আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে এমন ঘোষণায় বিএনপিসহ কয়েকটি দল এখন নির্বাচনী ট্রেনে। জামায়াতে ইসলামী ইতঃমধ্যে সারাদেশে প্রাথমিক প্রার্থী ঘোষণা করে মাঠ চষে বেড়াচ্ছে। মাঠ গোছাচ্ছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও ইসলামী আন্দোলনসহ অন্যান্য দলগুলোও। কিন্তু জটিলতা বেঁধেছে জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, তা নিয়ে। বিএনপি চায় নির্বাচিত সরকার এসে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বেশির ভাগ দল এটি নাকচ করে দিয়েছে। জুলাই সনদের অধীনেই আগামী নির্বাচন চায় তারা। সনদ বাস্তবায়নের পথ খুঁজছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। দ্ইু দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইতঃমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো জুলাই জাতীয় সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়ার উপর মতামত দিয়েছে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ ২৯টি রাজনৈতিক দল। গত ১০ আগস্ট ৬ জন আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞকে নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। অনানুষ্ঠানিকভাবে আরো বিশেষজ্ঞদের মতামত নিচ্ছে কমিশন। কিন্তু সমাধান পাচ্ছেন না তারা। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য, একে অপরকে ছাড় দেয়া ছাড়া কোনো সমাধান দেখছেন না বিশেষজ্ঞরাও। এ অবস্থায় বেশ কিছু দিন হলো পর্দার আড়ালে অনানুষ্ঠানিকভাবে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে। কিন্তু ফলাফল এখনো শূন্য। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদ ভবনে অবস্থিত কমিশন কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের বিষয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জুলাই সনদের আইনি বাধ্যবাধকতা নিশ্চিতে গণভোট অথবা বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারির পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে বৈঠকে জুলাই সনদের আইনি কাঠামো এবং বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতার বিষয়ে এ মতামত আসে। সভায় জুলাই জাতীয় সনদের সমন্বিত খসড়ার উপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে প্রাপ্ত মতামতগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। জাতীয় সনদে কিভাবে এসব মতামতের প্রতিফলন ঘটানো যায় তা বিশ্লেষণ করা হয়। মতামতগুলোকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় সনদের চূড়ান্ত রূপ নির্ধারণ এবং প্রয়োজনীয় আইনি ও নীতিগত কাঠামো গঠনের বিষয়েও আলোচনা হয়। পাশাপাশি সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার সামনে সম্ভাব্য বিকল্পগুলোও বৈঠকে আলোচিত হয়।
বৈঠকে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ ছাড়াও সদস্য বিচারপতি মো: এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. মো: আইয়ুব মিয়া এবং ঐকমত্য গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।
গত ১৬ আগস্ট ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মতামতের জন্য পাঠানো হয়। এতে মোট ২৯টি রাজনৈতিক দল তাদের মতামত দিয়েছে বলে জানায় কমিশন।
গত ২৪ আগস্ট রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দুই ঘণ্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে কমিশন। বৈঠকে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মো: আসাদুজ্জামান ছাড়াও বিশেষজ্ঞ হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন, বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া ও ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক উপস্থিত ছিলেন।
গত ১০ আগস্টের বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা জুলাই সনদ বাস্তবায়নে চারটি বিকল্প দিয়েছিলেন। এগুলো হলো-অধ্যাদেশ জারি, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ, গণভোট এবং গণপরিষদ গঠন। ঐকমত্য কমিশন সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়া থেকে অধ্যাদেশ বাদ দিয়েছে। তবে বাকি বিকল্পগুলোও উল্লেখ করা হয়নি। খসড়ায় ৮ দফায় অঙ্গীকারের শেষটিতে বলা হয়েছে, বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কারগুলো কালক্ষেপণ ছাড়াই নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন করবে সরকার।
গত ২৪ আগস্টের বৈঠকে ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মতামত গ্রহণের বিকল্প নিয়ে আলোচনা হয়নি। বাদ যায় অধ্যাদেশ জারি করে সংস্কার বাস্তবায়নের পরামর্শ। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ৯৩(২) অনুচ্ছেদে অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধানের কোনো বিধান পরিবর্তন বা রহিতে বাধা রয়েছে। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, গণভোট এবং সাংবিধানিক আদেশ ছাড়াও গণপরিষদ নিয়ে আলোচনা হয়। তবে তৃতীয় বিকল্পটি গ্রহণ করা হয়নি।
সনদের খসড়া মতামতে বিএনপি জানিয়েছে, যেসব সংস্কার কার্যকরে সংবিধান সংশোধন করতে হবে, সেগুলো আগামী সংসদে বাস্তবায়ন করা হবে। এর বিরোধিতা করে জামায়াতে ইসলামী জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট দাবি করেছে। অন্য দিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি গণপরিষদের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার দাবি করে আসছে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, সংবিধান ও আইনের ওপর প্রাধান্য পাবে সনদ। কোনো আদালতে সনদ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এ দুই অঙ্গীকারে বিএনপি রাজি নয়। তবে, এতে একমত জামায়াতে ইসলামী। আর সনদের আইনি ভিত্তি চাইলেও সংবিধানের ওপর প্রাধান্য চায় না এনসিপি।
বৈঠকে উপস্থিত আরেক বিশেষজ্ঞ বলেন, গণভোটে গেলে জুলাই সনদ বিষয়ে জনগণের ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয় থাকবে। গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একসাথে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ব্যালটে নির্বাচনী প্রতীকের পাশাপাশি জুলাই সনদের বিষয়টি থাকতে পারে।
জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, গণ-অধিকার পরিষদসহ অধিকাংশ দল জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি চায়। দলগুলোর দাবি, সনদের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো এর বিরুদ্ধে। কমিশন সূত্র জানিয়েছে, তারা মাঝামাঝি একটি পথ খুঁজছে, যা সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
খসড়া সনদের অঙ্গীকারে বলা হয়েছে, বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার কোনগুলো এ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর। প্রথম সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর ৬২টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য হয়েছে। দ্বিতীয় দফার সংলাপে ২২ সংস্কারের কমিশন সিদ্ধান্ত দিলেও রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে ১১টিতে। বাকিগুলোর ৯টিতে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) রয়েছে। তারা জানিয়েছে, ক্ষমতায় গেলে এগুলো বাস্তবায়ন করবে না। জামায়াত নির্বাচনের আগেই ৮৪ সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন চায়।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, সনদ বাস্তবায়নের উপায় হিসেবে গণভোটসহ বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সনদ বাস্তবায়নে আইনি বাধ্যবাধকতা কীভাবে তৈরি করা যায়, এ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। কোন কোন সংস্কার নির্বাচনের আগে বাস্তবায়নযোগ্য এ তালিকা করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট ও গণপরিষদের চিন্তা বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করছে বিএনপি। দলটি মনে করে, জুলাই সনদ হচ্ছে জনগণের সামনে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার এবং সেই অঙ্গীকার আইনের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। এ ক্ষেত্রে বিএনপির সিদ্ধান্ত হচ্ছে- সংবিধান সংশোধনের সাথে সম্পর্কিত নয়, রাজনৈতিক ঐকমত্য হওয়া এমন সংস্কার প্রস্তাবগুলো অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাহী আদেশে ও অধ্যাদেশের মাধ্যমে নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়ন করতে পারে। আর যেসব সংস্কার প্রস্তাব সংবিধান সংশোধন সংশ্লিষ্ট সেগুলো নির্বাচিত সংসদ করবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আগামী বৈঠকে দলটি তাদের এই অবস্থান তুলে ধরবে। গত সোমবার রাতে রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এমন আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিএনপি মনে করছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মূল বিষয় হচ্ছে অঙ্গীকার। রাজনৈতিক দলগুলো সনদে সইয়ের পর তা বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। এর মানে দেশের জনগণের সামনে অঙ্গীকার করা হচ্ছে এবং রাজনৈতিক দলগুলো সেটা বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে পরবর্তীতে জনগণই ভোটের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোকে এর জবাব দেবে।
অন্য দিকে, সম্প্রতি সুজন আয়োজিত এক নাগরিক সংলাপে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, আমরা জুলাই শহীদদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের এ জুলাই সনদ রক্তস্নাত। আমাদের রাজনীতিবিদরা এর প্রতি সম্মান দেখাবেন। যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের আত্মত্যাগ যাতে বৃথা না যায়, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। রাজনীতিবিদরা এর প্রতি অসম্মান করলে মাশুল দিতে হবে।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়নের স্বার্থকতা নির্ভর করবে এর বাস্তবায়নের ওপর। সনদটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার, রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা রয়েছে। নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে এবং পরবর্তী সংসদে ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা হবে। এমন মনোভাব পোষণ করলে রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না।
জুলাই সনদের সর্বশেষ পরিস্থিতি বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে সংযুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার নয়া দিগন্তকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মতামত জমা দিয়েছে। আমরা জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথ খুঁজছি। আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে বিশেষজ্ঞদের সাথেও কথা বলছি। আগামী সপ্তাহে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ফের সংলাপ শুরু হতে পারে। আশা করছি, আলোচনার ভিত্তিতে একটা পথ বের হবে।
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, কমিশনের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর এখন প্রধান এজেন্ডা কীভাবে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন হবে, তার রূপরেখা ঠিক করা। কিন্তু দফায় দফায় বৈঠকেও রাজনৈতিক দলগুলো একমত হচ্ছে না।