Site icon The Bangladesh Chronicle

পথে বসেছে নয়নের পরিবার

নূরে আলম জিকু, বাঞ্ছারামপুর থেকে ফিরে

২৫ নভেম্বর ২০২২, শুক্রবার

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চরশিবপুর। চারপাশে নদী। গ্রামের মধ্যদিয়ে বয়ে গেছে খানা-খন্দে ভরা আঁকা-বাঁকা মেঠোপথ। বর্ষা মৌসুমে চরশিবপুরের রাস্তা থাকে কর্দমাক্ত। শহরের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। এখানকার মানুষ কৃষি জমি আর মৎস্য শিকারের উপর নির্ভরশীল। মৎস্য শিকার করেই সংসার চালান তারা। তাদেরই একজন সোনারামপুর ইউনিয়নের শিবপুর গ্রামের রহমত উল্লাহ’র ছেলে নয়ন। দরিদ্র পরিবারের আয়ের একমাত্র অবলম্বন। গত শনিবার লিফলেট বিতরণকালে পুলিশের ছোড়া গুলিতে মারা যান তিনি।

তার মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়েছে পুরো পরিবার। শোকে মুর্চ্ছা যাচ্ছেন বাবা-মা ও তার স্ত্রী। নয়নের শোকে স্তব্ধ পুরো বাঞ্ছারামপুর।

গত বুধবার সরজমিন দেখা যায়, নয়নের নানাবাড়িতে চলছে শোকের মাতম। মামার ঘরে স্ত্রী সাজিদ। তার ২ বছর বয়সী ফুটফুটে সন্তান আলিফকে নিয়ে বিলাপ করছেন। পাশেই বিলাপ করছেন তার মা। গ্রামের মানুষ সেখানে ভিড় করছেন। শান্ত¡না দেয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছেন গ্রামবাসী, স্বজনরা। এক বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে নয়ন দ্বিতীয়। আর্থিক সংকটের কারণে প্রাইমারিও শেষ করতে পারেননি। নিজস্ব জায়গা জমি নেই। নেই থাকার জন্য ঘরও। নানার বাড়িতেই থাকতেন সপরিবারে। বড় বোন প্রতিবন্ধী। বাবার কাজে সহায়তার জন্য পড়াশুনা ছেড়ে মাছ ধরে সংসার চালাতেন। কখনো কখনো ঢাকায় বিভিন্ন কাজ করতেন। কয়েক বছর আগে বিয়ে করেছেন। ২ বছরের এক পুত্র সন্তান রয়েছে তার। এক সময় জড়িয়ে পড়েন রাজনীতির সঙ্গে। গ্রামের ভদ্র-নম্র হিসেবে পরিচিতি ছিল তার। গত শুক্রবার ঢাকা থেকে প্রতিবন্ধী বোনের বিয়ের জন্য গ্রামে যান। বিয়ের পরদিন সকালে নদীতে মাছ ধরেন। দুপুরে উপজেলার মোল্লাবাড়ি এলাকায় লিফলেট বিতরণকালে পুলিশের গুলিতে মারা যান।

ঘটনার দিন বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় নয়ন তার একমাত্র ছেলে আলিফকে কোলে নেন। ছেলে বিস্কুট খাওয়ার জন্য বায়না ধরে। খাবার নিয়ে রাতে বাসায় ফেরার কথা ছিল তার। বাড়ি ফেরার আগেই পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার সংবাদ আসে চরশিবপুরে। নয়নের স্ত্রী সাজিদা আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে মানবজমিনকে বলেন, ছেলের খাবার নিয়ে আর আসেনি নয়ন। আমার ছেলেকে এতিম করে দিলো তারা। আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হারিয়ে গেছে। বাড়ি থেকে তরতাজা গেলেও নিথর দেহ ফিরেছে। স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে সাজিদা বলেন, যারা আমার স্বামীকে হত্যা করেছে। ২ বছরের বাচ্চাকে এতিম করেছে তাদের বিচার চাই। তাদের ফাঁসি চাই। নয়ন তো অন্যায় কিছু করেনি। লিফলেট বিতরণ করেছে, এই জন্য কি মানুষকে গুলি করে হত্যা করতে হবে? ২ বছরের ছেলে- বাবার ছবি নিয়ে বারবার চুমু খাচ্ছে। বাবা বাবা বলে চিৎকার করছে।

নয়নের মা তাছলিমা বেগম বলেন, আমার ছেলে তার বোনের বিয়ে খেতে ঢাকা থেকে বাড়ি আসে। একদিন পরেই তাকে গুলি করে হত্যা করেছে পুলিশ। বোনের বিয়ে আর খেয়ে যেতে পারেনি। আদরের নাতিটাকে এতিম করে চলে গেল। এখন আমাদের কি হবে? কে সংসার চালাবে? আমরা সবই হারিয়ে ফেলেছি। নয়নকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই। স্থানীয়রা বলেন, পরিবারে অভাব-অনটনের কারণে জয়গা-জমি ও ঘর করতে পারেনি নয়ন। অন্যের ঘরে আশ্রিত হিসেবে থাকতো। নয়নের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে পুরো পরিবারটি আবারো পথে বসে গেল।

এর আগে বিএনপিকর্মীরা ২৬শে নভেম্বর কুমিল্লায় বিএনপি’র বিভাগীয় সমাবেশ সফল করতে মোল্লাবাড়ি এলাকায় লিফলেট বিতরণকালে পুলিশ তাদের ওপর গুলি ছুঁড়লে সোনারামপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহ-সভাপতি নয়ন মিয়া গুলিবিদ্ধ ও পৌর যুবদলের আহ্বায়ক ইমান আলী আহত হন। পরে স্থানীয়রা আহতদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে গুলিবিদ্ধ নয়নকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকায় পাঠানো হয়। সন্ধ্যার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।

Exit mobile version