আমাদের বাংলাদেশ নামক প্রজাতন্ত্রটি সংবিধান ও আইন দ্বারা পরিচালিত। সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের ৫০ জন মহিলা সদস্য ব্যতীত অপর ৩০০ সদস্য একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত।
জাতীয় সংসদ ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন প্রশাসনিক এককাংশ রয়েছে। এসব প্রশাসনিক এককাংশ হলো সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ। প্রতিটি প্রশাসনিক এককাংশ বিষয়ে সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর এসব প্রশাসনিক এককাংশের স্থানীয় শাসনের ভার ন্যস্ত থাকবে।
আমাদের সংবিধানের প্রাণ হলো এর প্রস্তাবনা। প্রস্তাবনায় স্পষ্টরূপে উল্লেখ রয়েছে রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে।
আমাদের এ দেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত থাকাকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খানের শাসনামলে রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জাতীয় সংসদ ও প্রাদেশিক সংসদসমূহের সদস্য এবং ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানগণ পরোক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হতেন। আইয়ুব খান প্রবর্তিত তথাকথিত এ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটিকে বলা হতো মৌলিক গণতন্ত্র। যদিও এর মধ্যে গণতন্ত্রের মৌলিকত্বের লেশমাত্র উপস্থিতিও পরিলক্ষিত হতো না। সে সময়ে একমাত্র ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বারগণ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হতেন এবং চেয়ারম্যানদের ভোটে প্রেসিডেন্ট এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদসমূহের সদস্যগণ নির্বাচিত হতেন। আমাদের দেশে রাজনীতিতে এ ব্যবস্থাটি প্রবর্তন পরবর্তী সরকারি দল কর্তৃক নিজ দলের সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করার জন্য অর্থ বা উপঢৌকনের বিনিময়ে ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বারদের ভোট ক্রয়ের প্রথার প্রচলন শুরু হয়। পরবর্তী ধাপের ভোটসমূহের ক্ষেত্রে এ প্রথাটি ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানদের ওপরও সমভাবে কার্যকর ছিল। এ প্রথা প্রবর্তন পরবর্তী দেখা গেলো এ দেশের সর্বনি¤œ ধাপের স্থানীয় শাসনব্যবস্থা শতভাগ দুর্নীতিগ্রস্ত ও কলুষিত। সাধারণ জনমানুষ এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠলে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিদায় ঘটে। অতঃপর ১৯৭০ সালে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন দল আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকারী হলে বিভিন্ন কূটকৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে সে অধিকার হতে বঞ্চিত করা হয়। এর ফলে যে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয় তার চূড়ান্ত পরিণতিতে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
বাংলাদেশে বর্তমানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা প্রচলিত আছে। এ ব্যবস্থায় সাধারণ আসনের সংসদ সদস্যগণ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হলেও রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পরোক্ষভাবে সংসদ সদস্যদের ভোটে বা সমর্থনে নির্বাচিত। ১৯৭৫-১৯৯১ সালের তৃতীয় ভাগ অবধি আমাদের এ দেশ রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা দ্বারা শাসিত হয়েছিল। সে সময় জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতির নির্বাচিত হওয়ার বিধান প্রচলিত ছিল।
বাংলাদেশে দীর্ঘকাল যাবৎ স্থানীয় শাসন ব্যবস্থার অধীন পরিচালিত প্রতিষ্ঠানসমূহের জনপ্রতিনিধিগণ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন। কিন্তু বিগত দিনে অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেখা গেল অপরাপর স্থানীয় পরিষদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভোটের মাধ্যমে এদের নির্বাচিত করার প্রথা প্রবর্তিত হয়েছে। এটি আইয়ুব খান প্রবর্তিত মৌলিক গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণ বৈ কিছু নয়। স্বাধীনতার চার যুগেরও অধিক সময় পর আমরা আইয়ুব খান প্রবর্তিত ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ায় তা আমাদের ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়, আমাদের সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম এবং সর্বোপরি আমাদের সংবিধান ও এর চেতনাকে ম্লান করে দেয়।
পাকিস্তান শাসনামলে যে প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বার ও চেয়ারম্যানদের বশীভূত করে স্বপক্ষে নেয়া হতো, বিগত দিনে অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও অনুরূপ প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা হতে, এমন তথ্যেরই প্রকাশ ঘটেছে।
আমাদের সংবিধানকে দেশের অপরাপর আইনের ওপর প্রাধান্য দিতে গিয়ে বলা হয়েছে প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সে ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এ সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে। সংবিধানের এ অবস্থান দ্বারা ব্যক্ত হয় যারা জনগণের পক্ষে জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় শাসনব্যবস্থার অধীন প্রতিষ্ঠানসমূহের পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত হবেন তারা কেবলমাত্র জনগণ কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে প্রদত্ত ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়া পরবর্তী এরূপ কাজে নিয়োজিত হতে পারবেন।
গণতন্ত্র বিষয়ে আমাদের সংবিধানের যে অবস্থান তা হলো- প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে এবং প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।
উপরোক্ত দু’টি অনুচ্ছেদে বিবৃত বক্তব্য অনুধাবনে প্রতীয়মান হয় সংবিধান রাষ্ট্র এবং এর অধীন প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিচালনার ক্ষেত্রে গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছে। সংবিধানের এমন অবস্থানের ব্যত্যয়ে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের অধীন কোনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় যদি পরোক্ষ নির্বাচনের কথা ভাবা হয় সেক্ষেত্রে তা যে সংবিধানের চেতনার পরিপন্থী এ বিষয়ে কারো মধ্যে কোনো ধরনের সংশয় থাকার কথা নয়। আর এ ধরনের কোনো সংশয় না থাকলে আমাদের সর্বতোভাবে উচিত সংবিধানের চেতনার পরিপন্থী যেকোনো কাজ থেকে নিজেদের নিবৃত্ত রাখা।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
নয়াদিগন্ত