Site icon The Bangladesh Chronicle

পদ্মা সেতু: উদ্বোধনের পরেই পরিবহন আর কৃষিতে ব্যাপক পরিবর্তনের প্রত্যাশা

 

  • রাকিব হাসনাত
  • বিবিসি বাংলা, ঢাকা

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,
আগামী ২৫শে জুন সেতুটি উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কাছে মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত সোয়া ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটি আগামী পঁচিশে জুন যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার পর পুরো অঞ্চল জুড়ে কৃষি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক পরিবর্তনের আশা করা হচ্ছে।

সেতুর উদ্বোধন সামনে রেখে বছর খানেক থেকেই অনুযায়ী নানা ধরণের কাজ শুরু করেছিলেন কৃষির সাথে জড়িত কৃষক, ব্যবসায়ী ও খামারিরা। বড় ধরনের বিনিয়োগ করেছেন পরিবহন খাতের ব্যবসায়ীরা।

যশোর খুলনাসহ বেশ কয়েকটি জেলায় উদ্যোক্তারা আগে থেকেই বিনিয়োগ বাড়িয়েছিলেন যাতে করে সেতু উদ্বোধনের পরপরই এর সুফল পাওয়া যায়।

পদ্মা সেতুর এক প্রান্ত মাওয়া আর অপর প্রান্ত শরিয়তপুরের জাজিরা। শরিয়তপুর এই প্রথম ঢাকার সাথে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ পাচ্ছে।

সেখানকার বাস মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ আব্দুল খালেক পালোয়ান বলছেন ১৭২ টি নতুন বাস তারা প্রস্তুত করছেন যেগুলো ধাপে ধাপে চালু হবে ঢাকা-শরিয়তপুর সড়কে।

“এখানে সবার মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। কারণ প্রতিটি ক্ষেত্রের মানুষ যে কোন ধরণের প্রয়োজনে ঢাকায় আসা যাওয়া করতে পারবে। এখানকার মাছ কখনো ঢাকার বাজারে যেতে পারেনি। অথচ হাজার হাজার টন মাছ হয় এখানে। চিকিৎসা থেকে আরম্ভ করে ব্যবসা-সব কিছুই পাল্টাবে এখন,” উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে তিনি বলছিলেন বিবিসি বাংলাকে।

বিবিসি বাংলায় আরও পড়ুন:

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,নিজস্ব অর্থায়নে সেতুটি নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ।

অর্থনীতিবিদ ও গবেষক গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন পদ্মা সেতুর প্রাথমিক প্রভাব পড়বে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি খাতে আর দীর্ঘমেয়াদী সুফল আসলে ভারী শিল্পখাতে।

“মংলা বন্দর সচল হয়েছে। কাজ শুরু হয়েছে পায়রা বন্দরে। দুটিই দক্ষিণাঞ্চলে। তবে শুরুতেই বড় গতিশীলতা আসবে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে। সেতুর কারণে সব ধরণের কৃষিপণ্য তাদের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বাজারে দ্রুত যেতে পারবে। শুধু ঢাকা নয়, বরং বড় বড় জেলাশহরগুলোতেও তাদের পণ্য যাওয়ার সুযোগ পাবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

প্রসঙ্গত, পদ্মা সেতু নির্মাণের আগে করা সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন করা হয়েছিলো কয়েকটি। এর মধ্যে সরকারি ও জাইকার করা দুটি প্রতিবেদনে আভাস দেয়া হয়েছিলো যে সেতুটি হলে দেশের জিডিপি বাড়বে এক দশমিক দুই শতাংশ।

কৃষি আর পরিবহনে প্রাণচাঞ্চল্য

পদ্মা সেতুর কারণে যে জেলাগুলো সরাসরি লাভবান হবে বলে আশা করা হচ্ছে সেগুলো হলো খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা। বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি এবং ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী।

বিশেষ করে খুলনা ও বাগেরহাটের মাছ, যশোরের সবজি আর ফুল, বরিশালের ধান ও পান পুরো দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতির ভিত্তি। যদিও সেখানকার প্রতিটি জেলাতেই ধান ও মাছ চাষ করা হয়। নদী এলাকা বলে প্রাকৃতিক উৎস থেকেও আসে বিপুল পরিমাণ মাছ।

খুলনার উদ্যোক্তা তরিকুল ইসলাম বলছিলেন যে এসব মাছ ঢাকার বাজারে নেয়া ছিলো বড় চ্যালেঞ্জ। এখন সেটিই সহজ হবে বলে আশা করছেন ওই অঞ্চলের মাছ চাষিরা।

যশোরের গদখালীর ফুল ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি হয়। আবার দেশের সবজির বাজারের বড় একটি অংশই আসে যশোর অঞ্চল থেকে।

ছবির ক্যাপশান,পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সেতু

দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর আগে থেকেই ওই অঞ্চল বিনিয়োগ আছে। যেটি তারা আরও সম্প্রসারণ করেছেন এই পদ্মা সেতুকে সামনে রেখেই।

গবেষক গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন পদ্মা সেতুর যোগাযোগের বড় দিগন্ত উন্মোচন করবে এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই যোগাযোগ সুবিধাকে অর্থনৈতিক সুবিধায় রূপান্তর করতে গ্যাস, বিদ্যুতসহ অন্য অবকাঠামোতেও নজর দিতে হবে।

“পদ্মা সেতু দিয়ে দ্রুত এসে ঢাকার প্রবেশ মুখে যদি মাছ নিয়ে যানবাহনকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হয় তাহলে সম্পূর্ণ সুফল নেয়া যাবে না। তাই শুরু থেকেই সতর্ক হতে হবে,” বলছিলেন তিনি।

মিস্টার মোয়াজ্জেম বলছেন খুলনার মংলায় ও পটুয়াখালীর পায়রায় বন্দর সচল আছে। তাই ভবিষ্যতে ভারী শিল্প গড়ে উঠবে সেখানে।

খুলনার উদ্যোক্তারা বলছেন যে ইতোমধ্যেই মংলা বন্দর এলাকায় বেশ কয়েকটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি চালু হয়েছে এবং গড়ে উঠছে গার্মেন্টসসহ রফতানিমুখী শিল্প।

একদিকে বন্দর আর অন্যদিকে ঢাকার সাথে সরাসরি যোগাযোগে সময় কমে আসা পুরো অঞ্চলের অর্থনীতি ও জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলবে বলেও মনে করা হচ্ছে।

খুলনার শিক্ষক ইশরাত জাহান বলছেন ঢাকা আসা যাওয়ার কষ্ট আর থাকবে না-এটিই স্বস্তির।

পিরোজপুরের গৃহিনী সালমা ইসলাম বলছেন মাওয়া ঘাটেই ২/৩ ঘণ্টা লাগতো। আর ঢাকা থেকে পিরোজপুরেই আসবো ৪/৫ ঘণ্টায়।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প

এখন ঢাকার গাবতলী থেকে পাটুরিয়া ফেরি হয়ে পদ্মা পাড়ি দিয়ে বরিশালের দূরত্ব ২৪২ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু চালুর পর সায়েদাবাদ থেকে এই শহরটির দূরত্ব হবে ১৫৬ কিলোমিটার।

আবার গাবতলী থেকে পাটুরিয়া হয়ে ঝিনাইদহ, যশোর হয়ে খুলনার এখনকার দূরত্ব ২৯২ কিলোমিটার হলে সেতু চালুর পর সেই দূরত্ব কমে হবে ২৪৭ কিলোমিটার।

দুই এলাকার পরিবহন ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যেই তাদের বাস ভাড়া কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন।

পদ্মা সেতু নিয়ে কিছু তথ্য

* পদ্মা সেতুতে গাড়ির লেন থাকবে একেক পাশে দুটো করে এবং একটি ব্রেকডাউন লেন। অর্থাৎ মোট ছয় লেনের ব্রিজ হচ্ছে, যদিও একে বলা হচ্ছে ফোর লেনের ব্রিজ।

* পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য (পানির অংশের) ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। তবে ডাঙার অংশ ধরলে সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য প্রায় নয় কিলোমিটার।

* দ্বিতল পদ্মা সেতুর এক অংশ পড়েছে মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায়, আরেক অংশ শরীয়তপুরের জাজিরায়।

* সেতুর উপরের অংশ দিয়ে গাড়ি চলাচল করবে, রেল চলবে নিচের অংশে।

* পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ করা হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি।

Exit mobile version