Site icon The Bangladesh Chronicle

প্রকৃত রিজার্ভ নামছে ২৩ বিলিয়নের ঘরে

 

জিয়াদুল ইসলাম
১৮ জুন ২০২৩

আগামী জুলাই মাস থেকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হিসাবায়নে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পদ্ধতি অনুসরণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই পদ্ধতিতে বেশ কয়েকটি তহবিলের অর্থ বাদ দিয়ে হিসাবায়নে গেলে দেশের প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ ২৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসবে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাটির পক্ষ থেকে জুনের মধ্যে নিট রিজার্ভ রাখার যে ফ্লোর দেওয়া হয়েছিল সেটিও অর্জন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। নতুন ঋণ না পেলে এই লক্ষ্য অর্জন হবে না।

আজ রবিবার আগামী অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের মুদ্রাানীতি ঘোষণা করবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। নতুন মুদ্রানীতিতে তিনি আইএমএফের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম-৬) ম্যানুয়াল অনুসারে রিজার্ভ হিসাবায়নের ঘোষণা দেবেন। আগামী ১ জুলাই থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব বিবরণী ও প্রকাশনায় রিজার্ভের নতুন হিসাবায়ন দেখানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।

রিজার্ভ হিসাবায়নে আইএমএফের পদ্ধতিই যথাযথ বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘অন্য দেশগুলো অনেক আগে থেকেই এ পদ্ধতি অনুসরণ করে রিজার্ভের হিসাবায়ন করে আসছে। এটাই আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পদ্ধতি। ফলে এ সংশোধনটি দরকার ছিল। এর মাধ্যমে সবাই রিজার্ভের প্রকৃত চিত্র জানতে পারবে।

জানা যায়, রিজার্ভের অর্থে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ), গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ) ও লং টার্ম ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি (এলটিএফএফ) শীর্ষক তহবিল গঠন করা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনে (আইটিএফসি) আমানত হিসেবেও রাখা হয়েছে রিজার্ভের অর্থ। এ ছাড়া রিজার্ভ থেকে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে (এসবিএফএফ) পায়রাবন্দর কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ বিমানকে অর্থায়ন করা হয়েছে। এর বাইরে কারেন্সি সোয়াপের আওতায় শ্রীলংকাকে দেওয়া হয়েছে ঋণ।

গত ১১ মে পর্যন্ত হিসাবে এসব জায়গায় রিজার্ভ থেকে খাটানো অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ৬০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ইডিএফে ৪৭৮ কোটি ৭৬ লাখ, জিটিএফে ১৭ কোটি ৬৮ লাখ ডলার, এলটিএফএফে ২৭ কোটি ৩৭ লাখ, আইটিএফসিতে আমানত ২৪ কোটি ৭৪ লাখ ডলার, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে পায়রাবন্দর কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ বিমানকে ৭৭ কোটি ৫৭ লাখ এবং শ্রীলংকাকে দেওয়া ঋণ ২০ কোটি ডলার।

আইএমএফের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম-৬) ম্যানুয়াল অনুযায়ী, এসব দায় রিজার্ভ হিসেবে বিবেচিত হবে না। সংস্থাটির ভাষায় এগুলো নন-লিকুইড সম্পদ বা ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড সিকিউরিটিজ। তাই রিজার্ভ থেকে এসব অর্থ বাদ দিয়ে প্রকৃত রিজার্ভ দেখানোর পরামর্শ দিয়ে আসছে আইএমএফ। বাংলাদেশকে দেওয়া ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ সহায়তার অন্যতম শর্তই রয়েছে বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী রিজার্ভের হিসাবায়ন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, এরই মধ্যে আইএমএফের ম্যানুয়াল মেনে রিজার্ভ হিসাবায়ন শুরু করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সেটি আনুষ্ঠানিকভাবে দেখানো হবে ১ জুলাই থেকে, যা আজ রবিবার নতুন মুদ্রানীতিতে ঘোষণা দেবেন গভর্নর। এখন চলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব বিবরণী ও প্রকাশনায় বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুসারে রিজার্ভের হিসাব দেখানোর কাজ।

সূত্রগুলো বলছে, ২০২১ সালের ৩-১৪ অক্টোবর বাংলাদেশ পরিদর্শনের ভিত্তিতে আইএমএফের প্রেরিত সেফগার্ড অ্যাসেসম্যান্ট রিপোর্টে রিজার্ভের অর্থে গঠিত তহবিল ও ঋণের দায় বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। সে সময় এসব দায়ের পরিমাণ ছিল আরও বেশি, প্রায় ৭১৬ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। তবে নিট রিজার্ভ বাড়ানোর অংশ হিসেবে জিটিএফ থেকে নতুন ঋণ বিতরণ পুরোপুরি বন্ধ ও ইডিএফ তহবিলের আকার ক্রমান্বয়ে ছোট করে আনায় বর্তমানে এই দায়ের পরিমাণ ৬০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি নেমে এসেছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র। অন্যদিকে গত ১৪ জুন শেষে দেশে মোট রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার। তবে দেরিতে হলেও সংস্থাটির ২০২১ সালের সেই সুপারিশ অনুযায়ী রিজার্ভ হিসাবায়নে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

জানা গেছে, আইএমএফের পদ্ধতিতে রিজার্ভ চূড়ান্তকরণের বিষয়ে গত ৬ জুন অনুমোদন প্রদান করেন গভর্নর। একই সঙ্গে রিজার্ভ হিসাবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব বিবরণী, লেখনী, আউটপুট ও প্রকাশনায় এ বিষয়ে সংশোধনী আনয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা প্রদান করেন তিনি। গভর্নরের নির্দেশনার আলোকে গত ১৩ জুন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আইএমএফের পদ্ধতিতে রিজার্ভ হিসাবায়ন প্রক্রিয়া চূড়ান্তকরণবিষয়ক এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন ডেপুটি গভর্নর একেএম সাজেদুর রহমান। ওই সভায় রিজার্ভ হিসাবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের সব বিভাগের স্টেটমেন্ট, লেখনী, আউটপুট ও প্রকাশনায় প্রয়োজনীয় সংশোধন আনার সিদ্ধান্ত হয়।

এদিকে আগামী জুনের মধ্যে বাংলাদেশের প্রকৃত রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার শর্ত রয়েছে সংস্থাটির। বর্তমানে যে রিজার্ভ রয়েছে, সেটি এই ফ্লোরের নিচে। ফলে বিদেশি অন্য কোনো দাতা সংস্থা থেকে শিগগিরই নতুন ঋণের ছাড় না হলে রিজার্ভ রাখার এই শর্তও পূরণ হবে না বাংলাদেশের। এর আগে গত মার্চে সর্বনিম্ন ২২ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার নিট রিজার্ভ রাখার শর্তও পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। এ ছাড়া আগামী সেপ্টেম্বরে নিট রিজার্ভের পরিমাণ বাড়িয়ে ২৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার এবং ডিসেম্বরে ২৬ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছে আইএমএফ। সংশ্লিষ্টরা জানান, জুনে যদি শর্তপূরণে ব্যর্থও হয়, তবে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে ন্যূনতম রিজার্ভ রাখার শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হবে, তা না হলে সংস্থাটির অনুমোদিত ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পেতে সমস্যায় পড়তে হবে বাংলাদেশকে।

 

Exit mobile version