মিনার রশিদ
বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে এমন একটি সংবাদ আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এ এক আজিব কাজির গরু, কেতাবে আছে গোয়ালে নেই। নিজের মনে সুখ নেই, কিন্তু অংক কষে দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে সুখের সীমা নেই। পেটে ভাত নেই কিন্তু অংক কষে দেখানো হচ্ছে, কোর্মা-পোলাও দিয়ে পেট ভর্তি করা হয়েছে।
যেসব অর্থনীতিবিদ ও গবেষক কাজির গোয়ালে এই গরুটি দেখতে পাচ্ছেন না তাদেরকে ধিক্কার দিতে নিজের নিরপেক্ষ বয়ান নিয়ে এগিয়ে এসেছেন ড. জাফর ইকবাল। তিনি পরশ্রীপুলক নামে একটি রচনা লিখেছেন জাতিকে আলোকিত ও বিশেষ চেতনায় চেতনায়িত করার নিমিত্তে। “পরশ্রীপুলক” নামক একটি নতুন শব্দ সৃষ্টির তাগিদ তিনি সঙ্গত কারণেই অনুভব করেছেন। নিজের প্রস্তাবিত বা উদ্ভাবিত শব্দটিকে ইনভার্টেড কমার ভেতরে ঢুকিয়ে (সাধারণত অন্যের কথা বা উদ্ধৃতিকে ইনভার্টেড কমার ভেতরে ঢুকানো হয়) এবং সেটিকে শিরোনাম বানিয়ে বরাবরের মতই একটি শতভাগ রাজনীতিমুক্ত ও নির্ভেজাল কলাম তিনি জাতিকে উপহার দিয়েছেন।
ইন্ডিয়ার লোকজন তো বটেই এমনকি সেই পাকিস্তানের কেউ কেউ নাকি বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ‘পুলক’ প্রকাশ করেছেন। ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তানের সেই পুলক দেখেই তিনি মূলত পরশ্রীপুলক শব্দটি আমদানি করেছেন। বাংলাদেশের যে অর্থনীতিবিদ ও গবেষকদের পরশ্রীকাতরতা নিয়ে এই গোস্বাটি প্রকাশ করেছেন সেখানে সঠিক শব্দটি হবে স্বশ্রীকাতর বা নিজশ্রীকাতর। অর্থাৎ, যে হতভাগারা নিজের দেশের শ্রী দেখেও কাতর হন তাদেরকেই স্বশ্রীকাতর বলাই শ্রেয়।
অন্য একজন নেতার রেফারেন্স টেনে তিনি জানিয়েছেন যে পরশ্রীকাতর শব্দটি নাকি পৃথিবীর অন্য কোনো অভিধানে নেই। জানি না পৃথিবীর কয়েক হাজার ভাষার মধ্যে কয়টি ভাষায় এই শব্দটি তিনি খুঁজেছেন? যদিও পরশ্রীকাতর শব্দটি বাংলাভাষাতেও একক কোনো শব্দ নয়। পর, শ্রী এবং কাতর- এই তিনটি শব্দ বসিয়ে এই শব্দটি তৈরি করা হয়েছে। অন্যের শ্রী দেখে কাতর হওয়া মানবজাতির অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি খাসলত বা স্বভাব। মানুষের এই খাসলতটি সকল মানবগোষ্ঠির গোচরে আছে, হোমোসেপিয়ান প্রজন্ম নিজেকে ছাড়া অন্য সকলকে এই রোগে আক্রান্ত বলে মনে করে। কাজেই বিশেষ এই ভাবনাটি তুলে ধরতে এরকম শব্দযুগল সৃষ্টি করা মোটামুটি সমৃদ্ধ সকল মানবিক ভাষাতেই সম্ভব। আমরা কলেজ লাইফে মিসেস ‘প্যাকেলটাইড’স টাইগার’ নামে যে গল্প পড়েছি সেখানেও লেখক তখনকার ব্রিটিশ সমাজের উঁচু স্তরের পরশ্রীকাতরতার সুন্দর চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। এটি একটি সামাজিক ও বৈশ্বিক সমস্যা।
তৃতীয় বিশ্বের একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হয়েও আমরা গণতন্ত্র রপ্ত করে ফেলেছি, গণতান্ত্রিক সমাজের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য আমাদের আয়ত্তে চলে এসেছে – পরশ্রীকাতরতার বশবর্তী হয়েই আমাদের প্রতিবেশী আমাদের সেই সুখ বা শ্রীটি নষ্ট করতে যা যা সম্ভব তার সবই করছে। দা ইকোনোমিস্ট সামান্য জানিয়েছিল এই মহৎ কাজে (বাংলাদেশের গণতন্ত্র ধ্বংস করতে) ইন্ডিয়ান টাকা ও উপদেশের থলের কথা (Bags of Indian cash and advice)। এই বিষয়গুলি জাফর ইকবালদের পর্যবেক্ষণে কখনোই ধরা পড়বে না। কিন্তু এখন ধরা পড়েছে আমাদের শ্রী দেখে ইন্ডিয়ানদের পুলক, যেটিকে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন পরশ্রীপুলক! বিষয়টিকে আরেকটু বিশ্বাসযোগ্য ও সিরিয়াস বানাতে তিনি এখানে পাকিস্তানের কথাও টেনে এনেছেন। যে পাকিস্তানের নাম নিলে ছোট ছোট বাচ্চাদের তিনি দাঁত ব্রাশের পরামর্শ দেন সেই পাকিস্তানের নামও এখানে তিনি নিয়েছেন। জানি না এবার তিনি নিজে দাঁত ব্রাশ করেছেন কি না।
পাকিস্তানের কোন্ যদুমধু কখন কোন্ টেলিভিশন টকশোতে কখন একটুখানি বাংলাদেশের সুনাম করেছে সেটি এখন জাফর ইকবাল এবং মোহাম্মদ আরাফাতদের চেতনার জপমালা হয়ে দাঁড়িয়েছে! বাস্তব তথ্য-উপাত্ত এবং পরিসংখ্যানের চেয়ে এই সব গবেষকদের কাছে পাকিস্তানের যদুমধুর টেস্টিমনিয়াল বেশী দামি হয়ে পড়েছে! শতকরা পঁচানব্বই ভাগ মানুষের রক্ত চুষে পাঁচ ভাগ মানুষের সমৃদ্ধি ঘটছে। এতে মাথাপিছু আয় একটু বাড়তি দেখালেও সেটা সমৃদ্ধির চেয়ে সর্বনাশার চিত্রই তুলে ধরে।
এক মা তার নতুন বিয়ে করা পুত্রের মুখে শ্বশুর বাড়ির প্রশংসা শুনতে শুনতে কাতর হয়ে পড়ে। মা জিজ্ঞেস করে, বাবা তোর শাশুড়ি কত বড় মোরগ জবাই করেছিল? ছেলে হাত বাড়িয়ে বলে, মা এত্তো বড়! মা অবাক হয়ে বলে, মোরগ কখনো এত্তো বড় হয় বাবা? লজ্জিত মুখে ছেলে বলে, দু:খিত মা, নিচের হাতটি রাখতে ভুলে গেছি।
ফ্যাসিবাদী এই সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন, হত্যা, গুম, লুটপাট ঢাকতে মোহাম্মদ এ. আরাফাত এবং জাফর ইকবালরা মুরগীর সাইজ দেখাতে নিচের হাতটি রাখতে ভুলে যান। মোহাম্মদ এ. আরাফাত অবশ্য সরাসরি সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, কোনো রাখঢাক রাখেন না। কিন্তু ড. জাফর ইকবাল শুরুতেই বলে নেন, তিনি রাজনীতি বুঝেন না। জাতিকে মাথাপিছু আয় নামক মুরগির এই সাইজটি দেখাতেও তিনি শুরুতে বলেছেন, তিনি অর্থনীতি বুঝেন না।
ধনী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ তৃতীয় এবং অতি ধনী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ প্রথম, নামি দামি বিশ্ব সংস্থার এই পরিসংখ্যানের মাহাত্ম এই জাফর ইকবালরা বুঝেন না। দেশ থেকে গত বারো বছরে যে আট লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে, সেই হিসাব তিনি বুঝেন না। শেয়ার বাজার থেকে যে এক লাখ কোটি টাকা উধাও হয়ে গেছে, সেই খবর তিনি রাখেন না। দেশের জব মার্কেটে যে কয়েক লাখ ইন্ডিয়ান ঢুকে পড়েছে এবং তার বিপরীতে দেশে যে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার সৃষ্টি হয়ে পড়েছে, সেই হিসাব তিনি বুঝেন না। এক কোটি শ্রমিক বিদেশে গতর খেটে যে টাকা আনছে এবং এই কয়েক লাখ ইন্ডিয়ান তার একটা সিংহভাগ নিয়ে যাচ্ছে সেই জটিল হিসাব তিনি বুঝেন না।
তিনি শুধু বুঝেন শেখ হাসিনার উন্নয়নের জোয়ার নিয়ে পাকিস্তানের যদুমধুর টেস্টিমনিয়াল!
সামাজিক মাধ্যমের উপর এক ধরণের গোস্বা মিশ্রিত অনীহা তিনি পোষণ করেন এবং সুযোগ পেলেই পাঠকদের তা জানিয়ে দেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপর এই প্রফেসর সাবের গোস্বার কারণটি সহজেই অনুমেয়। ব্রাহ্মণ শ্রেণীটি নমঃশূদ্রদের দিকে যে চোখে তাকায় বা যে ভঙ্গিতে তাকায় আমাদের এই সুশীল ব্রাহ্মণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপর একই শ্যেন দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন। এ সম্পর্কে তার বাক্য ক’টি লক্ষ্য করুন, “আমি কয়েকদিন খবরের কাগজের দিকে চোখ রাখলাম, দেখলাম সেটা অন্যান্য সংবাদপত্র তেমনভাবে প্রচার করলো না। আমি সব পত্রপত্রিকা পড়ি না, টেলিভিশন দেখি না, তাই যারা দেশের খবরাখবর রাখেন তাদের জিজ্ঞেস করলাম, তারাও সেভাবে জানেন না, কয়েকজন আমার কাছ থেকেই প্রথম শুনলো। আমি নীতিগতভাবে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে কী লেখালেখি হচ্ছে সেটা জানার চেষ্টা করি না, সেখানে কী হচ্ছে সেটা জানার আমার কোনও কৌতূহল হয়নি।”
অতি চালাকের গলায় দড়ি। সেই দড়িটির প্রান্ত দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। এই নাছোড়বান্দা মাধ্যমটি জাফর ইকবালদের বুদবুদটি ফুটো করে দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সিটিজেন সাংবাদিকতার প্রসারে জাফর ইকবালরা সঙ্গত কারণেই আতংকিত।
আওয়ামীলীগের যেটাকে শক্তি বলে মনে হয় সেটিই আসলে তাদের মূল দুর্বলতা। এই সব বুদ্ধিজীবীকুল আওয়ামী লীগের এসেট না লায়াবিলিটিজ, সেটিও অতি শীঘ্রই স্পষ্ট হবে। জোর করে ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে আওয়ামীলীগের নৈতিক অবস্থান এমন পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে যে কোনওভাবে একবার পা পিছলে গেলে এই আওয়ামীলীগের নাম নেয়ার মত কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে কি না যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আওয়ামী লীগের এই সকল ছলনার বিপরীত প্রতিক্রিয়া হবে না, তা হয় না। পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না- এই দাদাদের ছাড়বে কেন?