রফতানির বিপরীতে গত পাঁচ অর্থবছরে মোট ৩৬ হাজার ৫১১ কোটি টাকার নগদ প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাময়িক হিসাব অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮ হাজার ৬৮৯ কোটি, ২০২১-২২-এ ৮ হাজার ৭৮৫ কোটি, ২০২০-২১-এ ৬ হাজার ৬৪৬ কোটি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬ হাজার ৩৯১ কোটি টাকার প্রণোদনা দেয়া হয়েছে।
সাধারণত রফতানিতে প্রণোদনা পাওয়ার জন্য রফতানি মূল্য প্রত্যাবাসিত হওয়ার ১৮০ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় প্রমাণসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে আবেদন করতে হয়। এক্ষেত্রে আবেদন পাওয়ার পর ব্যাংকের পক্ষ থেকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফার্মের মাধ্যমে নিরীক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়। এ নিরীক্ষা শেষে দেয়া সনদের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক রফতানিকারককে নগদ সহায়তার অর্থ বিতরণ করে।
দেশের আর্থিক খাতের বেশ কয়েকটি আলোচিত ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় রফতানি আয়ের প্রণোদনার ক্ষেত্রেও অনিয়মের ঘটনা দেখা গেছে। এক্ষেত্রে নিরীক্ষকের জাল সার্টিফিকেটের মাধ্যমে প্রণোদনার অর্থ তছরুপের নজিরও রয়েছে। রফতানি আয়ের হিসাব সংশোধনের কারণে প্রকৃত আয় কমে যাওয়ায় এ খাতে নগদ প্রণোদনার বিষয়টিও পর্যালোচনা করে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়ের পক্ষ থেকে গত বছর রফতানির বিপরীতে নগদ সহায়তা কার্যক্রমের ওপর একটি কমপ্লায়েন্স অডিট পরিচালনা করা হয়েছিল। এক্ষেত্রে ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণ করা নগদ প্রণোদনা কার্যক্রম যাচাই করে সংস্থাটি। এতে নিরীক্ষার ভিত্তিতে বেশকিছু অনিয়মের অভিযোগ উঠে আসে।
এতে দেখা গেছে, বেশকিছু রফতানিকারক রফতানি মূল্য প্রত্যাবাসিত হওয়ার ১৮০ দিন পরও নগদ প্রণোদনার জন্য আবেদন করেছে। এর ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক প্রণোদনার অর্থ বিতরণও করেছে। যদিও নিয়মানুযায়ী এক্ষেত্রে রফতানিকারকের প্রণোদনা পাওয়ার কথা না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রফতানির অর্থ প্রত্যাবাসনের ৩৭৯ দিন পরও প্রণোদনার জন্য আবেদনের নজির রয়েছে।
এছাড়া দেশীয় উপাদান ব্যবহার করে উৎপাদিত পণ্য রফতানির ক্ষেত্রেও নগদ প্রণোদনা দেয় সরকার। সিএজির নিরীক্ষায় উঠে এসেছে, পোশাক খাতের কোনো কোনো রফতানিকারক আমদানীকৃত বিদেশী সুতার মূল্য বাদ না দিয়েই প্রণোদনার অর্থ গ্রহণ করেছেন। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, রফতানীকৃত পোশাকে যে ধরনের সুতা ব্যবহার করার কথা, সেটি ব্যবহার না করেই প্রণোদনার অর্থ নিয়েছেন। কিছু রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান এএক্সপি ইস্যু, পণ্য জাহাজীকরণ ও রফতানি মূল্য প্রত্যাবাসনের আগেই প্রণোদনার জন্য আবেদন করেছেন এবং এর ভিত্তিতে ব্যাংক সেই প্রতিষ্ঠানকে প্রণোদনার অর্থও দিয়ে দিয়েছে। যদিও নিয়ম অনুযায়ী এটি হওয়ার কথা নয়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পরিসংখ্যান পর্যালোচনার মাধ্যমে যেহেতু রফতানি আয়ে সংশোধন আনা হয়েছে, সেহেতু রফতানির বিপরীতে এতদিন পর্যন্ত দেয়া নগদ প্রণোদনাগুলোও নতুন করে পর্যালোচনা করে দেখা দরকার। তাহলেই সাড়ে ৩৬ হাজার কোটি টাকার নগদ প্রণোদনার অর্থে অতিরঞ্জিত রফতানি আয়ের প্রভাবগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেহেতু পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে প্রকৃত রফতানির পরিমাণ কমানো হয়েছে, সেহেতু এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে কিনা তা পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের বিচ্যুতি হয়েছে কিনা সেটিও দেখা দরকার।’
সিএজির অডিটে নগদ প্রণোদনায় যেসব অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে শতভাগ রফতানিমুখী প্রতিষ্ঠান না হওয়া সত্ত্বেও নগদ প্রণোদনা গ্রহণ, আবেদনের নির্ধারিত সময়সীমা অতিবাহিত হওয়ার পরও প্রণোদনা নেয়া, এলসির মাধ্যমে আমদানি করা সুতার মূল্য বাদ না দিয়ে নগদ সহায়তা গ্রহণ, এলসির মাধ্যমে কেনা সুতা রফতানি হওয়া তৈরি পোশাকে ব্যবহার না করে প্রণোদনা নেয়া, ইএক্সপি ইস্যু, পণ্য জাহাজীকরণ ও রফতানি মূল্য প্রত্যাবাসনের আগেই আবেদনের বিপরীতে নগদ সহায়তা প্রদান ইত্যাদি।
সেই সময় সিএজির দায়িত্বে ছিলেন অর্থ বিভাগের সাবেক সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রফতানি আয়ের পরিসংখ্যান পরিবর্তন হওয়ার বহুমাত্রিক প্রভাব রয়েছে। লেনদেন ভারসাম্য (বিওপি), চলতি হিসাব, জিডিপিসহ বিভিন্ন খাতের ওপর এর প্রভাব পড়বে। তাছাড়া জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে অতীতে রফতানি প্রণোদনার অর্থ গ্রহণের নজির রয়েছে। এতে একদিকে জনগণের করের অর্থের অপচয় হয়, অন্যদিকে এর সঙ্গে অর্থ পাচারেরও সংযোগ থাকতে পারে। যেহেতু একাধিক সংস্থার মধ্যে পরিসংখ্যান নিয়ে একটি বড় ধরনের অসামঞ্জস্য তৈরি হয়েছে, সেহেতু অবিলম্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি করে সবকিছু পর্যালোচনা করে দেখা উচিত।’
অর্থ সংকটের কারণে সরকার সদ্য সমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রণোদনার অর্থ দেরিতে ছাড় করেছে। এ নিয়ে সেই সময় রফতানিকারকরা সরকারের সঙ্গে দেন-দরবার করেছিলেন। এর মধ্যেই এ বছরের শুরুতে রফতানিতে প্রণোদনা কমানোর উদ্যোগ নেয় সরকার। প্রথম ধাপে গত ফেব্রুয়ারিতে খাতভেদে ১০ শতাংশ পর্যন্ত প্রণোদনা কমানো হয়েছিল। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের প্রথম দিন থেকে দ্বিতীয় দফায় খাতভেদে নগদ সহায়তার পরিমাণ সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়েছে। ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি হিসেবে প্রণোদনা ধাপে ধাপে কমিয়ে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সরকার। মূলত ২০১৯-২০ অর্থবছরে সব রফতানিকারকের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করার কারণে সেই সময় থেকে প্রণোদনা বাবদ সরকারের ব্যয় বাড়তে থাকে। এক্ষেত্রে রফতানি আয়ের ক্ষেত্রে দুই সংস্থার মধ্যে পরিসংখ্যানগত পার্থক্যের সঙ্গে প্রণোদনা বাড়ার সংযোগ নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নগদ প্রণোদনা ইপিবির তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দেয়া হয় না। রফতানিকারকদের ব্যাংক হিসাবে যে অর্থ আসে সেটার বিপরীতে অন্যান্য কাগজপত্রসহ এক্সপোর্ট প্রসিড সার্টিফিকেট দাখিল করতে হয়। এক্সপোর্ট প্রসিড সার্টিফিকেট দেয় সংশ্লিষ্ট এডি ব্যাংক। নগদ সহায়তার প্রাপ্যতা নিশ্চিতে ইপিবির তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং রফতানি বাবদ আসা প্রকৃত অর্থের ওপর ভিত্তি করেই নিরীক্ষার মাধ্যমে ব্যাংক এক্সপোর্ট প্রসিড সার্টিফিকেট দাখিল করে। ফলে আমার মনে হয় না যে এ পরিসংখ্যানের সঙ্গে সুবিধার অপব্যবহারের সুযোগ আছে। কিন্তু তার পরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সতর্কতার জন্য কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখতে পারে। ব্যক্তি পর্যায়ে কিছু জাল-জালিয়াতির অভিযোগ অনেক সময় শোনা গেছে। সেটা বিভিন্ন ক্ষেত্রেই হয়।’
রফতানিতে নগদ প্রণোদনার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী তৈরি পোশাক খাত। রফতানি আয়ের পরিসংখ্যান সংশোধন নিয়ে তাদের বক্তব্য হলো এতদিন তাদের প্রণোদনার সুবিধা কমিয়ে দেয়ার জন্যই রফতানির তথ্য বেশি দেখানো হয়েছে। খাতটির উদ্যোক্তাদের দাবি, তারা আরো আগেই সরকারকে জানিয়েছিলেন যে রফতানির পরিমাণ এত বেশি নয়।
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী খোকন অভিযোগ তুলে বলেন, ‘জাতীয় রফতানি কমিটিকে আমরা প্রতিবাদ করে বলেছিলাম, বিজিএমইএ ইউডি ও আমাদের প্রডাকশন ডাটার সঙ্গে রফতানির ডাটার মিল নেই। সেখানে গভর্নর মহোদয় এবং অন্যান্য লোক আমাদের ধমক দিয়ে বলেছেন, “আমরা বলি আমাদের রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছে আর আপনারা বলেন কম।’’ এতে বিজিএমইএ সভাপতিসহ আমরা যারা ছিলাম তারা নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। সেটা দেখিয়েই সরকার বলছে যে আমাদের গ্রোথ বাড়ছে। এ গ্রোথের কথা বলে আমাদের ফ্যাসিলিটিগুলো আসলে কাট করা হয়েছে। আমি বলব এটা এক ধরনের ষড়যন্ত্র। মিথ্যা গ্রোথের তথ্য দিয়ে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে।’
Bonik Barta