প্রকাশ : রোববার ২২ জুন ২০২৫, ২০:৫৯
মো: ইদ্রিস আলী শেখ
২০২৪ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির হয়ে প্রথমবারের মতো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন কৃষ্ণ নগরের ‘রানীমা’ অমৃতা রায়। নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি দাবি করেন, তার পূর্বপুরুষ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় যদি পলাশীর যুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে ইংরেজদের জয়ী না করতেন তাহলে ভারতে কোনো হিন্দু থাকত না। আজ বেদনাবিধুর সেই পলাশী দিবস। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন আজকের এই দিনে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যদের কাছে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বাহিনী পরাজিত হয়। যার মধ্য দিয়ে আমরা পৌনে দুই শ’ বছরের গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ হই। প্রশ্ন হলো- ইতিহাসের এই কালো অধ্যায় সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? একইসাথে পলাশীর ইতিহাস এবং পলাশী থেকে আমরা কোনো শিক্ষা নিতে পেরেছি কি না? আজকের দিনে তা আলোচনা-পর্যালোচনার দাবি রাখে।
পলাশী নিয়ে মুসলিম ঐতিহাসিকদের লেখা খুব কম। যেটুকু লেখা আছে তা তথ্য-উপাত্তের দিক থেকে দুর্বল। পলাশীর ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জানার পরিধি কেবল নবাবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা আর তার খালা ঘষেটি বেগমের প্রাসাদষড়যন্ত্রের কথা। কিন্তু পর্দার আড়ালে কার কী ভূমিকা ছিল সে সম্পর্কে আমাদের জানা- বোঝা নেই বললেই চলে।
আজকের আলোচনার উদ্দেশ্য সত্যিকার অর্থে পলাশীতে কী ঘটেছিল তা খুঁজে বের করার প্রয়াস। প্রচারিত গল্পকাহিনী, প্রচারণা এবং ইতিহাসের একটি অংশের বর্ণনার অন্যতম প্রধান বিষয়বস্তু হলো- ১. নবাব সিরাজের অদক্ষতা; ২. চারিত্রিক দুর্বলতা; ৩. অপরিপক্বতা; ৪. আত্মীয় স্বজনদের সাথে বিরোধ; ৫. দরবারের ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের ঐতিহ্য; ৬. ব্যবসায়ী এবং বণিকদের সাথে বিরোধ- ইত্যাদি কারণে পলাশীতে নবাব পরাজিত হন। সত্যিই কি এসব কারণে পলাশীতে নবাবের পরাজয় ঘটেছে? এই আলোচনার সুবিধার্থে সিরাজের ক্ষমতা গ্রহণের সময় মুর্শিদাবাদ বা বাংলার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থাটা একটু জানা দরকার। ‘নবাবী আমলে মুর্শিদাবাদ’ নামক গ্রন্থে সুশীল চৌধুরী উল্লেখ করেছেন, ১৭৫৪ সালে দেওয়ান, তান দেওয়ান, সাব দেওয়ান এবং বক্সি প্রভৃতি সাতটি গুরুত্বপূর্ণ পদের মধ্যে ছয়টি ছিল হিন্দুদের দখলে। আবার ১৯ জমিদার বা রাজার মধ্যে ১৮ জন ছিলেন হিন্দু। অন্যদিকে রজতকান্ত রায় এবং সুশীল চৌধুরী উভয়ের বর্ণনার মধ্যে এটা স্পষ্ট, মুঘল বাংলার বাণিজ্য ও ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণ করতেন হিন্দু ও জৈন মহাজনরা। লক্ষ করার মতো বিষয়, রাজ্য চালাচ্ছেন একজন মুসলমান আর আর্থিক দিকগুলোসহ সব নিয়ন্ত্রণ করছেন অন্যরা। এসব বণিকের মধ্যে সবচেয়ে সম্পদশালী ছিল জগৎশেঠ ভ্রাতৃদ্বয়। ইংরেজ বণিকরা এ সময় ভারতে ব্যবসার প্রসার এবং অন্যান্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় বাংলায় অবস্থান করে। তাদের সাথে সখ্য তৈরি হয় দেশীয় বণিক বা সম্পদশালী সম্প্রদায়ের।
রজতকান্ত রায় এবং সুশীল চৌধুরী উভয়ে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, পলাশীর ষড়যন্ত্রের মূল কারিগর ছিল জগৎশেঠ ভ্রাতৃদ্বয়। জগৎশেঠ ভ্রাতৃদ্বয়ের অর্থের লোভে তাতে অংশ নিয়েছে রাজদরবারের অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারী। মীরজাফর এ ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করেছে পরে। এমনকি মীরজাফর ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করার আগে নবাবকে পরাজিত করে ইয়ার লতিফ খানকে নবাব করার পরিকল্পনাও করেছিল ইংরেজরা। ইংরেজরা বাংলায় তাদের রাজ কায়েমের সুদূরপ্রসারী চিন্তা থেকে নবাবের সাথে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। এতে তাদের সাথে সহযোগী হয় জগৎশেঠ ভ্রাতৃদ্বয়ের মতো বণিক ও সুবিধাবাদী সম্প্রদায়। এরা নবাবের বিরুদ্ধে নানা অপবাদ ছড়ায় এবং সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। অন্যদিকে ইংরেজরা ক‚টকৌশলে দক্ষ ছিল। লর্ডক্লাইভ ছিল একজন ধূর্ত শেয়াল। ইংরেজরা মিথ্যা-ছলচাতুরী কোনোটির আশ্রয় নিতে কার্পণ্য করেনি। রজতকান্ত রায় ক্লাইভকে ঠগ, জালিয়াত এবং মিথ্যাবাদী হিসেবে অভিহিত করেছেন। লর্ডক্লাইভ এতটা ধূর্ত ছিল যে, উমিচাঁদকে ঠকাতে সে একটি সাদা দলিল এবং একটি লাল দলিল তৈরি করে। তরুণ নবাবের চরিত্রে কালিমা লেপন করে নানা অপবাদে ভ‚ষিত করে তার পতন ত্বরান্বিত করতে চাওয়াই এদের মূল উদ্দেশ্য ছিল। তবে নবাবের নবাবী পরিচালনায় সমস্যা যে ছিল না তা বলা যাবে না।
অন্যদিকে মীরজাফর বা ঘসেটি বেগম যে নবাবকে পরাজিত করতে ভ‚মিকা রাখেনি তা-ও বলা যাবে না।
মুর্র্শিদাবাদের নবাবীর ঐতিহ্য ছিল ষড়যন্ত্রের। রাজপ্রাসাদের সাথে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক ছিল না। নবাবী মসনদের আসা-যাওয়া সাধারণ মানুষের চিন্তার বিষয় ছিল না। বেশির ভাগ ঐতিহাসিকের বক্তব্য এটি। আরো একটি বিষয় হলো- মুঘলদের রাজ্য পরিচালনার সাথে ধর্মের সম্পর্ক ছিল খুব ঢিলেঢালা। বাংলার সাথে তাদের সম্পর্ক ছিল মূলত খাজনা আদায়ের। গবেষক হাসান মাহমুদ তার ‘বাঙালি মুসলমান প্রশ্ন’ বইয়ে মুঘল আমলকে বাংলাদেশের জন্য ঔপনিবেশিক শাসনের সূত্রপাত বলে অভিহিত করেছেন।
এখন আসুন কৃষ্ণ নগরের ‘রানীমা’ অমৃতা রায়ের বক্তব্যে তিনি বলার চেষ্টা করেছেন মুসলমানদের হাত থেকে রক্ষা পেতে তার পূর্বপুরুষ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় পলাশীর ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছিলেন। একইসাথে ইংরেজদের হাতে গোটা ভারত ছেড়ে দিতে সাহায্য করেছিলেন। পলাশীর ষড়যন্ত্রের ইতিহাসে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের অংশগ্রহণ খুব সামান্য। যতটুকু জানা যায়, তার সাথে মীরজাফরের সখ্য ছিল। পলাশীর ষড়যন্ত্রের মূল ষড়যন্ত্রকারী ছিল জগৎশেঠ ও কৃষ্ণচন্দ্র রায়দের মতো উচ্চবিত্ত হিন্দু বণিক, জমিদাররা। কিন্তু অমৃতা রায় অভিযোগ করেছেন, হিন্দুদের বাঁচাতে তারা ইংরেজদের হয়ে কাজ করেছেন। যা ডাহা মিথ্যা। কারণ সমসাময়িক অর্থনৈতিক অবস্থার দিকে তাকালে বোঝা যায়, হিন্দুরা ছিল সমাজের মূল সুবিধাভোগী গোষ্ঠী। আবার এসব বর্ণনার বেশির ভাগ এসেছে হিন্দু ইতিহাসবিদদের বর্ণনা থেকে। পলাশীর ইতিহাসের সঠিক বর্ণনা মুসলিম কোনো ঐতিহাসিকের বর্ণনা থেকে আমরা পাই না। যেটুকু পাই তাতে মীরজাফর আর ঘসেটি বেগমকে কিছুটা গালাগালি ছাড়া আর কিছু নেই। তাই পলাশী থেকে আমরা মূল শিক্ষাটাও নিতে পারিনি।
পলাশীর সাথে বিগত দেড় দশকের একটি সূক্ষ্ম যোগসূত্র আমরা দেখতে পাই। স্বাধীন সার্বভৌম এবং কার্যকর একটি রাষ্ট্রের যে চাবিকাঠিগুলো থাকে তার সবকটি দেড় দশকে আক্রান্ত হয়েছে। এটি একটি দল বা তাদের নেতাই শুধু করেছেন- এটি বিশ্বাস করা খুব কষ্টকর। এসব কোথাকার ষড়যন্ত্র আমাদের বুঝতে হবে। যেমন করে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন নিরুপায়ভাবে ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া আমাদের আর কোনো ক্ষমতা ছিল না, ঠিক তেমনি একটি পরনির্ভরশীল রাষ্ট্র্রে আমাদের পরিণত করার ষড়যন্ত্র স্বাধীনতার পর থেকে ছিল এবং এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। তাই পলাশীর বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে যাতে অন্তত আমরা জাতি হিসেবে টিকে থাকতে পারি সেই পথে আমাদের হাঁটতে হবে। এটি ছাড়া বিকল্প আর কোনো পথ আমাদের সামনে খোলা নেই।
লেখক : প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, জাবি ও ব্যাংকার