতিসত্তার চেতনায় সিঞ্চিত ও অনুপ্রাণিত হোক ভবিষ্যৎ। কৃষকরা পণ্যের সঠিক মূল্য পাক, তাদের মুখগুলো ঝলমল হাসিতে ভরে উঠুক। কর্মচাঞ্চল্য তৈরি হোক সব কলকারখানায়। স্পন্দিত হোক সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। শ্রমিকদের যেন ন্যায্য মজুরির দাবিতে রাস্তায় নামতে না হয়।
নতুন বছর হোক নতুন করে পথচলার প্রত্যয়ে দীপ্ত। দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই যেন এ চিন্তায় উজ্জীবিত হয়। পারস্পরিক হানাহানি ক্ষমতার মদমত্ততা ছেড়ে প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব, ব্যবসায়িক গোষ্ঠী, প্রচারমাধ্যম, সামাজিক নেতৃত্ব সবাই যেন দেশ গড়ার, পরিবেশ বাঁচানোর জন্য একাত্ম হয়ে কাজ করে; এটি একটি বিরাট প্রত্যাশা। হতাশা নয় নতুন আশার আলোকচ্ছটায় দেশ ও জাতি সিঞ্চিত হোক নতুন বছরে ইস্পাতকঠিন একতা ও দৃঢ়তায়। মোট কথা, নতুন বছর স্রষ্টা প্রদত্ত কল্যাণের স্মারক হোক। দেশ হোক সাম্য, সুবিচার আর সৌহার্দ্যরে ধারক।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com