নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন
নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের শিক্ষা
সোহরাব হাসান | ২৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৪:৪০
মিষ্টি নিয়ে সাখাওয়াতের বাসায় আইভী
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের কথা দিয়েই শুরু করি। তিনি বলেছেন, প্রার্থী ও ভোটারদের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। কিন্তু তিনি বলেননি যে কেন আগের নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু হতে পারেনি। নারায়ণগঞ্জের সুষ্ঠু নির্বাচনের কৃতিত্ব যদি নির্বাচন কমিশন নিতে চায়, আগের খারাপ নির্বাচনের দুর্নামও তাকে নিতে হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে ভোটাররা সব সময়ই সহযোগিতা করে থাকেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় সাধারণ নাগরিকদের অংশগ্রহণে ভোট ছাড়া দ্বিতীয় অস্ত্র নেই। অতএব, ভোটাররা নিজেদের স্বার্থেই সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়তা করেন। এরপর আসি প্রার্থীর কথায়। নির্বাচনে প্রার্থীরা কী করতে পারবেন, কী করতে পারবেন না, তা পরিষ্কারভাবে নির্বাচনী আচরণবিধিতে লেখা আছে। নির্বাচনের আগে প্রত্যেক প্রার্থীকে নির্বাচন কমিশনে আমলনামা জমা দিতে হয়। এই আমলনামা ধরেও তারা প্রার্থীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে পারে। কিন্তু আমাদের স্বাধীন নির্বাচন কমিশন এত দিন পরাধীন আচরণই করে আসছে। সরকার বা সরকারি দল অখুশি হতে পারে, এমন কিছু তারা করেনি। কেন করেনি, সেই প্রশ্নের জবাব একদিন দিতেই হবে। সিইসি যা বলেননি তা হলো, নির্বাচনের কাজে যুক্ত প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা সরকার চাইলেই নির্বাচন সুষ্ঠু করা সম্ভব। আর সরকারকে সেটি চাওয়ানোর মালিক হলো নির্বাচন কমিশন। কমিশন যখন সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে না পারে, তখন তাদের সামনে দুটো পথ খোলা থাকে। প্রথমত, নির্বাচনী কাজে বাধাদানকারীদের আইনের আওতায় এনে নির্বাচনের পরিবেশটি নিশ্চিত করা। বাধাদানকারীদের হাত লম্বা, কিন্তু সেই হাত নির্বাচন কমিশনের চেয়ে লম্বা নয়। দ্বিতীয়ত, যদি দেখা যায়, বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের সহায়তা করছে না, তখন নির্বাচন কমিশন দেশবাসীকে পুরো পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে পারে। তারা একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। নির্বাহী বিভাগের অধীন কর্মচারী নয়। দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের, গত ৪৫ বছরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বা নির্বাচন কমিশনাররা (ইসি) সেই সাহস দেখাতে পারেননি (তবে একবার সাবেক সিইসি মোহাম্মদ আবু হেনা ভোট কারচুপির কারণে একটি উপনির্বাচনের গেজেট প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন); বরং কোনো কোনো সিইসি কিংবা ইসি আন্দোলনের মুখে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন।
কাজী রকিব কমিশন শেষ বেলায় এসে সুষ্ঠু নির্বাচনের যে নজির দেখাল, সেটি আমাদের নির্বাচনী রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুণগত পরিবর্তনে সহায়ক হবে কি না, সেই প্রশ্নের জবাব ভবিষ্যৎই দিতে পারে। তবে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে আমাদের রাজনৈতিক দল, সরকার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নির্বাচন কমিশনের জন্য কিছু শিক্ষণীয় আছে বলে মনে করি।
প্রথম শিক্ষা হলো, একটি নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য করতে হলে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হয়। পারস্পরিক আস্থা রাখতে হয়। বিশেষ করে, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দল সমঝোতা ও সহিষ্ণুতার পরিবেশ তৈরিতে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। দুই প্রধান দল তৃণমূলের কথা শুনে হোক কিংবা অগ্রাহ্য করে হোক মেয়র পদে দুজন পরিচ্ছন্ন প্রার্থীকে বেছে নিয়েছিল। এ জন্য তারা ধন্যবাদ পেতে পারে। কাকে আপনি প্রার্থী করেছেন, সেটাই ভোটারদের কাছে মুখ্য। প্রার্থী দাঙ্গাবাজ হলে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন যে সম্ভব নয়, সেটি এর আগে নারায়ণগঞ্জসহ স্থানীয় সরকার সংস্থার বিভিন্ন নির্বাচনে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
দ্বিতীয় শিক্ষা হলো, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জাতীয় বিতর্কের চেয়ে স্থানীয় সমস্যাগুলো প্রাধান্য পাওয়া। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে ১৪ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে প্রথম আলো আয়োজিতগোলটেবিল বৈঠকেও প্রায় সব প্রার্থী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা স্থানীয় সমস্যাগুলো সামনে নিয়ে এসেছেন। তাঁরা নারায়ণগঞ্জকে সন্ত্রাসমুক্ত করার পাশাপাশি সমৃদ্ধ ও সবুজ নগর গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো আইনকানুন মেনেই নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছে, নির্বাচনী আচরণবিধি যাঁদের নির্বাচনী প্রচার অনুমোদন করে না, এমন কেউ সেখানে যাননি, কেউ উসকানিমূলক কথাবার্তা বলেননি। এই নির্বাচন নিয়ে দুই দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতা ছিল; কিন্তু উত্তেজনা ও অস্থিরতা ছিল না। প্রশাসন বা দলের সমর্থন না পাওয়ায় নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে ‘তৃতীয় পক্ষ’ বলে পরিচিত মহলটিও সুবিধা করতে পারেনি।
এই নির্বাচনে তৃতীয় শিক্ষণীয় দিক হলো, পরিচ্ছন্ন প্রার্থী থাকলে নির্বাচনটি পরিচ্ছন্ন হয় এবং জাতীয় রাজনীতিতেও তার একটি ইতিবাচক প্রভাব আশা করা যায়। আমাদের দেশে নির্বাচন মানেই হাঙ্গামা, নির্বাচন মানেই পরস্পরের বিরুদ্ধে গালাগাল, বিষোদ্গার। একে অপরকে দেখে নেওয়ার কিংবা দেখিয়ে দেওয়ার মহড়া বা মল্লযুদ্ধ। সেসব অপসংস্কৃতি থেকেও সদ্য সমাপ্ত নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন মুক্ত ছিল।
এই নির্বাচনে সরকারি দলের পাশাপাশি সরকারের আচরণেও একধরনের সহিষ্ণুতা ছিল। অতীতে দেখা গেছে, নির্বাচন এলেই বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হয়রানি, তল্লাশি শুরু হয়ে যেত। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনে সে রকম কিছু হয়নি; বরং বিএনপির নেতা-কর্মীরা ব্যক্তিগত আলাপে জানিয়েছেন, এত দিন পালিয়ে থাকলেও নির্বাচনের সুযোগে তাঁরা বাইরে এসে প্রচারকাজে অংশ নিতে পেরেছেন।
নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জন্যও শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। অন্যান্য নির্বাচনে দেখা যায়, প্রশাসন ও বিরোধী দল মুখোমুখি অবস্থানে। প্রশাসন বিরোধী দলকে নজরদারিতে রাখে। আবার বিরোধী দলও তাদের সন্দেহের চোখে দেখে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ ছিল অনেকটাই ব্যতিক্রম। বরং সেখানে সরকারি দলের প্রার্থী সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন বিরোধী দলকে ইঙ্গিত করে নয়, অদৃশ্য শক্তিকে ইঙ্গিত করে। আগে যা-ই হোক না কেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোটামুটি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।
নির্বাচনের প্রচারের সময় বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা সবাই দুই প্রার্থীকে অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি বলে একবাক্যে স্বীকার করেছেন। তাঁরা এ-ও বলেছেন যে সেলিনা হায়াৎ আইভী দলের বাইরে বিপুলসংখ্যক মানুষের সমর্থন আদায় করতে পেরেছেন বলে জয়ী হয়েছেন। গতবারের চেয়ে এবারের নির্বাচনটি তাঁর জন্য কম কঠিন ছিল না। গেলবার তিনি দৃশ্যমান প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। এবার দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান দুই প্রতিদ্বন্দ্বীকেই যুঝতে হয়েছে।
এই নির্বাচনে আইভী শক্তিশালী প্রার্থী ছিলেন, সন্দেহ নেই। তিনি আট বছর পৌরসভার চেয়ারম্যান ও পাঁচ বছর মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু কোনো পক্ষ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা দলীয়করণের অভিযোগ আসেনি। আইভী সিটি করপোরেশন ও দলকে সব সময় আলাদা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেছেন। নগর ভবনে তিনি দলের নন, সবার হয়ে কাজ করেছেন এবং অনেকটা সফলও হয়েছেন। গেল সপ্তাহে বন্দর এলাকায় একজন কাউন্সিলর প্রার্থী, যিনি এখনো কাউন্সিলর পদে আসীন আছেন, নিজেকে স্থানীয় বিএনপির নেতা পরিচয় দিয়ে বলেছেন, জাতীয় রাজনীতিতে তিনি বিএনপি করলেও মেয়র পদে আইভীকেই ভোট দেবেন। পাঁচ বছর ধরে কাজ করে বুঝেছেন নারায়ণগঞ্জের উন্নয়নে তাঁর বিকল্প নেই। তখন তাঁর কথাটি যে কথার কথা ছিল না, সেটি বুঝতে পারলাম নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর। নারায়ণগঞ্জের ১ লাখ ৭৫ হাজার ভোটার জানিয়ে দিয়েছেন, আইভীর বিকল্প নেই।
নারায়ণগঞ্জ একসময় ছিল সন্ত্রাসের জনপদ। দুই বছর আগে এখানে সাত খুনের ঘটনা ঘটেছে। তারও আগে ত্বকী নামের এক মেধাবী কিশোরকে হত্যা করা হয়েছে। সে সময়ে এই ‘কালের পুরাণ’ কলামেই লিখেছিলাম, ‘ভাগ্যিস, বাংলাদেশটা নারায়ণগঞ্জ হয়নি।’ কিন্তু বৃহস্পতিবার একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করে নারায়ণগঞ্জের মানুষ জানিয়ে দিয়েছে, তারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এবং শান্তি ও গণতন্ত্রের পক্ষে। ভোটাররা সমৃদ্ধি ও সহিষ্ণুতার পক্ষেই রায় দিয়েছেন।
সিটি নির্বাচনে সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় হলো রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন। নির্বাচনে জয়-পরাজয় আছে। কেউ ১ ভোট বেশি পেয়েও নির্বাচিত হন। এ কথার অর্থ এই নয় যে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ভোটারদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। অথচ আমাদের দেশে বিজয়ী দল ও প্রার্থীরা কাজে ও কথায় সেটাই জানান দিয়ে থাকেন।
কিন্তু নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের বিজয়ী প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী ফলাফল ঘোষণার পর যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, সেটি অন্য রাজনীতিকদের জন্য অনুসরণীয় হতে পারে। বৃহস্পতিবার রাতে আইভী বলেছিলেন, প্রথম সুযোগেই তিনি মিষ্টি নিয়ে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খানের বাসায় যাবেন। গতকাল বেলা ১১টায় তিনি তাঁর বাসায় যানও। আইভী সাখাওয়াতের বাসায় মিষ্টি নিয়ে গিয়েছেন, সেটি বড় খবর নয়, বড় খবর হলো তিনি বিএনপির প্রার্থীর নির্বাচনী ইশতেহারটি পড়ে দেখা এবং এতে থাকা কল্যাণকর (জনগণের) বিষয়গুলো গ্রহণ করার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখানোর কথা বলেছেন। জবাবে সাখাওয়াত বলেছেন, তিনি (আইভী) যদি সব দলকে সঙ্গে নিয়ে চলেন, সবার জন্য কাজ করেন, মাদক-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনড় অবস্থান নেন, তাহলে তাঁকে সহায়তার জন্য তিনি প্রস্তুত আছেন।
স্থানীয় রাজনীতিতে আইভী বা সাখাওয়াত এই ঔদার্য দেখাতে পারলে আমাদের জাতীয় নেতারা কেন পারছেন না?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।