Site icon The Bangladesh Chronicle

নারীবাদের সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী কানেকশন

logo

প্রকাশ : সোমবার ১৬ জুন ২০২৫, ২১:১৬

নয়া দিগন্ত গ্রাফিক্স

ফ্যাসিবাদী জমানার অবসানে মান্ধাতার আমলের রীতি-নীতি বদলে জনবান্ধব ও টেকসই নীতিমালা প্রণয়নের জনদাবি দেশে এখনো জোরালো। নাগরিক কণ্ঠস্বর আমলে নিয়ে বেশ কয়েক মাস আগে অন্তর্বর্তী সরকার কিছু সংস্কার কমিশন গঠন করে। সেই ধারাবাহিকতায় নারীবিষয়ক একটি সংস্কার কমিশনও গঠন করা হয়। যেহেতু আমাদের দেশীয় সমাজ এখনো কুসংস্কারে ভরা, সঙ্গত কারণে নারীর কল্যাণে সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করা ছিল এ কমিশনের অন্যতম কাজ। সেই সাথে এতদিন ধরে এ দেশের সমাজে নারী যে অবমাননাকর জীবন যাপন করছেন তার অবসানে কমিশনের ৪২৩টি প্রস্তাব যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করে নারীর বঞ্চনামুক্ত উন্নত জীবন নিশ্চিত করাই ছিল কাঙ্ক্ষিত।

নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে পৌঁছতে এ মোক্ষম সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয় সে জন্য সম্প্রতি নারীবিষয়ক কমিশনের তৈরি প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে সরকারের কাছে। এর চিত্রনাট্য বেশ আবেদনময়। এর লিখিয়েদের মনে হয়েছে, তাদের রচিত প্রতিবেদন আমাদের দেশের পুরো নারীসমাজের প্রতিনিধিত্ব করে। সব নারীর আঁতের কথা বলতে পেরে তারা তৃপ্ত। এর প্রমাণ মেলে প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময় কমিশনের সব সদস্যের হাসিমাখা মুখে ক্যামেরায় ধরা অবয়বে। কিন্তু তাদের মনে ছিল না যে, নিজেদের বাতলে দেয়া উপায় এদেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ নারীসমাজের মনোরঞ্জনে ব্যর্থ হতেও পারে, এই অতি প্রয়োজনীয় কথা। তাদের কাছে কল্পনাতীত ছিল যে, সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়ার সাথে সাথে চারদিকে হইচই পড়ে যাবে, তীব্র বিতর্কের জন্ম দেবে, ধর্মবাদীদের গালমন্দ শুনতে হবে। কথার বাণে জর্জরিত হতে হবে। শুনতে হবে, নারীর ক্ষমতায়নের নামে নাকি তারা একটি স্থিতিশীল সমাজ অস্থিতিশীল করার মতলবে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।

আমাদের দেশে মোহনীয় শব্দমালায় পশ্চিমা নারীবাদের মোহে পশ্চিমা চিন্তাকাঠামোয় চিন্তা করতে অভ্যস্ত এদেশের অনেক নারী এ মতবাদে মোহাবিষ্ট; বিশেষ করে শহুরে উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারীরা। তাদের মনে হতে থাকে ধর্মীয় প্রভাবাধীন সমাজে নারী বঞ্চিত-অবহেলিত ও বৈষম্যের শিকার। এজন্য একমাত্র দায়ী ধর্ম। এ বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে এদেশীয় নারীবাদীরা সমাজে ধর্মের (পড়তে হবে ইসলামের) প্রভাব কমাতে নিজেদের সুচিন্তিত (!) চিন্তাকাঠামোয় নারীসমাজকে জাগ্রত করতে প্রাণপণ প্রচেষ্টায় রত। তবে নিন্দুকেরা প্রশ্ন তুলেছেন, আসলে কি নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়নে এদেশের নারীবাদীরা কাজ করছেন? নাকি নারীবাদ আমদানি করে এক শ্রেণীর এনজিওজীবী তাদের অর্থনৈতিক ধান্দা হাসিল করছেন? বিষয়টি অনেকে পরখ করে দেখতে চান বৈকি। যা হোক, আমরা আগেই বলেছি, নারীবিষয়ক কমিশনের জমা দেয়া প্রতিবেদনের কিছু প্রস্তাব এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর চরম আঘাত। এর মধ্যে রয়েছে বাবা-মায়ের সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমানাধিকার দেয়ার কথা। আরো রয়েছে, বৈবাহিক ধর্ষণ এবং পতিতাবৃত্তির মর্যাদায়ন। এগুলোর বাস্তবায়ন যে এই সমাজব্যবস্থার ওপর চরম আঘাত তা কি এদেশের নারীবাদীরা ঠাহর করতে পারছেন?

জমা দেয়া প্রতিবেদন নিয়ে দেশে বাদ-প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তার রেশ এখনো কাটেনি। পক্ষে-বিপক্ষে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া শুধু নয়; নারীবিষয়ক কমিশনের কয়েকটি প্রস্তাবে ঘোর আপত্তি উঠেছে। অন্যদিকে, কমিশনের প্রতিবেদন সমর্থনে মডার্ন-আলট্রামডার্ন, সেক্যুলার ও বামপন্থীদের মৈত্রী গড়ে উঠেছে। তারা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে প্রতিবেদনের সমর্থনে সমাবেশের আয়োজনও করেন। এ নিয়ে চারদিকে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমরাও নারীবাদ নিয়ে আলোচনা প্রাসঙ্গিক বলে সাব্যস্ত করেছি। মানে একটি মুখরোচক ইস্যু পেয়ে গেছি আর কী! আমাদের মতো নাদানদের কাছেও এটি বিবেচনায় নেয়ার মতো গুরুতর বিষয় বলে মনে হয়েছে।

বিষয়টি দেশের পুরো জনগোষ্ঠীর স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত এবং বৃহত্তর সমাজকে নাড়া দিয়েছে বলেই আমাদের আজকের এই নিবন্ধের অবতারণা। এ লেখায় আমাদের প্রয়াস থাকবে পশ্চিমা নারীবাদের এদেশীয় পাইক-বরকন্দাজদের মতলবটা কী- তা খুঁজে বের করা।

পশ্চিমে নারীমুক্তির দাওয়াই হিসেবে নারীবাদের জন্ম। প্রাথমিক পর্বে নারীবাদ উত্থিত হয়েছিল নারীকে আত্মসচেতন ও স্বনির্ভর সামাজিক শ্রেণীতে উন্নীত করার প্রত্যয় নিয়ে। এ আন্দোলন তার রাশভারী তত্ত্ব, গালভরা বুলি আর বাঁধনহারা বিক্ষোভের ঝড় তোলার মধ্য দিয়ে একসময় দিকে দিকে সাড়া ফেলেছিল। লক্ষ্য ছিল শুধুই একটিÑ শৃঙ্খলার নাগপাশ থেকে নারীসমাজের চিরস্থায়ী মুক্তি। সময় যত গড়িয়েছে, সেই মুক্তি কতটা অর্জিত হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্কের বিস্তর অবকাশ রয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি তর্কসাপেক্ষ এই প্রশ্ন- মুক্তি বলতে নারীবাদের প্রবক্তারা আদতে কী বুঝিয়েছিলেন? আরো প্রশ্ন জাগে, নারীবাদ ও পুঁজিবাদের অন্তরঙ্গ সখ্য নিয়েও। বিশেষত যখন দেখা যায়, নারীবাদের পরম বিকাশ ঘটেছে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদদে ও পৃষ্ঠপোষকতায়।

আপাত দৃষ্টিতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থায় নারী কিভাবে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত-অবমানিত-অবদমিত হয়ে আসছেন তার একটি হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা পাওয়া যায় নারীবাদী অনেক লেখায়। নারীকে সুসংহত আর স্ব-ক্ষমতায় বলশালী করতে; অর্থাৎ সমাজে নারী কিভাবে কর্তাসত্তায় আবির্ভূত হতে পারে সে বিষয়ে নানা কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসেন নারীবাদীরা। জন্মভূমি ইউরোপ-আমেরিকা ছাড়িয়ে নারীবাদ দেশে দেশে রফতানি করা হয় নারীর ক্ষমতায়নে। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে। পশ্চিমা সমাজ ও মিডিয়া হামেশা দোষারোপ করে থাকে মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রে ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীরা অবমাননার শিকার হচ্ছে। সেখানকার অবরোধবাসিনী নারীর জিল্লতিতে যারপরনাই পেরেশান পশ্চিমা বিশ্ব। তাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের দেশেও এক শ্রেণীর নারী নিজেদের কর্তব্যকাজ ঠিক করেছেন। ধর্মের বেড়াজাল ডিঙিয়ে তারা কিভাবে নারীসমাজকে এগিয়ে নেবেন, সেই চিন্তায় এরা পেরেশান। যেহেতু এনজিওয়ের মাধ্যমে ইউরোপ-আমেরিকা এই মহান কর্ম সম্পাদন করে; সেহেতু এদেশীয় প্রগতিবাদী নারীরাও হরেক রকমের সংগঠন খুলেছেন নারীর ক্ষমতায়নের নামে। পশ্চিমা অর্থায়নে এ মহৎ কর্ম এগিয়ে নেয়ার দৃঢ় সঙ্কল্প তাদেরও। কোমরে শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে দশকের পর দশক ধরে এই মহতী কাজে ব্রতী আছেন তারা।

নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশে তাদের ধনুর্ভঙ্গপণ যে করেই হোক নারীমুক্তির সোনার পাথর বাটি তাদের চাই-ই চাই। এটি সত্য যে, মুসলিমপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সমাজে নারী বহুমাত্রিক নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার। এর অবসান হওয়া অবশ্যই জরুরি। কিন্তু কোন পথে? তা কি পশ্চিমা নারীবাদী ভাবাদর্শে? নাকি আল কুরআন যে সমাধান দিয়েছে, সে পথে? কুরআনে বলা হয়েছে- ‘তোমরা একে-অপরকে প্রভু বানিও না’। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৬৪) আল্লাহর এই নির্দেশনায় এটি পরিষ্কার যে, কারো প্রতি প্রভুত্ব করা যাবে না।

এখন জেনে নেয়া যাক, আমাদের এই ভূখণ্ডে কিভাবে পশ্চিমা নারীবাদের অনুপ্রবেশ ঘটে। পাকিস্তান আমলে গত শতকের ষাটের দশক থেকে শুরু হলেও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আশির দশক থেকে আমাদের সমাজে তুফান বেগে নারীবাদের পদচারণা শুরু। যাত্রাকাল থেকে নারীসমাজের কল্যাণে নানাবিধ কর্মসূচি সাজানো হয়েছে। যেহেতু পশ্চিমা নারীবাদ গোড়াতে সাব্যস্ত করেছে যে, ধর্ম নারী অগ্রগতিতে যত নষ্টের মূল। এ কথা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই যে, খ্রিষ্টবাদের নানাবিধ বিধিনিষেধে পশ্চিমে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত নারীকে পূর্ণাঙ্গ মানুষের মর্যাদা দেয়া হয়নি। ধর্মের নামে তা হরণ করা হয়েছিল। এ জন্য নারীবাদের প্রবক্তারা ধার্য করেন, যেকোনো ধর্মীয় বিধি-বিধান নারী উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। ফলে তাদের প্রণীত কর্মসূচি ধর্মের বিরোধিতায় নির্ধারিত। এমন বাস্তবতায় আমাদের দেশের নারীবাদীরাও এদেশের সমাজ থেকে ধর্মকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে পুরুষের কর্তৃত্ব খর্ব করে নারীর জন্য একটি আদর্শ সমাজগঠনে নিজেদের লক্ষ্য স্থির করেন। যাতে নারী-পুরুষ সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু সমস্যা বাধে তখন- যখন খ্রিষ্টীয় বিশ্বে নারীর অবমাননাকর জীবন হাজির থাকলেও এটি কী মুসলিম জাহানে একই আদলে আদৌ কখনো উপস্থিত ছিল কি না সেই প্রশ্ন সামনে এলে? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইসলামী বিধি-বিধান মুসলিম দুনিয়ার যেখানে ন্যূনতম কার্যকর রয়েছে, সেখানে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের চেয়ে নারী বেশি স্বাধীনতা ও ক্ষমতার অধিকারী। এক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্যের সপক্ষে পশ্চিমা দুনিয়ায় দারুণভাবে সমাদৃত নারীবাদী লেখিকা সাবা মাহমুদের গবেষণামূলক বই পলিটিক্স অব পাইটির (Politics of piety) কথা উল্লেখ করতে পারি। সাবা দেখিয়েছেন, পশ্চিমা দুনিয়ার চেয়ে সম্মানজনকভাবে মুসলিম দেশে নারীরা অনেক বেশি কর্তাসত্তার অধিকারী। এক্ষেত্রে তিনি মিসরীয় নারীদের ওপর যে গবেষণা পরিচালনা করেন তার মাঠপর্যায়ের তথ্য তুলে ধরেন। তিনি দেখতে পান, মিসরীয় নারীরা ধর্মীয় স্থানে বিশেষ করে মসজিদগুলোতে তাদের এক ধরনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা অত্যন্ত সম্মান বয়ে এনেছে তাদের জীবনে। সাবা তার লেখায় তুলে ধরেন, মসজিদগুলোতে মিসরীয় নারীরা তাদের জ্ঞানচর্চা এবং সামাজিক কর্মসূচিগুলোও বিনা বাধায় এবং নির্বিঘ্নে করে থাকেন। উপসংহারে সাবা বলেন, পশ্চিমা নারীদের চেয়ে ইসলামী সমাজব্যবস্থায় এই অধিকার কম কিসে! তাই তিনি বলতে বাধ্য হন, নারী স্বাধীনতা ও অধিকার কেবল পশ্চিমের একচেটিয়া বিষয় নয়। ভিন্ন ভিন্ন সমাজবাস্তবতায় এর চরিত্র ও রূপ আলাদা হতে বাধ্য।

অথচ আমাদের দেশে মোহনীয় শব্দমালায় পশ্চিমা নারীবাদের মোহে পশ্চিমা চিন্তাকাঠামোয় চিন্তা করতে অভ্যস্ত এদেশের অনেক নারী এ মতবাদে মোহাবিষ্ট; বিশেষ করে শহুরে উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারীরা। তাদের মনে হতে থাকে ধর্মীয় প্রভাবাধীন সমাজে নারী বঞ্চিত-অবহেলিত ও বৈষম্যের শিকার। এজন্য একমাত্র দায়ী ধর্ম। এ বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে এদেশীয় নারীবাদীরা সমাজে ধর্মের (পড়তে হবে ইসলামের) প্রভাব কমাতে নিজেদের সুচিন্তিত (!) চিন্তাকাঠামোয় নারীসমাজকে জাগ্রত করতে প্রাণপণ প্রচেষ্টায় রত। তবে নিন্দুকেরা প্রশ্ন তুলেছেন, আসলে কি নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়নে এদেশের নারীবাদীরা কাজ করছেন? নাকি নারীবাদ আমদানি করে এক শ্রেণীর এনজিওজীবী তাদের অর্থনৈতিক ধান্দা হাসিল করছেন? বিষয়টি অনেকে পরখ করে দেখতে চান বৈকি।

যা হোক, আমরা আগেই বলেছি, নারীবিষয়ক কমিশনের জমা দেয়া প্রতিবেদনের কিছু প্রস্তাব এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর চরম আঘাত। এর মধ্যে রয়েছে বাবা-মায়ের সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমানাধিকার দেয়ার কথা। আরো রয়েছে, বৈবাহিক ধর্ষণ এবং পতিতাবৃত্তির মর্যাদায়ন। এগুলোর বাস্তবায়ন যে এই সমাজব্যবস্থার ওপর চরম আঘাত তা কি এদেশের নারীবাদীরা ঠাহর করতে পারছেন?

Exit mobile version