জানা গেছে, নাসা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান নাসা তাইপে স্পিনার্স ও নাসা স্পিনার্সের ঋণ কিনে ২৬১ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করেছে জনতা ব্যাংক। এই সুদ মওকুফের কারণে ৪১৭ কোটি টাকার বকেয়া ঋণ কমে দাঁড়ায় ১৫৬ কোটি টাকায়। পরে জনতা ব্যাংকের লোকাল অফিসে এই পাওনা পরিশোধ করেন গ্রাহক। কিন্তু এভাবে সুদ মওকুফ অর্থ মন্ত্রণালয় এবং জনতা ব্যাংকের নিয়মের শতভাগ লঙ্ঘন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষকও।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, নাসা তাইপে স্পিনার্স ও নাসা স্পিনার্সের কাছে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের পাওনা ছিল ৪১৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে আরোপিত সুদের ৭ কোটি ৩০ লাখ এবং অনারোপিত সুদের শতভাগ হিসেবে ২৫৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা মওকুফ করা হয়। সুদ মওকুফ-পরবর্তী ১৫৬ কোটি ১২ লাখ টাকা পরিশোধের হিসাব কষা হয়। নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এই সুদ মওকুফ সুবিধা দেওয়ার বিষয়টিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিযুক্ত পর্যবেক্ষক আপত্তি তোলেন। কিন্তু সে আপত্তি আমলে না নিয়েই নাসা গ্রুপকে সুদ মওকুফ সুবিধা দেয় জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। পরে পর্যবেক্ষক লিখিতভাবে বিষয়টি তৎকালীন গভর্নরকে অবহিত করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ৩ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জনতা ব্যাংকের এমডির কাছে ব্যাখ্যা তলব করে চিঠি দেওয়া হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে চিঠির জবাব দেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও তিনি জবাব দেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আবদুল জব্বার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ব্যাংক খাতের বড় সমস্যা ঋণ আদায় না হওয়া। এ জন্য ঋণ আদায়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুদ মওকুফ সুবিধা দিয়ে হলেও আদায়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কেননা, খেলাপি ঋণ আদায় আদালতে গেলেও সুদে বিশেষ ছাড় দিতে হয়। একইভাবে নাসা গ্রুপের ক্ষেত্রেও সুদ মওকুফ করে ঋণ আদায় করা হয়েছে। এর বেশি বলা সম্ভব নয়।’
কেনা ঋণে সুদ মওকুফ
সুদ মওকুফের এ ঋণ জনতা ব্যাংকেই সৃষ্টি হয়েছিল, তা নয়। সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে ২০০৮ সালের ২৭ আগস্ট নাসা তাইপে স্পিনার্সের ৫০ কোটি ৯০ লাখ টাকার প্রকল্প ঋণ অধিগ্রহণ করে জনতা ব্যাংক। একই বছরের ২৩ ডিসেম্বর নাসা স্পিনার্সের ৭০ কোটি টাকার প্রকল্প ঋণ অধিগ্রহণ করা হয় ইসলামী ব্যাংক থেকে। পরবর্তী সময়ে ২০১১ সালের আগস্টে প্রতিষ্ঠান দুটির ঋণ স্থিতির ১১১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা প্রথমবার পুনঃ তফসিল করে ব্যাংক। পরের বছরের মার্চে এ ঋণের প্রথম কিস্তি পরিশোধ করার কথা থাকলেও যথাসময়ে পরিশোধ হয়নি। যে কারণে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ঋণ দুটি মন্দ ও ক্ষতিজনক মানের খেলাপিতে পরিণত হয়। এরপর গ্রাহক উচ্চ আদালতে একের পর এক রিট করে ঋণ দুটি খেলাপিমুক্ত রেখেছেন।
জানা যায়, দীর্ঘদিন অনাদায়ি থাকলেও উচ্চ আদালতে ১১ দফা রিট করে ঋণ নিয়মিত দেখিয়ে আসছিলেন গ্রাহক নজরুল ইসলাম মজুমদার। পরে সুদ মওকুফ সুবিধা পেতে জনতা ব্যাংকে আবেদন করেন তিনি। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এককালীন এক্সিটের আওতায় এই সুদ মওকুফ সুবিধা চাওয়া হয়। ২০২১ সালের মার্চে ৬৫৪তম পর্ষদ সভায় তা অনুমোদন করে জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।
মানা হয়নি নিয়ম
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার আলোকে কেবল চারটি ক্ষেত্রে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের শর্ত শিথিল করার সুযোগ রয়েছে। প্রথমত, বিক্রীত প্রকল্পের সুদ মাফ করা যায়। দ্বিতীয়ত, ঋণের বিপরীতে জামানত, সহ-জামানত এবং উদ্যোক্তার ব্যক্তিগত সম্পদ বিক্রি করেও যদি তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় আদায় না হলে। তৃতীয়ত, পাওনা আদায়ের সব আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার পরও ঋণের টাকা আদায় না হলে। চতুর্থত, ঋণগ্রহীতার আদালতে উত্থাপিত সমুদয় দাবি আসল ঋণের চেয়ে ২০০ শতাংশ বেশি হলে।
কিন্তু এর কোনোটিই নাসা গ্রুপের ক্ষেত্রে মানা হয়নি। যে কারণে ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত থাকায় তা নিলাম করে পাওনা আদায়ের পরামর্শ দিয়েছিলেন তৎকালীন পর্যবেক্ষক। কিন্তু সেই পরামর্শ আমলে না নিয়ে সুদ মওকুফ সুবিধা দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, শতভাগ নিয়ম মেনে সুদ মওকুফ সুবিধা নেওয়া হয়েছে। বাকিটা বাংলাদেশ ব্যাংক ভালো বলতে পারবে।