দীর্ঘদিন ধরেই দেশে ডলার সংকট চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন মুদ্রাটির ক্রাইসিস আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। অন্যদিকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ মিম্নমুখী। আবার রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধিও ধীর গতি। ফলে ধারাবাহিকভাবে কমছে বিদেশি মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ। এ কারণে নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রিজার্ভ বাড়াতে বেসরকারি ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব ‘গ্রস’ হিসাবে ২০২১ সালের আগস্টে যেখানে রিজার্ভে ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার, এখন তা ২৫.১৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আর আইএমএফ স্বীকৃত বিপিএম৬ পদ্ধতিতে হিসাব করলে ২৩শে নভেম্বর দিন শেষে বাংলাদেশের রিজার্ভ আছে ১৯.৫২ বিলিয়ন ডলার। এরমধ্যে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের কম বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে খোলাবাজারে ডলারের দাম এখন ১২৫ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হচ্ছে। কয়েকদিন আগে ১২৮ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। অর্থনীতিবিদরা বলেন, রিজার্ভ এখন যে পর্যায়ে নেমেছে, তা সংকটজনক না হলেও উদ্বেগজনক।
জানা গেছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দেশে ডলারের সংকট শুরু হয়, যা এখনো চলমান। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ২০২২ সাল থেকেই বিশ্বব্যাপী জ্বালানি, ভোগ্যপণ্য ও পরিবহন খাতে খরচ বেড়ে যায়। ফলে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের আমদানি খরচ আগের তুলনায় অনেক বাড়ে। তবে সে তুলনায় দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়েনি। এতে আমদানির জন্য ডলারের যে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়, তা চাপ তৈরি করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর। কারণ, জরুরি জ্বালানি, খাদ্যপণ্য, রাসায়নিক সারসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানির দায় মেটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। এ ছাড়া দেশ থেকে টাকা পাচারও ডলার সংকটের অন্যতম কারণ। এদিকে ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি গত দেড় বছর ধরে বিভিন্ন চাপের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। সেই চাপ সামাল দিতেই রিজার্ভ থেকে বাজারে ডলার সহায়তা দিয়ে চলছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে করে দেশের রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। এজন্য রিজার্ভ বাড়াতে বেসরকারি ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, আগামী ৭ই জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রিজার্ভ বাড়াতে ডলার খুঁজছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইতিমধ্যেই গত সোম ও মঙ্গলবার আর্থিক সংকটে থাকা ইসলামী ব্যাংক থেকে ৭ কোটি ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অথচ বেশির ভাগ ব্যাংকই ডলার ঘাটতিতে থাকায় তারা এলসি খুলতে হিমশিম খাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক গণমাধ্যমকে বলেন, আন্তঃব্যাংক বিনিময় হারে গত সোমবার পাঁচ কোটি ডলার ও মঙ্গলবার দুই কোটি ডলার ইসলামী ব্যাংক থেকে কেনা হয়েছে। তিনি বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় অতিরিক্ত ডলার থাকলে আমরা তাদের কাছ থেকে তা কিনবো। এ ধরনের লেনদেন স্বাভাবিক। আমাদের রিজার্ভ বাড়াতে হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ১ থেকে ২৪শে নভেম্বরের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকে রেমিট্যান্স এসেছে ২৮ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশ করা তথ্যে দেখা গেছে, গত বুধবার পর্যন্ত বিপিএম৬ অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৯.৫২ বিলিয়ন ডলার। সেদিন মোট রিজার্ভ ছিল ২৫.১৬ বিলিয়ন ডলার। গত সপ্তাহে রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেলেও বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম বেড়ে যাওয়ায় তা আবার বেড়ে ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। কারণ হিসেবে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের অর্থ বিদেশে বিভিন্ন বন্ড, মুদ্রা ও স্বর্ণে বিনিয়োগ করে রেখেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায় বর্তমানে ৫০ মিলিয়ন ডলার, আইএমএফ’র ঋণ রয়েছে গত জুন পর্যন্ত ৩.৩৭ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর বিদেশি মুদ্রা ক্লিয়ারিং (এফসি) হিসাবে লেনদেন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে ১০০ কোটি ডলার। এসব দায় বাদ দিতে বলেছে আইএমএফ। ফলে এসব দায় বাদ দিলে প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দাঁড়ায় ১৬ বিলিয়ন ডলারের কিছু কম। দেড় বছরের বেশি সময় ধরে রিজার্ভ কমতে থাকার এ প্রবণতা বজায় থাকলে আগামীতে অর্থনীতি কতোটা চাপে পড়বে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন অর্থনীবিদরাও।
আইএমএফের হিসাবে স্বাভাবিক সময়ে একটি দেশের ৩ থেকে ৫ মাসের আমদানি দায় মেটানোর মতো রিজার্ভ থাকলে তা স্বস্তিদায়ক হিসেবে ধরা হয়। গড়ে প্রতি মাসে সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার বিদেশি দায় সৃষ্টি হলে, বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে ৪ মাসের ব্যয় মেটানো যাবে। আর আইএমএফের হিসাবে তা দিয়ে ৩ মাসের দায় মেটানো সম্ভব।
যেভাবে রিজার্ভ বাড়ে: বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের মূল উৎস প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ের উদ্বৃত্ত ডলার ব্যাংকগুলো থেকে কিনে নেয়া। এ ছাড়া বিদেশি ঋণ, বিনিয়োগ, অনুদান থেকে পাওয়া অর্থ সরাসরি যুক্ত হয় রিজার্ভে। পাশাপাশি জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনীর আয়ও সরাসরি রিজার্ভে যুক্ত হয়।
যেভাবে কমে রিজার্ভ: অন্যদিকে চাহিদা বেড়ে গেলে ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখনো সরকারি খাতের খাদ্য, জ্বালানি, রাসায়নিক সার আমদানির দায় মেটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি বিদেশি ঋণ ও চাঁদার অর্থও পরিশোধ হয় রিজার্ভের অর্থে। এ ছাড়া প্রতি দুই মাস অন্তর আকুর সদস্য দেশগুলোর আমদানি দায় পরিশোধ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ব্যাংকগুলো নিয়মিত ভিত্তিতে এই দায়ের অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা করে, যা সংস্থাটি একবারে শোধ করে দেয়।
দেড় বছর ধরে চলা ডলার সংকট এখনো কাটেনি। আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে গত সেপ্টেম্বরে আমদানি খরচ কমে হয়েছে ৫২৭ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৭ শতাংশ কম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা এখনো ঋণপত্র খুলতে চাহিদামতো ডলার পাচ্ছে না। আবার অনেক উদ্যোক্তাকে ঘোষিত দামের চেয়ে ১২-১৩ টাকা বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে।
এদিকে গত অক্টোবরে রপ্তানি আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ১৩ শতাংশ কমে হয়েছে ৩৭৬ কোটি ডলার।
তবে গত মাসে রেমিট্যান্স প্রায় ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, এসেছে ১৯৭ কোটি ডলার। এদিকে চলতি মাসের ২৪ দিনে ১৪৯ কোটি ২৯ লাখ ৪০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। অক্টোবর মাসে দেশে রেমিট্যান্স আসে ১৯৭ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। সেপ্টেম্বরে আসে ১৩৩ কোটি ৪৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার।
গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস এসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে। সম্প্রতি ডলারের দাম ৫০ পয়সা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংগঠন দুটি। এই সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে সমর্থন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কিনতে ডলারের দাম এখন সর্বোচ্চ ১১০ টাকা। আর আমদানি দায় মেটাতে প্রতি ডলার ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। তবে রেমিট্যান্সে সরকারের ২.৫ শতাংশ প্রণোদনার পাশাপাশি ব্যাংকও একই পরিমাণ প্রণোদনা দিতে পারবে। ফলে প্রবাসী আয় পাঠালে ডলারপ্রতি সর্বোচ্চ ১১৫ টাকা ৫০ পয়সা পাবেন উপকারভোগীরা।
অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখত বলেন, বিদেশি সহায়তা যদি সেভাবে না আসে, নির্বাচন নিয়ে কোনো ইস্যু চলে আসে, তাহলে আমরা আরেকটু টাইট সিচুয়েশনে পড়ে যাবো।