সম্প্রতি পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে বাজারে চলছে অস্থিরতা। কেজিপ্রতি হঠাৎ ৩০ থেকে ৪০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে দাম ১১০ টাকা ছাড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মধ্যস্বত্বভোগীদের সরাসরি কারসাজির তথ্য জানার পরও পেঁয়াজের দাম কমাতে আমদানির হঁশিয়ারি দিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
অন্যদিকে, আমদানির অনুমতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য সচিব ও কৃষি সচিবকে পাঠানো চিঠিতে বিটিটিসি জানায়, বাজারে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১১০ টাকা ছাড়িয়েছে। তাই সরবরাহ বাড়াতে আমদানির অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। যদিও ট্যারিফ কমিশন বলছে, বাজারে পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির পেছনে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি সরাসরি দায়ী।
এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, দেশে এখন পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। অন্তত ৭৫ হাজার টন নতুন দেশি পেঁয়াজ চলতি মাসেই বাজারে আসছে। আমদানিকারকদের একটি অংশ আমদানির অনুমতি না পেয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এ মুহূর্তে আমদানির অনুমতি দিলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাদের দাবি, চলতি মাসে নতুন দেশি পেঁয়াজ বাজারে আসছে। তাই এখনই আমদানির অনুমতি দিলে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবেন না, যা দীর্ঘ মেয়াদে উৎপাদনে অনীহা সৃষ্টি করবে। বর্তমানে যথেষ্ট পরিমাণ পেঁয়াজ মজুত আছে এবং দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে তদারকি কার্যক্রম চলছে।
গতকাল রোববার বিকালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে পেঁয়াজের বর্তমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফকালে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, দেশে পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হয়েছে। কোনো সংকট নেই। পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য সরকার ১০ হাজার হাই ফ্লো মেশিনও সরবরাহ করেছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসবে। ফলে বাজার স্বাভাবিক না হলে আমরা আমদানির অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেব।
তিনি বলেন, পেঁয়াজ আমদানির জন্য দুই হাজার ৮০০ আমদানির আবেদন পড়েছে এর ১০ শতাংশ যদি অনুমোদন দেওয়া হয় তাহলে বাজারে পেঁয়াজে সয়লাব হয়ে যাবে। কৃষক ক্ষতির মুখে পড়বেন। এজন্য আমরা সামগ্রিক বিবেচনায় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।
পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি মজুতদার বা সিন্ডিকেটের কারণে হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, আমার কাছে মজুতদারি বা সিন্ডিকেটের খবর নেই। সাময়িক সংকট তৈরি হয়েছে। আশাকরি দ্রুত সংকট কেটে যাবে। তিনি আরো বলেন, সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশে রপ্তানির জন্য পেঁয়াজ মজুত করা হচ্ছে বলে আমাদের কাছে খবর রয়েছে।
ট্যারিফ কমিশনের আমদানির সুপারিশ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পেঁয়াজের উচ্চমূল্যের সুবিধা সরাসরি কৃষকের কাছে পৌঁছাচ্ছে না, বরং মধ্যস্বত্বভোগীরা এ সুযোগ নিচ্ছেন। আমদানির সুযোগ দিলে বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমে যাবে এবং ভোক্তারা যৌক্তিক মূল্যে পেঁয়াজ কিনতে পারবেন।
ট্যারিফ কমিশন সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি দেশে পেঁয়াজের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় দেশে পেঁয়াজের চাহিদা, উৎপাদন, স্থানীয় বাজারমূল্য, আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য, বিদ্যমান আমদানি শুল্কসহ সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছে।
সরকারি সংস্থা টিসিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে ট্যারিফ কমিশন বলছে, ২০২৩ সালের মার্চে পেঁয়াজের মূল্য গড়ে কেজিপ্রতি ৩৩ টাকা ছিল, যা নভেম্বরে দাঁড়ায় ১১৫ টাকায়। অর্থাৎ, মার্চের তুলনায় নভেম্বরে দাম বাড়ে ২৪৮ শতাংশ। ২০২৪ সালের এপ্রিলে গড় মূল্য ছিল ৬৩ টাকা, যা নভেম্বরে বেড়ে হয় ১৩০ টাকা। সেই হিসাবে এপ্রিলের তুলনায় নভেম্বরে দাম বেড়েছে ১০৬ শতাংশ। চলতি বছরের মার্চে সর্বনিম্ন দর ছিল ৪২ টাকা, যা নভেম্বরে ১৫০ শতাংশ বেড়ে হয় ১০৫ টাকা। পর্যালোচনায় দেখা যায়, পেঁয়াজের দাম মার্চ-এপ্রিলের তুলনায় নভেম্বরে ১০০ শতাংশের বেশি বেড়ে গেছে। এ ধরনের সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান প্রয়োজন। এ বছরও মুড়িকাটা পেঁয়াজের রোপণ সময় বিলম্বিত হওয়ায় তা উৎপাদন মৌসুমেও বিলম্বিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কমিশন বলে, গত দুই-তিন মাসে পেঁয়াজের মূল্য স্থিতিশীল থাকলেও গত এক সপ্তাহে দাম বেড়েছে ৩৭ থেকে ৪২ শতাংশ। প্রতি বছর অক্টোবর-ডিসেম্বরে দাম বাড়ার প্রবণতা থাকলেও গত সপ্তাহে দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে, যা বাজার ব্যবস্থাপনা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজির সরাসরি ইঙ্গিত দেয়।
ট্যারিফ কমিশন মতে, পার্শ্ববর্তী দেশে পেঁয়াজের দাম এখন কেজিতে প্রায় ১৬ টাকা, অর্থাৎ টনে ১৯৫ ডলার। সেই হিসাবে ১০ শতাংশ শুল্ককর বহাল রেখেও পেঁয়াজ আমদানি করা গেলে দেশে কেজিপ্রতি ৫০ টাকার কম দামে বিক্রি করা সম্ভব।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, অক্টোবর পর্যন্ত বাজারে দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ থাকলেও, এখন তা কমে গেছে। ফলে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। কারণ এ বছর পেঁয়াজের আমদানি খুব বেশি হয়নি। দেশি পেঁয়াজের ওপর বাজার নির্ভর ছিল।
নভেম্বরে দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকতে পারে উল্লেখ করে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হলে দাম কমবে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। পেঁয়াজ আমদানি করা গেলে দেশে কেজিপ্রতি ৫০ টাকার কম দামে বিক্রি করা সম্ভব। বর্তমানে পেঁয়াজের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক প্রযোজ্য।
বাংলাদেশের পেঁয়াজ আমদানি প্রধানত ভারত থেকে হয়। এছাড়া তুরস্ক, পাকিস্তান, মিয়ানমার, চীন ও মিসর থেকেও পেঁয়াজ আসে। গত অর্থবছরে মোট চার লাখ ৮৩ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে।

