- জসিম উদ্দিন
- ৩০ নভেম্বর ২০২২
বিরোধী দলের আন্দোলন কর্মসূচির জোয়ারের মধ্যে সংবাদপত্রে আরো কয়েকটি খবর নজর কেড়েছে। এগুলো এক কলাম, দুই কলাম কিংবা খুব ছোট জায়গা পেলেও সরকার পরিচালনার বৈষম্যপূর্ণ নীতিকে উৎকটভাবে প্রকাশ করেছে। এক দিকে সরকারি কোষাগারের দরজা খুলে লুটপাট করা হচ্ছে- অন্য দিকে পেশিশক্তি ব্যবহার করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অর্থকড়িও লুটে নেয়ার সহজ সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। সমাজের একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সামান্য কয় পয়সা ঋণ দিয়ে তাদের আবার খেলাপি দেখিয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে। রাষ্ট্র্র নিজে থেকে এই নিপীড়নের দায়িত্ব নিয়েছে। সব নিয়ম-কানুনকে এমনভাবে সাজিয়েছে, এখানে সরকারের কাছের লোকেরা গাছেরটাও খাবে, তলারটাও কুড়াবে। দুর্বল খেটে খাওয়াদের জন্য জীবন বাঁচানোর সামান্য সুযোগও বন্ধ করে দেয়া হবে।
এই রাঘাববোয়ালদের লুটপাটে বাধা দেয়ার কোনো চেষ্টা সরকারের তিন মেয়াদে দেখা যায়নি। বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কেউ কিংবা কিছু প্রতিষ্ঠান অবস্থার বলি হওয়া ছাড়া সরকারঘনিষ্ঠ একজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ জন্য সাজা পাননি। লুটে নেয়া অর্থ কোনো সরকারি কোষাগারে ফেরানো হয়নি। অর্থনীতি যখন একেবারে খাদের কিনারে নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে, এবার হয়তো লুটপাটকারীরা জাতিকে কিছুটা করুণা করবে; অন্যায়ভাবে অর্থ হাতিয়ে নেয়া থেকে বিরত হবে; কিংবা সরকারও কিছুটা এবার এদিকে নজর দেবে; দুর্নীতিবাজদের তহবিল তছরুপ থেকে বিরত রাখবে। আবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে যে সংস্কার প্রস্তাব রয়েছে তার স্বার্থে অন্তত কিছুটা সতর্ক হবে। দেখা গেল, শেষ মুহূর্তে ব্যাংক থেকে আরো বেশি হারে অর্থ বের করে নেয়া হয়েছে। একটি পত্রিকার খবর মতে, বিগত মাস ‘ভয়ঙ্কর নভেম্বর’। এ মাসে তিনটি ব্যাংক থেকে ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ হিসেবে বের হয়ে গেছে। এখানে একটি বিশেষ লক্ষণ ‘হরিলুটের’ সম্পর্ক রয়েছে। সময় শেষ হলে সেটি আর পাওয়া যাবে না, এ ধরনের একটি চিন্তা থেকে যা পারছে হাতিয়ে নিচ্ছে লুটেরা শ্রেণী। এ দান শেষ দান, যা পারো হাপুশ হুপুশ খেয়ে নাও।
বিস্ময়কর বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়া ব্যক্তিদের সম্ভবত ঋণখেলাপিও বলা যাবে না। কারণ খেলাপি ঋণ ফেরত পাওয়ার বড় ধরনের গ্যারান্টি ক্লজ থাকে। কিস্তি পরিশোধে সময় মতো ব্যর্থ হলেও একটা সময়ের মধ্যে সে তা পরিশোধের ক্ষমতা রাখে; কিন্তু এবার যেভাবে ব্যাংকের ভল্ট থেকে অর্থ বেরিয়ে গেছে তা ফেরত পাওয়ার গ্যারান্টি সম্ভবত ৯০ শতাংশ- তারও বেশি ক্ষেত্রে নেই। কারণ এসব ঋণের বিপরীতে স্থাবর-অস্থাবর কিংবা কোনো সম্পদ বন্ধক রাখা হয়নি। এমনকি বেশির ভাগ গ্রহীতার কোনো সলিড ঠিকানা নেই। ঋণগ্রহীতাকে নামে কেউ চিনে না। তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। বহু প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্বই নেই। ঋণের নামে কত টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে সেটিও জানার সুযোগ ছিল না মানুষের। সংবাদমাধ্যম এ ধরনের খবর প্রকাশ করতে ভয় পায়। সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ লোকদের নাম প্রকাশ হয়ে গেলে সংবাদ প্রতিষ্ঠান বিপদ পড়বে। তাই সবাই চুপচাপ। সাহস করে কেউ এ চেষ্টা চালিয়েছেন তাও দেখা যায়নি। যারা কিছুটা ফাঁস করতে চেয়েছিলেন, তারা দেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তবে হাতিয়ে নেয়া অর্থের অঙ্কটি বিভিন্ন সূত্র থেকে এখন প্রকাশ পাচ্ছে। এই সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। সরকারের হিসাবে এখন এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। ১০ বছরের ব্যবধানে এটি ছয় গুণের বেশি বেড়েছে। আইএমএফের হিসাবে তা তিন লাখ কোটি টাকা। একজন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক অন্যদের রেফারেন্স দিয়ে বলছেন, তা অন্ততপক্ষে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা হবে।
সরকারের কাজ হচ্ছে, তদারকি সংস্থা ঠিকভাবে কাজ না করলে সেগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যাতে সরকারি কোষাগার কিংবা জনগণের গচ্ছিত অর্থ তছরুপ হয়ে না যায়। একজন পি কে হালদারের মামলা যদি আমরা একটু খতিয়ে দেখি তাহলে আমরা দেখতে পাব- সরকারের কাজটি ছিল ঠিক তার উল্টো। রেগুলেটরি বডিগুলো অকার্যকর হওয়ার জন্য যা যা করা দরকার তাই করা হয়েছে। ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা নিয়ে কিভাবে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়া যাবে সে জন্য কোথায় কোথায় কিভাবে সহযোগিতা করতে হবে, কাভার দিতে হবে- তার সবটাই যেন সরকার করেছে। হালদার সাহেব স্থলপথে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে গেছেন। তার পালানো সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার পরই তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিধিনিষেধ কার্যকর করতে এগিয়ে এলো আমাদের তদারকি সংস্থা, আদালত, গোয়েন্দা সংস্থাসহ সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। প্রায় এক দশক ধরে তিনি যখন প্রকাশ্যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে কাবু করে চুরি করেছিলেন কেউ কোনো আওয়াজ করেনি। এ ধরনের কত হালদার দেদার টাকা নিয়ে সন্তর্পণে দেশ থেকে ভেগে গেছে, তার হিসাব নেই। তবে দেশেও রয়েছে অনেকে এখনো শির উঁচু করে। তারাই আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।
অথচ এই দেশে সামান্য ক’টি টাকার জন্য দরিদ্র কৃষককে বন্দী করা হয়েছে। পত্রিকার খবর মতে, ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ পরিশোধ না করায় পাবনার ১২ কৃষককে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। একই অভিযোগে ওই এলাকার আরো ২৫টি কৃষক পরিবার যেকোনো সময় ধরে নিয়ে যাওয়ার আতঙ্কের মধ্যে আছে। এরা ঋণখেলাপি নন। তাদের অনেকে ঋণ পরিশোধ করেছেন। সামান্য কিছু বাকি রয়েছে। মূল সমস্যাটি হলো ঋণের সুদ নিয়ে। ব্যাংকের দাবি- মূল টাকার সাথে ১৫ শতাংশ সুদও পরিশোধ করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে আটকাদেশ জারি করতে বিলম্ব হয়নি। তা তামিল করার জন্য পুলিশেরও কোনো জড়তা নেই। ব্যাংক কর্তৃপক্ষও এ নিয়ে একপায়ে খাড়া। কোনো ছাড় নেই। এই হচ্ছে আমাদের দেশের সরকারের নৈতিক অবস্থান। এরা আমাদের দেশের পুঁটিরা যাদের ধরা হচ্ছে গুরুতর কোনো অপরাধ ছাড়াই।
এরা এমনই দরিদ্র আর অসহায় শ্রেণীর, যারা থানা পুলিশ ও আদালতের নাগাল পাওয়ার ক্ষমতা রাখেন না। এ সঙ্কট কিভাবে মোকাবেলা করতে হবে; তাও তাদের জানা নেই। ওই কৃষকরা মোট ১৬ লাখ টাকা নিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্ন- ভয়ঙ্কর নভেম্বরে যারা ৯ হাজার কোটি টাকা উঠিয়ে নিয়েছে তাদের ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা ও মালিকানা- এগুলো যাচাই করা হয়েছিল কি? প্রকাশিত বিবরণে এটিও বোঝা গেল- ভিন্ন ভিন্ন নামে ঋণ নেয়া হলেও পুরো ঋণই এক ব্যক্তি নিয়ে থাকতে পারেন এর আড়ালে। তারপরও সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, গোয়েন্দা সংস্থা কারো কোনো নড়াচড়া নেই। সবাই শীত নিদ্রায় রয়েছে। এরা আমাদের দেশের বোয়ালেরা। সরকারি কোষাগারের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার জন্য সবাই মিলে তাদের পথ মসৃণ করে দিচ্ছে। কোনো আইনকানুন প্রযোজ্য তাদের জন্য হচ্ছে না।
কৃষকের জন্য এক টাকাও মাফ নেই। দুষ্কৃতিকারীদের জন্য সদর দরজা খুলে দেয়া হয়েছে। যে সময়ে ঋণের নামে মহালুটপাট হয়েছে ওই সময়ে এ দেশে অতি সামান্য একটি শ্রেণী ধনী হয়ে গেছে। সে কারণে আমরা অতি ধনী বৃদ্ধির তালিকায় বিশ্বে প্রথম স্থান ও ধনী বৃদ্ধির তালিকায় তৃতীয় হয়েছি। একই সময় মুদ্রাপাচারেও আমরা বিশ্বের একেবারে প্রথম কাতারে।
এ ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের হিসাব পাওয়া যাচ্ছে। কারো হিসাবে সেটি ৭০ হাজার কোটি টাকা বার্ষিক। এক বছর দেখা গিয়েছিল, সর্বোচ্চ এক লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান থেকে এসব খবর জানা যাচ্ছে। টাকার অঙ্কে কিছুটা হেরফের আছে; কিন্তু এসব লুটপাট যে বাস্তবে হয়েছে সেটি নিশ্চিত করে বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পারছে অর্থনৈতিক চরম দুরবস্থার মধ্যে পড়ে।
মুদ্রাপাচার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুট হওয়ার ধারবাহিকতায় নব্য ধনিক শ্রেণীর উত্থান ঘটলেও এ দুটোর মাঝে কোনো গভীর সম্পর্ক রয়েছে কি না তা নিয়ে দেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদরা কোনো ধরনের গবেষণাই করেননি। এ দেশে রয়েছে বহু থিংকট্যাংক, তারাও এ ব্যাপারে কোনো ধরনের আগ্রহ বোধ করেননি। সবাই মিলে অন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুর্নীতিবাজ চক্র উৎসাহিত হয়েছে; তাদের অপকর্মকে বেগবান করেছে। তবে এ দেশের সুশীল গোষ্ঠীর প্রতি দরিদ্র মানুষের এই অভিযোগ থেকেই যাবে- কেন তারা গুরুতর অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা সামনে আনেননি?
বাংলাদেশে উঁচুহারে দুর্নীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ কিছু সঙ্কেত দিয়ে গেছে। যেমন তারা সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার সুযোগে অনেকটাই উদোম করে আমাদের আর্থিক অব্যবস্থাপনার চিত্রটি দেখিয়ে দিয়েছে। তারা যে সংস্কার প্রস্তাব রেখেছে, তাতে আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সমবায় ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টারে যে অরাজকতা চলছে, তা স্পষ্ট করা হয়েছে। জনসাধারণের গচ্ছিত অর্থ হাতিয়ে নেয়া ছাড়াও আরো কিভাবে একটি শ্রেণী বিপুল লুটপাটের সুযোগ পেয়েছে এই সরকারের সময়ে, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ দেশের অবকাঠামো খাত। এই সরকারের পুরো মেয়াদজুড়ে এ খাতে বড় বড় প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এগুলোতে প্রথমে বাড়তি ব্যয় ধরা হয়েছে। তারপর নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না করে সেই ব্যয় আবার বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পের কোনো ধরনের কাজ না করে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
সড়ক নির্মাণে কিভাবে লুটপাট করা হয়েছে একটি উদাহরণ দিলে সহজে বোঝা যাবে। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা-মাওয়া চার লেনবিশিষ্ট সড়ক নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি এক কোটি ১৯ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে। ভারতে চার লেনের এক কিলোমিটার রাস্তা তৈরিতে (জমি অধিগ্রহণসহ) খরচ হয় ১১ থেকে ১৩ লাখ ডলার। চীনে এটি আরেকটু বেশি; ১৩ থেকে ১৬ লাখ ডলার। ইউরোপের দেশগুলোতে খরচ হয় ৩৫ লাখ ডলার। একটি সড়ক নির্মাণে আমাদের হুবহু ভারতের মতো ব্যয় হওয়ার কথা। চীনে কিছুটা বেশি হওয়ার কারণে তাদের শ্রমিক, উপকরণ ও জমির দাম বেশি। একই কারণে ইউরোপে সেটা বেশ খানিকটা বেশি। দেখা যাচ্ছে, আমরা সড়ক নির্মাণে ইউরোপের চেয়ে প্রায় চারগুণ বেশি অর্থ ব্যয় করেছি। উন্নয়ন বলতে সরকার অবকাঠামো উন্নয়ন বোঝাতে চায়। তিন মেয়াদে এ ধরনের মেগা প্রকল্পের ছড়াছড়ি। বিদ্যুতের কুইক রেন্টাল নিয়ে ‘কুইক দুর্নীতির’ বিষয়টি প্রবাদে পরিণত হয়েছে। একইভাবে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে পর্দা-বালিশকাণ্ড দেখেছি। খবর এসেছে- এ প্রকল্পটি ভারতে নির্মিত একই ধরনের কেন্দ্রের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি খরচে করা হচ্ছে। এই বাড়তি ব্যয় কার পকেটে গেছে? মুদ্রা পাচারের লাখ কোটি টাকা কোথা থেকে এসেছে আঁচ করতে অসুবিধা হয় না।
এটিকে উন্নয়নের একটি অনন্য রোল মডেল বলতে হবে। কারণ এমন মডেল বিশ্ব ইতিহাসে আর কোথাও দেখা যায়নি। কেউ ধারণাও করতে পারেনি। এখানে গরিব কৃষককে বলতে হবে পুঁটি। অপরাধ না করেও তারা বজ্রকঠিন আইনের গ্যাঁড়াকলে পড়ছে। ১০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হালদারেরা বোয়াল। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রযন্ত্র কোনো আইন প্রয়োগ করছে না। বরং দেশের সম্পদ লুটের পর তাদের পালিয়ে যাওয়ার জন্য খুলে দেয়া হচ্ছে দরজা।
jjshim146@yahoo.com