Site icon The Bangladesh Chronicle

পণ্যের দাম কমেছে, যেভাবে আরও কমতে পারে

চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেট বন্ধে প্রচার–প্রচারণা চালাচ্ছে ছাত্ররা।

গত কয়েক দিনে দেশে পণ্যমূল্য বেশ কিছুটা কমেছে। মূলত পুলিশ ও সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজি বন্ধ থাকায় পণ্যের দাম কমেছে বলে বলা হয়েছে। আমাদের দেশে পণ্যমূল্য যে কেবল চাহিদানির্ভর নয়, এ ঘটনা থেকে বিষয়টি আবারও বোঝা যাচ্ছে।

বিষয়টি হলো ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর দেশ পুলিশ-শূন্য হয়ে পড়েছিল। গত দুই দিনে তারা আবার আংশিক কার্যক্রম শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও মাঠে নেই। পুরোনো সিস্টেম বা ব্যবস্থার এখনো পুনঃপ্রবর্তন হয়নি। অর্থাৎ উৎস থেকে বাজারে পণ্য আনতে যে দফায় দফায় চাঁদা দিতে হতো, সেই বাস্তবতা এখন নেই। বিএনপি নেতা-কর্মীরা বাজার-রাস্তাঘাটের দখল নেওয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু আন্দোলনকারী ছাত্ররা এই বিজয় এত সহজে হাতছাড়া হতে দিতে নারাজ। তাঁরা এখনো সজাগ।

রাজধানীজুড়ে এখন গ্রাফিতি আঁকার ধুম পড়েছে। আন্দোলনের বিভিন্ন মুহূর্তের গ্রাফিতি আঁকার পাশাপাশি ছাত্রছাত্রী বিভিন্ন আহ্বান-সংবলিত দেয়াললিখন করছেন। যেমন চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেটমুক্ত দেশ গড়ি। এখন থেকে কেউ চাঁদা দেবেন না। ছাত্ররা বাজারে বাজারে ঘুরছে; দোকানি ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলছে। এই পরিস্থিতিতে বাজারে তার প্রভাব অনুভূত হচ্ছে। পণ্যমূল্য কমেছে।

গতকাল রাজধানীর মধুবাগে মাইকিং করতে শোনা যায়: এখন থেকে কেউ চাঁদা দেবেন না। এমনকি এমন মাইকিংও হতে শোনা যায় যে বিএনপির কোনো নেতার নাম ভাঙিয়ে কেউ চাঁদা দাবি করলে, তাঁকে যেন উত্তমমধ্যম দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সোপর্দ করা হয়। পরিস্থিতির চাপেই এমনটা হচ্ছে, তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না।

এ তো গেল একটি অংশ। দ্রব্যমূল্যের আরও কিছু বিষয় আছে, সেগুলো আমলে না নিলে সামগ্রিকভাবে দেশের বাজারব্যবস্থার বিশেষ উন্নতি হবে না। যেমন মধ্যস্বত্বভোগী। দেশের ব্যবসায়ীরা বলেন, উৎস থেকে পণ্য পাইকারি বাজার পর্যন্ত আসতে অন্তত চারবার হাতবদল হয়। যতবার হাতবদল হয়, ততবার পণ্যের দাম বাড়ে। এই পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে অনেক মানুষ যুক্ত। এর সঙ্গে অনেকের রুটিরুজি জড়িত; কিন্তু এই ব্যবস্থা ভাঙা না গেলে সামগ্রিকভাবে পণ্যের দামে বিশেষ প্রভাব পড়বে না বলেই ধারণা করা যায়।

দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শুল্ক। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে এক কেজি চিনি আমদানিতে ৪৩ টাকা কর দিতে হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ফল আমদানিতেও গত কয়েক বছরে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। পেঁয়াজ আমদানিতেও সময়-সময় শুল্ক বাড়ানো-কমানো হয়। এমনকি চাল আমদানিতেও একসময় ৬০ শতাংশের বেশি শুল্ক দিতে হতো। পরবর্তীকালে তা কমানো হয়েছে। ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদেরা বারবার বলে আসছেন, উচ্চ শুল্ক থাকলে পণ্যমূল্য কমানো কঠিন।

সমস্যা হচ্ছে, সরকারের রাজস্ব আয়ের প্রায় ৬৫ শতাংশই আসে পরোক্ষ কর থেকে। মূল্য সংযোজন কর ও আমদানি শুল্ক থেকে বড় অঙ্কের রাজস্ব আয় করে সরকার। এই শুল্কের ভার সব শ্রেণির মানুষেরই ওপর পড়ে; এ ক্ষেত্রে ধনী-গরিবের ভেদাভেদ নেই। রাজস্ব আয়ের দিক পরিবর্তন করে দেওয়া গেলে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ হতে পারে, অর্থাৎ পরোক্ষ করের পরিবর্তে প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধি করা।

বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েক দফা নীতি সুদহার বাড়িয়েও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। তারা একদিকে নীতি সুদহার বাড়িয়েছে, আরেক দিকে নোট ছেপে সরকারকে ঋণ দিয়েছে। যদিও একসময় তারা এই নীতি থেকে সরে আসে। নীতি সুদহার বাড়িয়েও যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, তার মূল কারণ বাজারব্যবস্থা ও শুল্ক নীতি। সেই সঙ্গে কখন কোন পণ্য আমদানি করতে হবে, সে বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সময়মতো উদ্যোগ থাকা জরুরি।

বৈষম্য

পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বাজারের সিন্ডিকেট ভাঙার পাশাপাশি পরোক্ষ কর নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বলা যায়, এটাই হবে সবচেয়ে বিপ্লবী কাজ। গত ১৫ বছরে দেশের জিডিপি দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। কিন্তু আয়কর-জিডিপির অনুপাত সে হারে বাড়েনি। সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রীর ভাষ্য, ২০০৯-১০ সালে দেশে জিডিপি-আয়করের অনুপাত ছিল ১ শতাংশ; এখন তা সামান্য বেড়ে ১ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এতে বৈষম্য বেড়েছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি; এতে গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়েছে।

করব্যবস্থার কারণেও বৈষম্য বাড়ছে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেও করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। সেই সঙ্গে ব্যক্তি করদাতাদের সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশই রাখা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির সর্বোচ্চ করহার ৩০ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে তা আবারও ৩০ শতাংশে উন্নীত করার প্রস্তাব দেওয়া হলেও শেষমেশ তা অপরিবর্তিত রাখা হয়। এই করও ঠিকঠাক আদায় করা হয় না। মানুষের ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা তো আছেই।

এ ছাড়া কোম্পানির নামে কেনা গাড়ির পরিবেশ সারচার্জ মওকুফ করা হয়েছে। সমাজের বিত্তবানেরা সাধারণত নিজ নামে গাড়ি কেনেন না; তাঁরা কোম্পানির নামে কেনা গাড়ি ব্যবহার করেন। এর মধ্য দিয়ে ধনীদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তবে ব্যক্তিমালিকানাধীন একের অধিক মোটরগাড়ির ক্ষেত্রে পরিবেশ সারচার্জ প্রযোজ্য থাকছে।

গত ৩০ বছরে অর্থনীতির আকার বড় হয়েছে; কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি বড় হয়নি। বিশাল অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি আয়কর আদায়ের পথে বড় বাধা। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া মানুষ আয়কর দিতে গিয়ে ভোগান্তির মুখে পড়বে না, এমন ব্যবস্থা করতে হবে। আয়কর দেওয়ার প্রবণতা উৎসাহিত করতে মানুষের সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সেটা থাকলে বাকি সব বাধা দূর করা সম্ভব।

দেশে যেভাবে দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে এবং বিপুলসংখ্যক মানুষ যেভাবে এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন, এই বাস্তবতায় সংস্কার খুব কঠিন।

শেষমেশ বলা দরকার, বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির আরেকটি কারণ ক্রেতাদের আচরণ। এক শ্রেণির মানুষের হাতে বিপুল কালো টাকা থাকায় তাঁরা পণ্যের দাম নিয়ে চিন্তিত নন। এতে বাজারে প্রভাব পড়ে। এ কারণে দুর্নীতির চক্র ভাঙা না গেলে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া কঠিন।

prothom alo

Exit mobile version