- খন্দকার হাসনাত করিম
- ১৫ আগস্ট ২০২৩, ২০:২৫
খন্দকার হাসনাত করিমরক্তশূন্যতায় রোগী যেমন শীর্ণকায় হয়ে পড়ে, দুঃশাসনকালে নাগরিকরা, বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের বিরোধী মতের মানুষগুলো তেমনি নির্যাতন, নিপীড়ন, গুম, হামলা-মামলা প্রভৃতির কারণে নিশ্চুপ বা বাকশক্তিহীন হয়ে পড়ে। নীতির জায়গা নেয় ভীতি। এটিকেই বর্তমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ‘Tyrannophobia’ বলে অভিহিত করে থাকেন। অন্যত্র এই দুঃশাসন বা ভীতির রাজত্বের সাথে আর যে সাধারণ শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে ‘Autocracy’, ‘Authoritarianism’, ‘Coercion’, ‘Rule of Cruelty’; ‘Despotism’, ‘Oligarchy’, ‘Terrorism’ ’ কিংবা ‘Totalitarianism’ আর এগুলো সবই কর্তৃত্ববাদী ফ্যাসিবাদের প্রতিশব্দ। সবগুলোরই মূল অর্থ- ভীতির শাসন বা Rule of Terror. মনোবিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যায়, দুঃশাসনের এই মানসিক ভীতির পেছনে রয়েছে ‘Fear from the oppressive government rulers or political rulers who are prone to silence the Opposition voice using the state machinery and this is classified as a specific phobia under anxiety disorder.’ বাংলাদেশে এখনকার এই নাগরিক অস্থিরতা, উৎকণ্ঠা, বিশেষ করে, বিপুল প্রতিবাদী মানুষের ভীতির প্রধান কারণ হলো শাসকদের বৈধতার সঙ্কট। কোটি কোটি মানুষ জানে, তারা বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সমর্থন করে না এবং তারা এদেরকে ভোট দিয়েও জেতায়নি। কার্যত মানুষ স্বচক্ষে দেখেছেন, ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তারা ভোট দিতে পারেননি। কিংবা ভীতিকর পরিস্থিতির আশঙ্কায় ভোট দেননি। এই যে অবিশ্বাস্য শতকিয়া মাত্রায় ভোট পড়ার দাবি করা হয়েছে, এর সাথে সত্যের সামান্যতম সংশ্লিষ্টতা নেই।
এ কথা বলা যাবে না যে, বর্তমান শাসক মহলের দ্বারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়নি। বহু ভারী প্রকল্প হয়েছে এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে, এটিও সত্য। তবে শাসনের বৈধতা না থাকলে উন্নয়নের বন্যা ভাসিয়ে দিলেও কোনো লাভ হয় না। উন্নয়নই বৈধতার মাপকাঠি হলে আইয়ুব খান, এরশাদ, পার্ক চুং হি, ইদি আমিন, জেনারেল ফ্রাংকো, সাদ্দাম হোসেন, হাইলে মরিয়াম, অগাস্তো পিনোশে’ কিংবা খুনি পলপটকে অপমানের সাথে বিদায় নিতে হতো না। উন্নতি এমনকি যুদ্ধজয় কোনোটিই অবৈধ শাসনের ঘাটতি পূরণ করার জন্য যথেষ্ট নয়। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ রেখে গেছে জাতিগত মূলোৎপাটনের প্রবক্তা অ্যাডলফ হিটলার। প্যারাগুয়ের একনায়ক সোলানা লোপেজ, স্লোভাকিয়ার জোসেফ টিসো, হাঙ্গেরির দোম তোজায় (Dome Sztojay), মঙ্গোলিয়ার খরলোগিন চইবালসান, আলবেনিয়ার এনভার হোক্সা (Hoxha), রুমানিয়ার নিকোলাই চসেস্কু, ভিয়েতনামের লি দুয়ান, রোড়েশিয়ার আয়ান স্মিথ, ডমিনিকান প্রজাতন্ত্রের রামাফিজ ক্রুজিলো, বুরুন্ডির মিকামবারো, আর্জেন্টিনার রাফায়েল ভিদেলা, গিনির ফ্রান্সিসকো গুয়েমা, সোমালিয়ার সাঈদ বারি কিংবা স্লোভাকিয়ার রাদোভান কারাদজিক- এরা ভোটে বা গায়ের জোরে কিংবা ভোটের নামে অনিয়ম করে যে যেভাবেই ক্ষমতায় আসুক না কেন, ক্ষমতা কুক্ষিগত করে একেকজন নিষ্ঠুর দুঃশাসকে পরিণত হন। এদের সবার দেশেই বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজকে পড়তে হতো ভীতির রাজত্বে। কথা বললেই গুম, লিখলেই নিখোঁজ কিংবা ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে বছরের পর বছর জেলের ঘানি টানতে হয়েছে বা স্টালিন জামানার মতো সাইবেরিয়ার বরফ-কারায় জীবন-যৌবন সব বিসর্জন দিতে হয়েছে।
রাষ্ট্রশক্তির কাছে ব্যক্তি মানুষ এমনকি সংগঠিত সমাজও অসহায়। স্বৈরতন্ত্রে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার হরণ হয়ে যায়। যেসব বাহিনী বিরোধী মত দমনের জন্য বেশি বেপরোয়া হয়ে যায়, তাদের সম্পর্কে অসহায় বোবা নাগরিকের যে আতঙ্ক বা ভীতির ত্রাস সৃষ্টি হয় মনোবিজ্ঞানে তাকে বলে Bogyphobia. প্রতিবাদী ভূমিকার জন্য গুম বা ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়ার যে ভীতি, তাকে বলে Thanaphobia, বা Taphophobia. চূড়ান্ত ব্যাখ্যায়, এগুলো সবই মানসিক ভীতি (Psychophobia). বিরোধী মতের মানুষকে এই মনোভীতিতে ভীত করে তোলা দুঃশাসকদের একটি আপাত বিজয় বলে তারা মনে করে। কিন্তু প্রতিবাদের গণজোয়ার যখন বাঁধভাঙা হয়ে ছুটতে শুরু করে তখন এতকাল যা ছিল ভীতি, সেটিই হিংসার হিংস্রতা নিয়ে গর্জে ওঠে। মনোবিজ্ঞান এটিই বলে। মানুষের মনে প্রতিবাদকে প্রতিহিংসায় রূপান্তর করার মধ্যে দেশের অকল্যাণ ও সর্বনাশ ছাড়া মঙ্গলের কিছু নেই।
গণতন্ত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের (Permanent Settlement) কোনো সুযোগই নেই। এখন যা চলছে তা মানুষের অধিকারের প্রতি সম্পূর্ণ অন্যায়। এর একটি স্থায়ী রফা বা সামাজিক চুক্তি হওয়া দরকার। সব পক্ষকেই কিছু পেতে হলে কিছু দিতেও হবে বা ছাড় দিতে হবে। সংসার যেমন চালাতে হয় ছাড় দিয়ে, সমঝোতা করে, তেমনি গণতন্ত্র ও উন্নয়নকেও ধরে রাখতে হয় রাষ্ট্রনায়কের দূরদৃষ্টি এবং প্রজ্ঞা দিয়ে। দলকানা হলেই বিপদ। দল তো থাকবেই, তবে দলসর্বস্ব হওয়া থেকে বিরত থাকতেই হবে। এখানেই শুভবুদ্ধি ও দেশপ্রেমের পরিচয়। অন্যথায় সাংসারিক কলহের সুযোগ নিয়ে অপশক্তি ঘরে ঢুকে পড়বে; তখন আম-ছালা সবই খোয়াতে হবে।
রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে সমঝোতাবিষয়ক একটি সা¤প্রতিক গবেষণা গ্রন্থে লেখক-জুটি হেইডি হলবার্গ ও পল টি হার্ট গ্রন্থটির উপসংহারে বড় চমৎকার করে বলেছেন : “We should consider systematic comparative studies of crisis management in the world of politics or in the corporate world. By thus identifying and explaining similarities, as well governance context, crisis response challenges, leadership behaviors and communicative practices will, we believe, enhance the understanding of (political) crisis communication in both spheres.’ (Communicating and managing crisis in the world of politics/A Handbook of Communication Science, Berlin, 2020)