Site icon The Bangladesh Chronicle

নতুন বাংলাদেশের রূপকার হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিতে পারেন ড. ইউনূস

নতুন বাংলাদেশের রূপকার হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিতে পারেন ড. ইউনূস

মনদীপ তিওয়ানা

গত আগস্টের শুরুতে গণঅভ্যুত্থানে দীর্ঘদিনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে এবং দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করে। এরপর সত্যিকারের গণতন্ত্রের দিকে যেতে একটি রূপরেখা তৈরির অনন্য এক সুযোগ পায় বাংলাদেশ।

হাসিনার ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের রেখে যাওয়া দেশ পরিচালনার জন্য নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। এই সরকারে সেখানে সুশীল সমাজের নেতারাও আছেন।

প্রখ্যাত সুশীল সমাজ কর্মী ইউনূস একটি নতুন ও সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপনের জন্য বেশ ভালো সুযোগে আছে।  তিনি সামাজিক সংহতি তৈরি করতে এবং অতীতে দেশে হওয়া অত্যাচারের বিচারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশের সুশীল সমাজের অভিজ্ঞতাগুলি কাজে লাগাতে পারেন। অনেক উপায় আছে যার মাধ্যমে তিনি নাগরিক অধিকার চর্চার ক্ষেত্রগুলো প্রসারিত এবং রক্ষা করতে পারেন। উদাহরণ স্বরূপ তিনি গুম এবং নির্যাতনের জন্য দায়ী নিরাপত্তা ইউনিটগুলি ভেঙে দিতে পারেন, সুশীল সমাজকে সমর্থন নিশ্চিত করতে অতিরঞ্জিত সমালোচনার শিকার এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোকে সংস্কার করতে পারেন, বা সেসব বিদেশি অনুদান আইন সংশোধন করতে পারেন যেগুলো আন্তর্জাতিক তহবিল পাওয়ার ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজের জন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি করে।

অবশ্য এসব কাজ তার খুব দ্রুত কাজ করা উচিত। কারণ ইতিহাস থেকে আমরা জানি এই ধরনের সুযোগের সময় এবং আশাবাদী মুহূর্ত খুব দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বিপ্লবের মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী শাসন অপসারণের পর, গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলো অভিজাতদের চক্করে পড়ে যেতে পারে। সামনে কী হবে তার পরিকল্পনার অভাবে দ্রুত ঘটা বিভিন্ন ঘটনায় গণতন্ত্রপন্থী উপাদানগুলি ধাক্কা খেতে পারে এবং ভুল পথে পরিচালিত হতে পারে।

আর এমন পরিস্থিতিতে জাতীয়তাবাদী এবং কর্তৃত্ববাদী শক্তি, যারা অভিজাত এবং সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশ থাকার কারণে ক্ষমতা ধরে রাখে, তারা প্রায়ই উদ্ভূত ক্ষমতার এই শূন্যস্থান দখল করে। অনেক সময় সামরিক বাহিনী নিজেই দায়িত্ব নেয়। আবার অন্যভাবে গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতিনিধি হিসেবে আনা নেতারা সবকিছু একত্রে রাখতে নিজেরাই দমন-পীড়নের ঝুঁকে পড়ে।

উদাহরণ হিসেবে সুদানের কথা বলা যায়। ২০১৯ সালে দেশটির ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে উৎখাত করা হয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক উত্তরণে বেশ কয়েকটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালানোর পর ২০২১ সালে দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থান হয়। পরে দেশটিতে ক্রমশ নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রগুলো সংকুচিত হতে থাকে এবং দেশটি এখনো সংঘাতে বিধ্বস্ত৷

পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে স্থিতিশীল গণতন্ত্রের জন্য ক্ষেত্র তৈরির লক্ষ্যে প্রাথমিক একটি সামরিক অভ্যুত্থান হয়। কিন্তু তার পরে কয়েক দশক দেশটিতে সামরিক শাসন চলে এবং সুশীল সমাজের উপর অবিরাম আক্রমণ চলতে থাকে। দেশটির কর্তৃপক্ষ অধিকার কর্মী, বিক্ষোভকারী এবং সাংবাদিকদের উপর নিপীড়নসহ ভিন্নমতকে দমনে করেই চলছে।

ইথিওপিয়ায় ২০১৯ সালে যখন প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ ইরিত্রিয়ার সঙ্গে শান্তি চুক্তির জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন, তখন আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার ব্যাপারে খুব আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে তিনি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন যেখানে ব্যাপক নৃশংসতা সংঘটিত হয়েছিল। দেশটি এখনো দুর্দশায় আছে। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো সরকারকে নাগরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর তাদের দমন-পীড়ন বন্ধে এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সাংবাদিক এবং অধিকার কর্মীদের অধিকারকে সম্মানের আহ্বান জানিয়েছে।

অধ্যাপক ইউনূসের সরকার যদি সুশীল সমাজকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অন্তর্ভুক্ত করতে এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়, তবে হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশও এই সমস্যায় পড়তে পারে। তবে এগুলিই একমাত্র সম্ভাব্য পরিস্থিতি নয়। বিপ্লবের পরে গণতন্ত্রপন্থী শক্তিগুলিও আরও শক্ত হতে পারে এবং আরও জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। আবার একইভাবে ইতিবাচক ও বাস্তবতাকেও এগিয়ে নিতে পারে।

এই ক্ষেত্রে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে দুই বছর আগে শ্রীলঙ্কা যেখানে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসেকে পদত্যাগ করতে এবং দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করেছিল তা একটি উদাহরণ হতে পারে। যদিও ব্যাপারগুলো ঠিকভাবে হয়নি। দেশটিতে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছিল। গত মাসে আরও ভালো শাসন ও স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অনুরা কুমারা দিসানায়েক জয়ী হয়েছেন।

গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো অভিজাত শ্রেণির তৎপরতার মুখে কীভাবে অটল থাকতে পারে তার আরেকটি উদাহরণ হলো চিলি। সামরিক বাহিনীর উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধ সত্ত্বেও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে ২০১৯-২০২২ সালে চিলির জনপ্রিয় বিক্ষোভ শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং পেনশনে ধারাবাহিক সংস্কারের দিকে পরিচালিত করেছিল। গুয়াতেমালা যেখানে পুরানো শাসকের শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর ঠেকাতে বারবার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও জানুয়ারিতে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট শপথ নেন। এই দেশটি থেকেও বাংলাদেশের নতুন সরকার শিক্ষা নিতে পারে। উভয় দেশের ক্ষেত্রেই সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগুলো মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।

যদিও বিপ্লব এবং জনগণের অভ্যুত্থান এই দেশগুলির কোনওটিতেই নাগরিক ইউটোপিয়া এবং নিখুঁত গণতন্ত্র তৈরি করেনি।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত এই উদাহরণগুলোর দিকে মনোযোগ দেওয়া। যেখানে নাগরিক সমাজ কঠিন ও জটিল পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ বিজয় পেয়েছে। এমন ঘটনাগুলি থেকেও শিক্ষা নেওয়া উচিত যেখানে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি ক্ষমতাসীনদের পতন করতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একইরকম দুর্নীতিগ্রস্ত, গণতন্ত্রবিরোধী নেতাদের ক্ষমতায় আসা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছিল।

কোনো নতুন সরকার রাতারাতি সব ক্ষেত্রে সন্তোষজনক সংস্কার করে ফেলবে এবং নিখুঁত গণতন্ত্র নিয়ে আসবে—বিশেষ করে কয়েক দশকের স্বৈরাচারী শাসনের পর তা আশা করা অবাস্তব। কিন্তু বিশ্বজুড়ে অসংখ্য উদাহরণ আছে দীর্ঘমেয়াদী কর্তৃত্ববাদী শাসকদের রেখে যাওয়া ধ্বংসাবশেষের ওপর একটি সুন্দর ভবিষ্যত গড়ে তোলা সম্ভব। আর তা তখনই সম্ভব যখন নতুন নেতৃত্ব দৃঢ় সংকল্পের সঙ্গে কাজ করে, সুশীল সমাজের সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যায় এবং গণতান্ত্রিক পথে থাকে।

ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি ভুল করে এবং নতুন নেতৃত্ব নাগরিক সমাজকে দমন করে। বিক্ষোভ দমন করে গণতান্ত্রিক ভিন্নমতকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা শুরু করে—সে বিক্ষোভ আগের সরকারের সমর্থনকারীদের হোক বা পরিবর্তনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা মানুষের হোক—তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশে পরিবর্তনের সময় যে ভুলগুলো হয়েছিল, বাংলাদেশেও তার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। এমন পরিস্থিতি কর্তৃত্ববাদী শাসনের দীর্ঘ ইতিহাসে হাসিনাকে অপসারণে সফল সংগ্রাম এবং ইউনূসের নেতৃত্বের মেয়াদকাল খুব স্মরণীয় হয়ে উঠার সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেবে।

কিন্তু প্রফেসর ইউনূস যদি সঠিকভাবে কাজ করেন। এই ক্ষেত্রে সফল হয়েছে এমন অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেন এবং বাংলাদেশে শক্তিশালী গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেন। তবে তিনি ম্যান্ডেলার মতো অনুপ্রেরণাদায়ী ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠতে পারেন। আর এর মাধ্যমে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার যেসব দেশে নাগরিক স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে দমন করা হয় তাদের কাছে বিপ্লব-উত্তর সফল পরিবর্তনের আঞ্চলিক উদাহরণ হয়ে উঠতে পারেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেকেই তাকে সমর্থন করতে প্রস্তুত।

বাংলাদেশ এখন বাঁক বদলের মাহেন্দ্রক্ষণে আছে।  ইউনূস এবং তার উপদেষ্টারা মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতাকে অক্ষুন্ন রেখে বর্তমান রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতিকে কীভাবে মোকাবিলা করেন তার ওপরই নির্ভর করবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যত।

bangla outlook

Exit mobile version