ভোটের হিসাবে আজ প্রথম চ্যালেঞ্জ উৎরাতে যাচ্ছে দলটি। ভোটের পর একের পর এক চ্যালেঞ্জ পার করতে হবে এটি মাথায় রেখেই আওয়ামী লীগের নেতারা নির্বাচনী গতিপথ ঠিক করেছেন। সেই অনুযায়ী ছকও সাজানো হয়েছে। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো নির্বাচনে নেই। ভোট বর্জন করে তারা কর্মসূচি পালন করছেন। বলা হচ্ছে- নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাওয়া ও এর বাইরে থাকা ৬৩টি রাজনৈতিক দল ভোট বর্জন করেছে। এই দলগুলো নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানালেও তা প্রত্যাখ্যান করে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হচ্ছে। এছাড়া সব দলকে নিয়ে নির্বাচন করতে বিভিন্ন বন্ধু রাষ্ট্র, বিদেশি সংস্থা ও মিশন একের পর এক পরামর্শ দিয়ে আসছে। শর্তহীন সংলাপের আহ্বান জানানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের তরফে। কিন্তু সরকার সংবিধানের আলোকে নির্বাচন করার প্রত্যয়ে অনড় থাকায় পরিস্থিতির কোনো হেরফের হয়নি।
এমন পরিস্থিতিতে দ্বাদশ নির্বাচনের পর নানামুখী চ্যালেঞ্জ রয়েছে আওয়ামী লীগের সামনেও। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ করা। গ্রহণযোগ্য ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করা, সংঘাত- সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করা, ভোটের পর বিরোধীদের সম্ভাব্য কর্মসূচি মোকাবিলা করাকে সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হচ্ছে। এছাড়া ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সরকারের সামনে আরও কিছু সংকট তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ভোটের আগে বাংলাদেশের জন্য যে ভিসানীতি গ্রহণ করেছিল তা সামনে প্রয়োগ হয় কিনা। শ্রম অধিকার প্রশ্নে দেশের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের খাত তৈরি পোশাক শিল্প খাতে কোনো ধাক্কা আসে কিনা তা নিয়ে ভাবছেন অনেকে।
এবারের নির্বাচনটি নানা কারণে ব্যতিক্রম। আগের দু’টি নির্বাচন থেকে অনেকটা ভিন্ন। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সমমনা দল বর্জন করেছিল। ওই নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিলেন প্রার্থীরা। বাকি আসনে নির্বাচন হলেও ছিলনা তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা। অনেকটা নিয়ম রক্ষার জন্য নির্বাচন হয়েছিল। পরে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। কিন্তু ওই নির্বাচনে রাতেই একটি নির্ধারিত পরিমাণ ভোট হয়ে যায় বলে বিরোধী দলগুলো ভোটের পর অভিযোগ করে। এমন অভিযোগ মাথায় নিয়ে সরকার ৫ বছর পূর্ণ করে আরেকটি নির্বাচন আয়োজন করেছে। এবারের নির্বাচনে অবশ্য একজন প্রার্থীও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হননি। এছাড়া নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে সরকারি দল নজিরবিহীনভাবে নেতাকর্মীদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। এছাড়া সরকারি দল জোটসঙ্গী শরিক দল ও মিত্র দলের প্রার্থীদের জন্য আসন সমঝোতা করেছে। যেসব দল ও জোট নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে তাদের জন্য বিশেষ ছাড় দেয়া হয়েছে। সরকারি দলের প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে ছাড় দেয়া আসন থেকে। নিজ দলের প্রার্থী আর ডামি বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে বেশির ভাগ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে। এর বাইরে নির্বাচনী লড়াইয়ে থাকলেও এবার জাতীয় পার্টির অবস্থান নড়বড়ে। নির্বাচনের পুরো সময় দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ছিলেন অনেকটা আড়ালে। দলটির প্রার্থীদের অভিযোগ, তাদের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারেননি তারা। এমন অবস্থায় একে একে দলটির অনেক প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। যারা মাঠে আছেন তারাও নির্বাচনী তৎপরতায় ছিলেন না। এমন অবস্থায় আজকের জাতীয় নির্বাচনটি দেশের রাজনীতির ইতিহাসে যুক্ত করতে যাচ্ছে নতুন এবং ব্যতিক্রমী এক অধ্যায়।
কে হবেন বিরোধী দলের নেতা? নানা কারণে ব্যতিক্রম এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে তফসিল ঘোষণার পরই। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় পেরুনের পর তা আরও পরিষ্কার হয়। কিন্তু বিরোধী দল কে হবে তা আজ নিষ্পত্তি হবে। ভোটের আগে জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের স্থানটি পেতে দেন-দরবার করলেও শেষ মুহূর্তে দলটি এবার বিরোধী দলের স্থানটিও হারাতে পারে। আলোচনা আছে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জোট বিরোধী দলের জায়গা নিতে পারেন। নেতৃত্ব দিতে পারেন বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের একজন নেতা। এই নেতা এবার স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন। এক সময় বিএনপি করতেন। এমপিও হয়েছেন আগে। আলোচনা আছে সমঝোতায় নির্বাচন করলেও জাতীয় পার্টি এবার খুব বেশি আসন পাচ্ছে না। এর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সারা দেশে নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নানা সমীকরণে তাদের অনেকে জয়ী হয়ে আসতে পারেন। বিজয়ী প্রার্থীদের এই সংখ্যাটি জাতীয় পার্টির চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে। এ ছাড়া কিংস পার্টি খ্যাত দলগুলোও হাতেগোনা দু’-একটি আসন পেতে পারে। যারা বিরোধী দল বা বিরোধী দলের জোট গড়ার মতো অবস্থানে থাকবে না।
ভোটের পরিসংখ্যান: নির্বাচন কমিশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৯টি সংসদীয় আসনে ১ হাজার ৯৬৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ইসিতে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে এই নির্বাচনে ২৮টি রাজনৈতিক দলের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১ হাজার ৫৩৪ জন প্রার্থী। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে আছেন ৪৩৬ জন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী ২৬৬ জন, জাতীয় পার্টির ২৬৫, তৃণমূল বিএনপি’র প্রার্থী ১৩৫ জন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ৬৬ জন, ন্যাশনাল পিপল্স পার্টির ১২২ জন, জাতীয় পার্টির ১৩ জন, বিকল্পধারা বাংলাদেশের ১০ জন প্রার্থী রয়েছেন। নির্বাচনে নারী প্রার্থী হিসেবে রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৯০ জন। আর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অন্যান্য মিলে ৭৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
২৯৯টি সংসদীয় আসনে মোট ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ৪২ হাজার ২৪টি। এসব কেন্দ্রে ভোটকক্ষ ২ লাখ ৬০ হাজার ৮৫৮টি। সর্বশেষ প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৯ জন। যার মধ্যে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ৬ কোটি ৭৬ লাখ ৯ হাজার ৭৪১ ও নারী ভোটারের সংখ্যা ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৮ হাজার ৬৯৯। এছাড়া সারা দেশে এবার তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার আছেন ৮৪৯ জন। এবারই প্রথমবারের মতো ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠানো হচ্ছে। শুধু দুর্গম অঞ্চলের ২ হাজার ৯৬৪টি কেন্দ্রে ব্যালট পাঠানো হয়েছে ভোটের আগের দিন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন স্থানীয় ২০ হাজার ৭৭৩ জন পর্যবেক্ষক। এছাড়া প্রায় দুই শতাধিক বিদেশি পর্যবেক্ষক থাকছেন বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ। বুধবার বিকাল পর্যন্ত ১৮৬ জন পর্যবেক্ষক-সাংবাদিককে অনুমোদন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন, যাদের মধ্যে ১২৭ জন পর্যবেক্ষক আর ৫৯ জন গণমাধ্যমকর্মী।
নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২ লাখ ১৫ হাজার সদস্য মোতায়েন থাকবে। সাধারণ ভোটকেন্দ্রে ৪ লাখ ৭২ হাজার সদস্য মোতায়েন থাকবে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ১৫ থেকে ১৭ জনের নিরাপত্তা সদস্যের একটি দল মোতায়েন করা হবে। নির্বাচন কমিশন জানায়, মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে অস্ত্রধারী দু’জন পুলিশ, অস্ত্রধারী একজন আনসার, অস্ত্র বা লাঠিধারী একজন আনসার, ১০ জন আনসার, লাঠি হাতে একজন বা দু’জন গ্রামপুলিশ সদস্যসহ ১৫ থেকে ১৬ জনের একটি দল সব সাধারণ ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা দেবে। তবে, প্রতি গুরুত্বপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের ক্ষেত্রে অস্ত্রসহ ৩ জন পুলিশসহ ১৬ থেকে ১৭ জনের দল থাকবে।
নির্বাচন উপলক্ষে ৫ই জানুয়ারি মধ্যরাত ১২টা থেকে ৮ই জানুয়ারি মধ্যরাত পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তবে ইসি’র স্টিকার লাগানো মোটরসাইকেল এই নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত থাকবে। এছাড়া নির্বাচন উপলক্ষে ভোটগ্রহণের জন্য নির্ধারিত দিবসের পূর্ববর্তী মধ্যরাত অর্থাৎ ৬ই জানুয়ারি রাত ১২টা থেকে ৭ই জানুয়ারি রাত ১২টা পর্যন্ত কতিপয় যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এসব যানবাহনের মধ্যে রয়েছেÑ ট্যাক্সি ক্যাব, পিকআপ, মাইক্রোবাস ও ট্রাক।
মানব জমিন