দ্য ডিপ্লোম্যাট: আপনি আন্দোলন থেকে সরকারে গেছেন, পরে রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন এবং আবার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন। আপনার অভিজ্ঞতা কী?
নাহিদ ইসলাম: একটি সরকারকে ভেতর ও বাইরে থেকে দেখাটা বিস্তর ভিন্ন অভিজ্ঞতা। অন্তর্বর্তী সরকার যখন দায়িত্ব নিল, তখন বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে চ্যালেঞ্জিং সময় ছিল। এটা আমার জন্য একটি বড় অভিজ্ঞতা। সময়ের চাহিদার প্রতি সাড়া দিয়ে আমি পদত্যাগ করেছি এবং মূলধারার রাজনীতিতে যোগ দিয়েছি। এখন এই অভিজ্ঞতা আমি আমার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক যাত্রায় ব্যবহার করতে পারব—বিশেষ করে সামনের পথটা যখন কঠিন বলে মনে হচ্ছে। একটি রাজনৈতিক দলের যাত্রা শুরু করা আমার জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ, তবে এই পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য আমি প্রস্তুত আছি।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: অন্তর্বর্তী সরকারে আপনার দায়িত্ব পালনের সময় আপনারা কতটুকু সংস্কার করতে পেরেছেন?
নাহিদ ইসলাম: আমার স্বল্প মেয়াদে আমরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা ইন্টারনেট কাঠামোর স্তরগুলো নতুন করে বিন্যস্ত করেছি। আইসিটি বিভাগের জন্য সংস্কারের একটি রূপরেখা প্রস্তুত করেছি। আর তথ্যের প্রবাহ যেন আরও ভালো হয়, তা নিশ্চিত করতে নিয়ন্ত্রণ আরোপকারী বিভিন্ন আইন নিয়ে কাজ করেছি। এই সংস্কারগুলোর পুরো প্রভাব হয়তো শিগগিরই দৃশ্যমান না হতে পারে, তবে আমি আত্মবিশ্বাসী—এগুলো দীর্ঘ মেয়াদে দেশের জন্য সুবিধা নিয়ে আসবে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: এনসিপি নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী? এটি কি ডানপন্থী নাকি বামপন্থী দল হবে?
নাহিদ ইসলাম: এগুলোর কোনোটিই নয়। এনসিপি একটি মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল এবং আমরা এই আদর্শ ধরে রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের লক্ষ্য হলো নতুনদের কথা বলার জায়গা করে দেওয়া; বিশেষ করে তরুণ এবং সমাজের সব শ্রেণির ব্যক্তিদের, যাঁরা বছরের পর বছর ধরে গতানুগতিক রাজনীতির বাইরে রয়ে গেছেন।
আমাদের লক্ষ্য হলো একটি গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা করা। এই গণপরিষদের মাধ্যমে আমরা নতুন একটি সংবিধান প্রবর্তন করতে চাই এবং ক্ষমতার ধরনে পরিবর্তন আনতে চাই। আমাদের লক্ষ্যকে আরও সুস্পষ্ট করার জন্য বিভিন্ন ধারণা খতিয়ে দেখছি ও মতামত নিচ্ছি।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: অনেকেই বলছেন, এনসিপি ‘কিংস পার্টি’ এবং সরকারের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নিচ্ছে। এটা কি সত্যি?
নাহিদ ইসলাম: যদি এনসিপি একটি ‘কিংস পার্টি’ হয়, তাহলে আমি কেন সরকার থেকে পদত্যাগ করলাম? আমি থেকে যেতে পারতাম, আমার পদকে ব্যবহার করতে পারতাম এবং সরকারের ভেতরে থেকে রাজনীতি করতে পারতাম।
আমরা সরকার থেকে কোনো বিশেষ সুবিধা নিচ্ছি না। শুধু অভ্যুত্থানে আমাদের ভূমিকার কারণে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো থেকে অনুপ্রেরণা ও স্বীকৃতি পেয়েছি। তা ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার একদলীয় সরকার নয়। এতে বিভিন্ন মতাদর্শের লোকজন রয়েছেন। ফলে সব দল সরকারের কাছ থেকে একই আচরণ পাচ্ছে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: এনসিপি কি জামায়াতে ইসলামীর ঘনিষ্ঠ? তাদের দাবিগুলো একই রকম মনে হচ্ছে। এমনটা আশঙ্কা করা হচ্ছে যে বাংলাদেশে কট্টরপন্থা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে এনসিপি।
নাহিদ ইসলাম: বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি—আমরা সবাই আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচার দাবি করছি। এর অর্থ কী—আমরা সবাই এক বা একে–অপরের ঘনিষ্ঠ? মোটেও না। বিষয়টি যদি তা–ই হতো, তাহলে আমরা একটি জোট গঠন করতাম।
এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামী পুরোপুরি ভিন্ন দল, যাদের পৃথক পৃথক এজেন্ডা রয়েছে। আমাদের মধ্যে কোনো সংযোগ নেই। জামায়াতে ইসলামী আমাদের ঘনিষ্ঠ নয়। আমাদের কিছু দাবি মিলে যেতে পারে, যেমন আমরা সংস্কার আগে করার, গণপরিষদ প্রতিষ্ঠার এবং বড় পরিসরে কাঠামোগত পরিবর্তনের বিষয়ে অগ্রাধিকার দিই। কিন্তু মৌলবাদের বিষয়ে আমাদের মিল রয়েছে—এমন দাবি হলো মিথ্যা একটি বয়ান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। উদাহরণ হিসেবে বলতে গেলে, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানকে অনেকেই সন্ত্রাসী আন্দোলন তকমা দিয়েছেন, যা পুরোপুরি বিভ্রান্তিকর।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: আপনারা কখন জাতীয় নির্বাচন চান?
নাহিদ ইসলাম: আমাদের গুরুত্বের বিষয়গুলো হলো পূর্ববর্তী সরকারের অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা, দেশে একটি স্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিশ্চিত করা এবং গণপরিষদ গঠন করা। আমরা সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের পক্ষে, যাতে ফ্যাসিবাদী শাসন আবার ফিরে আসতে না পারে। তাই একটি নির্বাচন আমাদের তাৎক্ষণিক অগ্রাধিকার নয়। বর্তমানে নির্বাচনের জন্য আমরা কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা দিচ্ছি না।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: আপনার নতুন দলের সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে?
নাহিদ ইসলাম: প্রথমত, বাংলাদেশে অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল রয়েছে। এটা তাদের সঙ্গে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কঠিন করে তুলবে, বিশেষ করে নির্বাচনের আগে সীমিত সময়ের মধ্যে। (নির্বাচনের) নির্দিষ্ট তারিখ অনিশ্চিত হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ইঙ্গিত দিয়েছেন, ২০২৫ সালের শেষে বা ২০২৬ সালের মাঝামাঝিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছানো আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। ক্যাম্পাস ও শহরের রাজনীতি থেকে গ্রামের রাজনীতি ভিন্নভাবে পরিচালিত হয় এবং এখানে ভিন্ন পদ্ধতিতে এগোতে হয়। আগামী মাস থেকে আমরা ঢাকার বাইরে প্রচার শুরু করতে যাচ্ছি।
তা ছাড়া এটা দেশের জন্য একটি কঠিন সময়। তাই জনগণের দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকারের ওপর চাপ তৈরির জন্য আমাদের অবশ্যই সক্রিয় থাকতে হবে। এর পাশাপাশি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মধ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হবে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: এনসিপি কোন ধরনের ‘সেকেন্ড রিপাবলিকের’ কথা ভাবছে?
নাহিদ ইসলাম: সেকেন্ড রিপাবলিকের ক্ষেত্রে আমাদের প্রাথমিক দাবি হলো একটি নতুন সংবিধান। এর জন্য গণপরিষদ প্রতিষ্ঠা দরকার। এই সংবিধান হবে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনার আলোকে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সীমাহীন ক্ষমতা প্রত্যাহারসহ ক্ষমতার একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা এবং স্বাধীন বিচারব্যবস্থার পক্ষে সোচ্চার রয়েছি।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: বাংলাদেশের কূটনীতির বিষয়ে এনসিপির অবস্থান কী? দলটি কি দেশকেন্দ্রিক রাজনীতির সঙ্গে থাকবে?
নাহিদ ইসলাম: প্রথম ও সর্বাগ্রে আমরা চাই, বাংলাদেশ যেকোনো বিদেশি শক্তির আধিপত্যমুক্ত থেকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও লাভজনক কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলবে। অতীতে আমরা বিভিন্ন সরকারকে নয়াদিল্লির প্রভাবের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়তে দেখেছি। আমরা বাংলাদেশের রাজনীতিকে ভারত বা পাকিস্তানকেন্দ্রিক হতে দেব না। এনসিপি পুরোপুরি বাংলাদেশকেন্দ্রিক থাকবে, সবার ওপরে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: আপনার দল কি আওয়ামী লীগকে রাজনীতি বা পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নিতে দেবে?
নাহিদ ইসলাম: না, আমরা চাই না আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিক। প্রথমত, দলটির ভেতরে যাঁরা অন্যায় কাজের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে।