Site icon The Bangladesh Chronicle

নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কঠোরভাবে দমন করা হচ্ছে বাংলাদেশে

২০২২-১০-১১

বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতি

[বাংলাদেশে নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে গত ১০ অক্টোবর একটি বিবৃতি দিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য আমরা এটি বাংলায় ভাষান্তর করে দিচ্ছি।]

গত ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিএনপির মিছিলে হামলা করে ছাত্রলীগ। ছবি: সংগৃহীত

(নিউ ইয়র্ক)- হিউম্যান রাইটস ওয়াচের আজকে (১০ সেপ্টেম্বর) তথ্য থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশে ২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হওয়ার সাথেসাথে সরকার কর্তৃক নিপীড়ন ও ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের হামলা বেড়ে চলেছে বলে জানিয়েছে বিরোধী দলগুলো। বাংলাদেশ সরকারের উচিত আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সমর্থকদের সমাবেশ ও শান্তিপূর্ণ মিছিলের অধিকার রক্ষা করা।

গণ-গ্রেফতার ও বিরোধী দলের সদস্যদের বাড়িতে ব্যাপক পুলিশি তল্লাশি আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে সহিংসতা ও ভয়ভীতি প্রদর্শন ব্যাপক উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে নির্বাচন প্রচারণার সময়কার সহিংসতা একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। তবে কর্তৃপক্ষ বরাবরই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের যেসব সদস্য ও সমর্থক বিরোধী দলের জনসভায় বাধা দিয়েছে ও কর্মীদের হয়রানি করেছে তাদের বিষয়ে তদন্ত ও বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার বলেছেন যে, বাংলাদেশ একটি পরিণত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং দেশটি নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে সক্ষম। তা সত্ত্বেও বিগত নির্বাচনগুলোতে সহিংসতা, বিরোধী দলের ওপর হামলা এবং ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানোর ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এসব রাজনৈতিক হামলা ও গ্রেফতার আসন্ন সংসদীয় নির্বাচনের জন্য অশুভ সঙ্কেত দিচ্ছে।”

এ বছরের ২২ আগস্ট বিএনপি তেল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ার প্রতিবাদে কয়েক দফা সমাবেশ করার পর থেকে পুলিশ, বিএনপি সমর্থক ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে এ পর্যন্ত অন্তত চারজন মানুষ মারা গেছেন এবং একশোরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন বলে জানা যায়। সাম্প্রতিক অন্যান্য সংঘর্ষের ঘটনায় বিএনপি কর্মীদের নিহত হওয়ার উদ্বেগজনক খবরও পাওয়া যাচ্ছে। দুই পক্ষই অপরপক্ষকে দোষারোপ করছে সহিংসতা শুরু করার জন্য। তবে বিরোধী দলের সমর্থকদের পুলিশ গণহারে গ্রেফতার করলেও ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক যেসব ব্যক্তি এসব সহিংস হামলায় জড়িত ছিলেন তাদের কোনো ধরনের শাস্তি হয়নি।

আহতদের মধ্যে ছিলেন বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এবং ঢাকা উত্তরের সাবেক মেয়র পদপ্রার্থী তাবিথ মোহাম্মদ আউয়াল। আউয়াল ১৭ সেপ্টেম্বর বনানীতে বিএনপি আয়োজিত একটি মোমবাতি মিছিলে অংশ নিচ্ছিলেন। সে সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থকরা পাথর ছুঁড়ে ও অংশগ্রহণকারীদের লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে সমাবেশে হামলা করেন।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে আউয়াল বলেন, “আমার ওপর যারা হামলা করেছে তাদের আমি সহজেই চিনতে পারবো। তারা আওয়ামী লীগের ঢাকা উত্তরের বিভিন্ন কমিটির সদস্য। পুলিশ সেখানে উপস্থিত থাকলেও তারা আমাকে সাহায্য করতে বা হামলা বন্ধ করতে কিছুই করেনি। এমনকি আমি আহত হওয়ার পরও সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি তারা। এমনকি এ ধরনের কিছু যে ঘটেছে, সেটিও পরে বনানী থানার ওসি (অফিস-ইন-চার্জ) অস্বীকার করেছেন।”

কর্তৃপক্ষ বরং এসব সংঘর্ষের পর বিএনপি সমর্থকদের বিরুদ্ধে গণহারে মামলা করেছে। যেমন, ২১ সেপ্টেম্বর এক সংঘর্ষে যুবদলকর্মী শহীদুল ইসলাম শাওন নিহত হন। এই ঘটনায় পুলিশ আসামী সন্দেহে ৩৬৫ জনের বিরুদ্ধে নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরো ১৪০০ জনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের করে। এছাড়া পুলিশ প্রায়ই আগে করা মামলায় পূর্বে অজ্ঞাত ব্যক্তি হিসেবে নতুন ব্যক্তিদের আসামী হিসেবে যুক্ত করে।

বিএনপি নেতাদের মতে, দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অন্তত ২০ হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে, যার মধ্যে অনেক মামলাতেই আসামী অজ্ঞাত। বিপুলসংখ্যক মানুষকে “অজ্ঞাত” হিসেবে উল্লেখ করে ফৌজদারী মামলা দায়ের করা বাংলাদেশের একটি সাধারণ নিপীড়নমূলক চর্চা, যার ফলে পুলিশ যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারে, মামলায় ঐ ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা না থাকলেও একবার গ্রেফতার করা হয়েছে এমন ব্যক্তিকে পরে বারবার গ্রেফতার করতে পারে এবং জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করতে পারে।

অজ্ঞাতনামাদের আসামী করা এসব মামলাকে আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলের সদস্যদের বাড়িতে তল্লাশি চালানোর ওয়ারেন্ট হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন, যা আদতে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক হয়রানি ও ভীতিপ্রদর্শন। সেপ্টেম্বরে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, যুবলীগের একজন নেতা এই বলে হুমকি দিচ্ছেন যে, ক্ষমতাসীন দলের (আওয়ামী লীগের) সদস্যরা বিএনপির আন্দোলন দমন করতে না পারলে “আমরা তল্লাশি শুরু করবো।”

সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করার জন্য বিরোধী দলের প্রবাসী সদস্যদের দেশে থাকা আত্মীয়স্বজনদের ওপর কর্তৃপক্ষের হয়রানিও ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ৯ সেপ্টেম্বর স্থানীয় বিএনপি সদস্য আব্দুল মুক্তাদির মনুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁর লন্ডনপ্রবাসী ভাইয়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদকে সমালোচনা করে দেওয়া এক ফেসবুক পোস্টের সঙ্গে তাঁর “সম্ভাব্য সম্পৃক্ততা” আছে। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৫৪ ধারায় মনুকে আটক করা হয়। অত্যাচারের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এ আইন ব্যাপকভাবে সমালোচিত, কারণ এটি পুলিশকে ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেফতার করার ও আটক ব্যক্তিকে কোনো আইনজীবীর মাধ্যমে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ১৫ দিন পর্যন্ত আটক রাখার সুযোগ দেয়।

বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের দমন-পীড়ন দেশটির সীমানা ছাড়িয়ে আরো দূরে পৌঁছেছে। ১৩ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক অস্থায়ী সংসদীয় কমিটির এক সভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল কালাম আবদুল মোমেন প্রবাসী বাংলাদেশিদের একটি তালিকা দেন, যাঁরা “রাষ্ট্রবিরোধী” কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। এসব ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনার জন্য দূতাবাসগুলোকে আহ্বান জানান তিনি।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মনে করে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দলীয় নেতাদের উচিত রাজনৈতিক সহিংসতাকে নিরুৎসাহিত করা এবং সকল বাংলাদেশির নিরাপদে ও শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়ার ও কোনো আশঙ্কা ছাড়া কর্মক্ষত্রে যাওয়ার অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতি কর্তৃপক্ষকে মত প্রকাশ ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশকে উৎসাহিত করতে আহ্বান জানান। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিটি ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসের বরাত দিয়ে বলে যে, এর ৩৭ নম্বর মন্তব্যটির বিষয়বস্তু হলো শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার। এই মন্তব্য অনুযায়ী রাষ্ট্রকে কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়া নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকারকে “শ্রদ্ধা ও নিশ্চিত” করতে হবে এবং “কোনো ধরনের অযাচিত হস্তক্ষেপ ছাড়া” এসব সমাবেশ হতে দিতে হবে। যদি “কোনো সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে জনতা ক্ষেপে ওঠে”, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সমাবেশ চলতে দেওয়া ও অংশগ্রহণকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

গাঙ্গুলি আরো বলেন, “মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে এবং সামনেই সংসদীয় নির্বাচন থাকায় বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো ক্রমবর্ধমান নজরদারিতে রয়েছে। এ ধরনের নিপীড়ন যে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের শর্ত ভঙ্গ করে, সে বিষয়ে বাংলাদেশে অবস্থানরত কূটনীতিকদের প্রকাশ্যে এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা উচিত।”

Exit mobile version