Site icon The Bangladesh Chronicle

পাঠ্যবইয়ে জাতিবিদ্বেষ ও বাঙ্গালী মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস!

 আমার দেশ
২২ জানুয়ারী ২০২৩

হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির দখলে স্কুলের পাঠ্যবই

বিল্লাল হুসাইন

গত ৭ জানুয়ারি আমার দেশ ‘দীপু মনির নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির দখলে পাঠ্য পুস্তক’ শিরোনামে স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন নিয়ে লেখাটি প্রকাশ করার পর অনেকেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন। এ বিষয়ে কেউই দ্বিমত পোষণ করেন নি যে, সপ্তম শ্রেণীর সামাজিক বিজ্ঞান বইটিতে স্পষ্টতই সুলতানি আমলকে নিয়ে সচেতন ভাবে ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে। বইয়ের প্রচ্ছদ দেখে কোনো ভাবেই ঠাহর করার সুযোগ নেই এটি কি বাংলাদেশের শিশুদের জন্য লেখা কোনো বই, নাকি হিন্দুত্ববাদী মোদির দেশের কোনো বই। বইয়ের প্রচ্ছদে যেখানে বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক শাপলা বা দোয়েল উঠে আসার কথা সেখানে বেশ অযাচিত ভাবেই হিন্দুত্ববাদী ভারতের জাতীয় প্রতীক পদ্ম আর ময়ূর স্থান পেয়েছে।

চার অধ্যায়ের ১২৪ পৃষ্ঠার এই বইয়ের ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষ বুঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। বইটিতে একবার চোখ বোলালে তা খুব সহজেই ধরা পড়বে। বইটির বিষয়বস্তু ও বর্ণনার ঢং দেখে এটা স্পষ্ট যে, এখানে কোমলমতি শিশুদের শিক্ষা দানের চাইতে হিন্দুত্ববাদের প্রচারকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বড় ধরনের ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে ভারতীয় জাতীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে বাঙালি মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের পরিচয় নিয়ে হীনমন্যতা তৈরির স্পষ্ট অপচেষ্টা করা হয়েছে সপ্তম শ্রেণীর এই পাঠ্য বইয়ে। আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, শেষ ১৪ টি পৃষ্ঠা, ১১০-১২৪ পর্যন্ত পড়লেই বিজেপি-আরএসএসের যে হিন্দুত্ববাদী বয়ান তা দিবালোকের ন্যায় যে কারো চোখে পড়তে বাধ্য। বইটির মূল উদ্দেশ্যই যেন মুসলিম শাসকদের দখলদার, বহিরাগত, আক্রমণকারী ও বর্বর হিসেবে চিত্রায়িত করা। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এই হিন্দুত্ববাদ প্রচারকারী লেখকরা বইটিতে কলোনিয়াল শাসন ও তাদের নেওয়া সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক সিদ্ধান্ত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে’-র মহিমা বর্ণনা করেছে! আমাদের বর্তমান ভৌগলিক স্বাধীনতা যে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এসেছে, অর্থাৎ বৃটিশ বিরোধী গৌরবোজ্জ্বল যে আন্দোলন সে আন্দোলনকে পুরোপুরিই মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ, ও ফকির মজনু শাহদের নাম মুছে ফেলার অপচেষ্টাও করা হয়েছে এই বইটিতে।

যে সুলতানি আমল নিয়ে এত কুৎসা রটানোর অপচেষ্টা, আসুন সে সময়কালকে বাদ দিয়ে আমাদের আত্মপরিচয়ের সন্ধান সম্ভব কিনা সে আলোচনায় প্রবেশ করি। আমাদের যে বাঙালি বা বাংলাদেশী হয়ে ওঠা, কার হাত ধরে আমরা সেই বাঙ্গালী হয়ে উঠলাম, কে এই ভূখণ্ডের এই মায়াময় নাম দিলেন! শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের নামটি নিশ্চয়ই এখনও ভুলে যাননি পাঠক। এই মহান ব্যক্তিই এই অঞ্চলের অনেকগুলো এলাকাকে একত্রিত করে প্রথম ‘বাঙ্গালা’ নামকরণ করেন। এর অধিবাসীদের ‘বাঙ্গালি’ নামে নামাঙ্কিত করেন। তৎকালীন হিন্দু রাজারা দীর্ঘদিন এই জনপদ ও এর অধিবাসীদের শাসন করলেও তাদের কাছে এই অঞ্চলের মানুষ ও ভাষা অচ্ছুৎ হিসেবেই বিবেচিত ছিল; এই অঞ্চলের সাথে তারা নিজেদের নাম সেজন্যই জাড়াননি। তারা নিজেদেরকে গৌড়েশ্বর বলে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।

যে ভাষাকে নিয়ে আমাদের এত গর্ব এত অহংকার; যে ভাষায় হিন্দুত্ববাদীরা সাহিত্য রচনা করে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন, যে ভাষাকে উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুরা অচ্ছুৎদের ভাষা ও অস্পৃশ্য জ্ঞান করতেন। মজার বিষয় হচ্ছে, সেই ভাষার বিকাশ এবং সমৃদ্ধিও এই সুলতানি আমলে মুসলিম শাসকদের হাত ধরে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে! গুগলের এই যুগে খুব বেশি কষ্ট করার প্রয়োজন নেই। বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ লেখে একটু সার্চ দিন। উত্তর পেয়ে যাবেন। আরেকটু বিস্তারিত জানতে চান? না, না, মুসলিম কোন লেখকের কথা বলবো না! সুকুমার সেন পড়ুন, জানতে পারবেন। ক্ষুধা মিটছে না! কিছু নাম দিচ্ছি তাঁদের ব্যাপারে যে কোনো লেখকের গবেষণা প্রবন্ধ বা বই পড়ুন; ক্ষুধা মিটবে, সুলতানি আমল আর মুসলিম শাসকদের প্রতি ভালোবাসা-ভক্তি বৃদ্ধি পাবে, নিশ্চয়তা দিচ্ছি। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ্‌, গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ্‌, সুলতান ইউসুফ শাহ্‌, নসরত শাহ্‌, আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ্‌, গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ্‌, আর রুকনউদ্দিন বারবাক শাহদের নামগুলো মাথায় রেখে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশে তাঁদের অবদান দেখার চেষ্টা করুন, গর্ব করবেন সুলতানি আমল নিয়ে, গ্যারান্টি!

সুলতানি যুগে বাঙ্গালা ছিল বস্ত্রবয়ন শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু। সুলতানী যুগে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও রাস্তা-ঘাটে নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাপক প্রসার ঘটে। তৎকালীন বিশ্বে বাঙ্গালা বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোর একটি বলে বিবেচিত হতো। কূটনীতি, সীমান্ত রক্ষা, নাগরিক নিরাপত্তা, আর ধর্ম পালনের স্বাধীনতায় সুলতানি আমল নিঃসন্দেহে ঈর্শনীয় উচ্চতায় ছিল।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই গৌরবোজ্জ্বল শাসনকাল নিয়ে মুসলিম এই ভূখণ্ডে কেন এই বিদ্বেষ? উত্তর জটিল বা কঠিন নয়। প্রথমত হিন্দুত্ববাদীরা অন্যকে ছোট ও নীচ প্রমাণ করেই নিজের বড়ত্ব প্রমাণ করতে চায়। এই অপকৌশল আরএসএস বা বিজেপির মিডিয়া উইংয়ের দিকে তাকালে সহজেই বুঝতে পারবেন। দ্বিতীয়ত এবং সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকারের যে ঠুনকো হাজার বছরের ঐতিহ্য ও ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী’ ও তাকে জাতির পিতার আসনে বসানোর যে বয়ান, সে বয়ানকে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে সুলতানি আমল ও মুসলিম ঐতিহ্যকে বিতর্কিত করতেই হবে। সুলতানি আমলের শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহদের বিতর্কিত করতে পারলে ৫০ বছরের ইতিহাসকে হাজার বছরের ইতিহাসের উপর চাপিয়ে দেওয়া সহজ হয়। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের বাঙ্গালী জাতির জনক হওয়ার হক দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়!

লেখক: গণমাধ্যম কর্মী ও একটিভিস্ট

Exit mobile version