তথ্যমতে, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ২০ শতাংশ ইক্যুইটি ছিল বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিপিসিএল)। এর মধ্যে অর্ধেক তথা ১০ শতাংশ দেয় বাংলাদেশের নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (এনডবিøউপিজিসিএল)। বাকি ১০ শতাংশ দেয় চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি)। বাকি ৮০ শতাংশ ঋণ হিসেবে নেয়া হয়। ১৫ বছর মেয়াদি এ ঋণের গ্রেস পিরিয়ড ৪ বছর, যা মোট ২৩ কিস্তিতে শোধ করতে হবে।
ঋণ নেয়ার সময় সুদহার ধরা হয়েছিল ছয় মাস মেয়াদি লাইবর+২.৯৮ শতাংশ সুদ। এতে সুদহার পড়ত ৫ শতাংশের কম। তবে লাইবর (লন্ডন আন্তঃব্যাংক অফার রেট) বিদায়ের পর বর্তমানে ঋণের সুদ নির্ধারণে বিবেচনা করা হচ্ছে সোফর। এতে বর্তমানে সুদহার দাঁড়িয়েছে ছয় মাস মেয়াদি সোফর+২.৯৮ শতাংশ সুদ। তবে গত বছর সোফর বেড়ে পাঁচ শতাংশ ছাড়িয়েছে। বর্তমানে ছয় মাস মেয়াদি সোফর দাঁড়িয়েছে পাঁচ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ফলে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের জন্য সুদ দিতে হচ্ছে আট দশমিক ৩৪ শতাংশ হারে।
এদিকে দেশের ডলারের বিনিময় হারও বেড়ে গেছে। ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৯৩ টাকা ৫০ পয়সা। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে তা দাঁড়ায় ১০৯ টাকা ১৮ পয়সা। বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় গত অর্থবছর মুদ্রা অবমূল্যায়নজনিত ক্ষতি প্রায় ৬৮ শতাংশ বা ৯৭৬ কোটি টাকা বেড়েছে। এতে দেশীয় মুদ্রায় ঋণের প্রকৃত পরিমাণও বেড়ে গেছে। আর সুদ ও ঋণ পরিশোধ ব্যয় বাড়ায় পায়রার জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) ক্যাপাসিটি চার্জও বেশি দিতে হচ্ছে।
বিসিপিসিএলের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরুতে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৪২৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ওই অর্থবছর টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বিনিময় হারের ক্ষতি দাঁড়ায় এক হাজার ৪৩৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এতে মোট ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৮৬৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর থেকে ওই অর্থবছর শোধ করা হয়েছিল প্রায় এক হাজার ১৫৮ কোটি টাকা। এতে অর্থবছর শেষে ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৭০৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল এক হাজার ৩২৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ১৪ হাজার ৩৮৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
এদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরুতে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৭০৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ওই অর্থবছর বিনিময় হারের ক্ষতি দাঁড়ায় দুই হাজার ৪১২ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এতে মোট ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ১২০ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর থেকে গত অর্থবছর শোধ করা হয়েছিল প্রায় এক হাজার ৩২৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এতে অর্থবছর শেষে ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৭৯৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল এক হাজার ৬২৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ১৫ হাজার ১৭২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
এ হিসাবে গত অর্থবছর শেষে ঋণের স্থিতি বেড়ে গেছে এক হাজার ৮৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা বা ছয় দশমিক ৯৩ শতাংশ। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়েছে ৭৮৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বা পাঁচ দশমিক ৪৮ শতাংশ। আর স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেড়েছে ২৯৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বা ২২ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছর পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের সুদ পরিশোধ করা হয়েছিল ৬৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণের সুদ ছিল ৩৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুদ ২৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। তবে গত অর্থবছর বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সুদ পরিশোধ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ২৬১ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণের সুদ ছিল ১০১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুদ এক হাজার ১৫৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।
এ হিসাবে গত অর্থবছর পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সুদ পরিশোধ ব্যয় বেড়েছে এক হাজার ১৯৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বা এক হাজার ৭৯৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণের সুদ পরিশোধ বেড়েছে ৬৫ কোটি দুই লাখ টাকা বা ১৭৬ দশমিক ০৬ শতাংশ। আর দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুদ পরিশোধ বেড়েছে এক হাজার ১২৯ কোটি ৯১ লাখ টাকা বা তিন হাজার ৮১০ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
উচ্চহারে ঋণের সুদ শোধের পরিশোধের পরও গত অর্থবছর বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বকেয়া বা প্রদেয় সুদ বেড়ে গেছে। ২০২১-২২ অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ৯৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। গত অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রদেয় সুদ বেড়েছে ১১৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা বা ১২৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
জানতে চাইলে বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এএম খোরশেদুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ঋণ নেয়া হয়েছিল লাইবর+২.৯৮ শতাংশ হারে। তবে লাইবর বিদায় নিয়েছে। বর্তমানে সোফর+২.৯৮ শতাংশ সুদ দিতে হচ্ছে ঋণের জন্য। তবে ঋণ নেয়ার সময় লাইবর ছিল দুই শতাংশের কম। বর্তমানে সোফর প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাংশে ঠেকেছে। এতে সুদ পরিশোধ ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ নেয়া হয়েছিল ডলারে। তাই শোধও করতে হচ্ছে ডলারে। তবে বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় এখন মূল ঋণের পরিমাণও দেশীয় মুদ্রায় বেড়ে গেছে। তবে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ ও সুদ পরিশোধ ব্যয় পাস থ্রæ পদ্ধতিতে পিডিবি পরিশোধ করে দেয়। এতে পিডিবির ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ মূলত বেড়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০২১-২২ অর্থবছর পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল দুই হাজার ৬০৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা। গত অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার হাজার ১০৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ ব্যয় দেড়গুণ হয়ে গেছে।
sharebiz