Site icon The Bangladesh Chronicle

পায়রা: গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ পরিকল্পনা যেসব কারণে বাতিল হলো

Maersk's Triple-E giant container ship Maersk Majestic, one of the world's largest container ships, seen at the Yangshan Deep Water Port, part of the Shanghai Free Trade Zone, in Shanghai, China September 24, 2016. Picture taken September 24, 2016. REUTERS/Aly Song

  • রাকিব হাসনাত
  • বিবিসি বাংলা, ঢাকা
ছবির ক্যাপশান, বাংলাদেশে বহু বছর ধরেই গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে নানা উদ্যোগের চেষ্টা হচ্ছিলো

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় উপকূল থেকে প্রায় সত্তর কিলোমিটার দূরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে সরকার।

কর্মকর্তারা বলছেন আর্থিক দিক থেকে লাভবান না হওয়া এবং রক্ষণাবেক্ষণে মাত্রাতিরিক্ত খরচের সম্ভাবনা ছাড়াও মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত হওয়ায় পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের চিন্তা সরকার বাদ দিচ্ছে।

নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে। তাছাড়া পায়রা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা নানা বিশ্লেষণ করেছেন। যেটুকু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য প্রায় সত্তর কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল ঠিক রাখা চ্যালেঞ্জের বিষয়। তাছাড়া স্টাডিতে দেখা যাচ্ছে জায়গাটি ঠিক বন্দরের জন্য যথাযথ নয়। এসব নানা কারণে গভীর সমুদ্রবন্দরের চিন্তা বাদ দেয়া হয়েছে”।

সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলছেন, পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ছিলো একটি জবরদস্তিমূলক সিদ্ধান্ত।

“আঞ্চলিক রাজনীতির কারণে এটিকে গভীর সমুদ্রবন্দর বানানোর চেষ্টা হয়েছিলো। এটি কখনোই গভীর সমুদ্রবন্দর হতো না। বরং বন্দর হিসেবে এটি মংলার চেয়ে ভালো হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

আরেকজন গবেষক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা ও ভূ রাজনৈতিক চাপের কারণেই সোনাদিয়ার পর পায়রা থেকে সরে এসেছে সরকার।

“তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি ভালো সিদ্ধান্ত হয়েছে। গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য চ্যানেল তৈরি সেখানে প্রচণ্ড ব্যয়বহুল হতো,” মিস্টার মোয়াজ্জেম বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন।

বিবিসি বাংলায় আরও পড়ুন:

তবে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী বলছেন, পায়রা বন্দরকে ঘিরে একটি মাস্টার প্লান তৈরি ও সমীক্ষার কাজ করছে বুয়েট ও নেদারল্যান্ডসের একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে ২৩/২৪টি উপাদান আছে যার একটি অংশ ছিলো গভীর সমুদ্রবন্দর।

জানা গেছে মূলত এ সমীক্ষাতেই উঠে এসেছে যে, পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর করার মতো যথাযথ গভীরতা সক্ষমতা নেই।

মি. চৌধুরী বলছেন, “একটি সমীক্ষা আমাদের করতেই হতো। এখন সমীক্ষা হওয়াতে আমরা বুঝতে পারছি পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য যথাযথ নয়। সেখানে যে বন্দর হচ্ছে সেটিই যৌক্তিক”।

যদিও ২০১৬ সালের অগাস্টে দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর হিসেবে পায়রায় পণ্য খালাস কার্যক্রম উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “ভবিষ্যতে পায়রা বন্দর গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে রূপ নেবে”।

এর আগে ২০১৩ সালের নভেম্বরে সংসদে পায়রা সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষ আইন পাস হয়েছিলো। এর আইনের আওতায় রাবনাবাদ নদী ও তৎসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের মোহনায় পায়রা সমুদ্রবন্দরের কাজ শুরু হয়।

এ কাজ শুরুর এতদিন পর এসে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিল হচ্ছে কেন এমন প্রশ্নের জবাবে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী বলেন, “সমীক্ষার কাজটি পরে শুরু হওয়ায় এটি হয়েছে। তবে এটি খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না। কারণ আমাদের মূল কাজ পায়রা বন্দর সেটিকে ঘিরে বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে”।

পায়রা বন্দরের প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে মূল বন্দর ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণে প্রায় ১ হাজার ৭শ কোটি ডলার ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিলো। যদিও কর্মকর্তারা এটিকে ধারণা হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন যা পরে পূর্ণ সমীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্ত হওয়ার কথা।

পায়রা বন্দর সরকারের অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্পগুলোর একটি।

যে কারণে গভীর সমুদ্রবন্দরের চিন্তা হয়েছিল

নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলছেন, সোনাদিয়ায় পরিবেশ ও প্রতিবেশ বিবেচনায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ পরিকল্পনা না এগুনোয় বিকল্প হিসেবে পায়রার বিষয়টি তখন চিন্তায় এসেছিলো।

“বন্দরের প্রয়োজনীয়তা ছিলো। এখন গভীর সমুদ্রবন্দর না হলেও পায়রা বন্দর ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছে। পুরো দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের অর্থনীতিতে এটি ভূমিকা রাখবে। এখন সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে বন্দর ঠিক আছে কিন্তু গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য মাতারবাড়িই বেশি উপযুক্ত”।

প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হবে মাতারবাড়ীর গভীর সমুদ্র বন্দর

প্রসঙ্গত এক সময় গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপকে নিয়ে বেশি আলোচনা হলেও পরে তা আর এগোয়নি।

তবে সেটি কি কারণে এগোয়নি সেটি সরকারের পক্ষ থেকে পরিষ্কার করে বলাও হয়নি।

এর মধ্যে সরকার ২০১৩ সাল থেকে পায়রা বন্দরকে কেন্দ্র করে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করে যার দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য ছিলো গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ।

এছাড়াও অর্থনৈতিক অঞ্চল, তৈরি পোশাক শিল্প এলাকা, সিমেন্ট কারখানা, সার কারখানা ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পসহ নানা কিছু আছে পায়রা প্রকল্পের আওতায়।

মি. চৌধুরী বলছেন গভীর সমুদ্রবন্দর ছাড়া বাকী সবকিছুই পরিকল্পনামাফিক চলছে।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলছেন, পায়রায় গভীরসমুদ্র বন্দরের সিদ্ধান্ত ছিলো একটা ‘জবরদস্তি’।

“রাবনাবাদ চ্যানেলের ৬০ কিলোমিটার পার হয়ে গভীর সমুদ্রে বন্দর বানানো ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিলো না। আর গভীর সমুদ্রবন্দরও হতো না এটা। আঞ্চলিক রাজনৈতিক স্বার্থে এটাকে গভীর সমুদ্র বন্দর বানাতে চাওয়া হয়েছিল”।

মি. ইসলাম বলেন, ১৮ মিটার গভীরতা সেখানে কখনোই রাখা যাবে না। এমনকি ১৪ মিটার গভীরতাও রাখা যাবে না। এটা করতে হলেও যে ধরণের খনন করতে হতো, তা হতো প্রচণ্ড ব্যয়বহুল। বন্দরের জন্য বেলজিয়ামের একটা কোম্পানির সাথে ড্রেজিং চুক্তি হয়েছে তাও রিজার্ভ থেকে ৫শ মিলিয়ন ডলার ধার করে-যা মোটেও যৌক্তিক হয়নি।

“তবে মংলার চেয়ে ভালো বন্দর হবে। তাই বন্দর অবকাঠামো গড়ে তোলা উচিৎ। পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হলে এবং সেতু থেকে পায়রা পর্যন্ত যোগাযোগ তৈরি হলে এটি বন্দর হিসেবে খুবই ভালো করবে,” বলছিলেন মিস্টার ইসলাম।

অন্যদিকে গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পুরো বিষয়টির সাথে দুটি বিষয় জড়িত- প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা আর ভূ-রাজনৈতিক চাপ।

“বাংলাদেশ যখন সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই করছিলো তখন মিয়ানমার কাছাকাছি এলাকায় সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। বাংলাদেশ আবার পায়রার জন্য স্টাডি করছে তখন ভারত বাংলাদেশে এই দিকেই কয়েকটি বন্দর নিয়ে কাজ করছে। বিশাখাপত্তমকে বড় পরিসরে করা হচ্ছে। তবে পায়রার জন্য গভীর সমুদ্রবন্দর না করাই ভালো হবে,” বলছিলেন তিনি।

তিনি বলেন গভীর সমুদ্রবন্দরের যে সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছে পায়রায় তাতেও উঠে এসেছে যে সেখানকার চ্যানেল উপযোগী করাটা ব্যয়বহুল হতো। আবার মাতারবাড়ীতেও কাজ শুরু হয়েছে। তাই দেরীতে হলেও কর্তৃপক্ষ পায়রা নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

Exit mobile version