- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৬ জুন ২০২০
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা সোয়া লাখ এবং সংক্রমণ মৃত্যু দেড় হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ভাইরাসের ব্যাপক সামাজিক সংক্রমণের কারণে এখন ঢাকার বাইরেও প্রত্যন্ত এলাকায় প্রচুর রোগী শনাক্ত হচ্ছে। প্রতিদিনই হাজারো মানুষ আক্রান্ত হওয়ায় মারাত্মক চাপে পড়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা।
দেখা যাচ্ছে প্রায়ই ঢাকার বাইরে বিভিন্ন এলাকায় কোভিড-১৯ উপসর্গ নিয়ে অসুস্থ মানুষ মারা যাচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনেও বলা হচ্ছে প্রতিদিনই হাসপাতালের বাইরে বাড়িতে মারা যাচ্ছেন বেশকিছু রোগী। দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ছে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়ার অভিযোগ উঠছে।
মৃতের বোন মর্জিনা খাতুন বলেন, “সরকারি বেসরকারি কোনো হাসপাতালেই তাকে ভর্তি না করায় একপর্যায়ে আমার ভাই তার ছেলের কোলে মৃত্যুবরণ করেন।”
ঢাকার বাইরে স্বাস্থ্যসেবার ওপর চাপ বাড়ছে
আইইডিসিআর এর তথ্যে দেখা যায়, খুলনায় গত তিনসপ্তাহে কোভিড-১৯ রোগী এক হাজারের বেশি বেড়েছে। পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন শারমিন ইয়াসমিন বলেন, রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ঢাকার বাইরে এখন স্বাস্থ্যসেবার ওপর চাপ বাড়ছে।
“ঢাকার বাইরে যে রোগীরা সংক্রমিত হচ্ছে – যেমন চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেটে কিন্তু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সেই অনুপাতে কিন্তু সেখানকার হসপিটাল ফ্যাসিলিটি কম।”
মিস ইয়াসমিন বলেন, এখন ক্রিটিক্যাল রোগীরাই কেবল হাসপাতালে যাচ্ছেন কিন্তু প্রয়োজনীয় সেবা চাহিদা মতো নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “একটা পরিসংখ্যান দেই, ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে অ্যাকটিভ কেইস ৭০ হাজারের বেশি। তার ৫ শতাংশের যদি আইসিইউ সুবিধা প্রয়োজন হয় তাহলে সেটা সাড়ে তিন হাজার রোগী।”
“আমাদের দেশে কোভিড রোগীদের জন্য আইসিইউ আছে ৩৪০টি যা এই পরিমাণ রোগীর অনুপাতে চাহিদার মাত্র ৯.৫%। এছাড়া ঢাকার বাইরে কিন্তু এই সুবিধা অতটা নেই এবং ডায়ালাইসিস সুবিধাও নেই। ক্রিটিক্যাল রোগীদের কিন্তু ডায়ালাইসিস সুবিধাটা দরকার হবে এবং এটা কিন্তু চিকিৎসার মধ্যেই পড়ে। সেটা না পেলে কিন্তু রোগীরা মারা যাবে।”
করোনাভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন সংকটাপন্ন রোগীর জন্য আইসিইউ থেকে এখন বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে উচ্চচাপে অক্সিজেন সরবরাহ করা। ক্রিটিকাল রোগীদের জন্য জীবন রক্ষা করতে পারে এই ব্যবস্থা।
যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেবে দেশের মাত্র ২৩টি সরকারি হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা আছে। বাকী হাসপাতালে চাহিদা পূরণের জন্য রয়েছে প্রায় ১৬ হাজার অক্সিজেন সিলিন্ডার। আগামী দুই মাসের মধ্যে সব হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কাজ শুরু হয়েছে বলে জানাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাদের তথ্যে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের ৮০ ভাগের বেশি এখন বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর একেবারে গুরুতর অবস্থা না হলে হাসপাতালে ভর্তি না হওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে সারাদেশে এ পর্যায়ে কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য বরাদ্দ আছে ১১ হাজারের মতো হাসপাতাল বেড। তবে সরকারি বেসরকারি সব হাসপাতালেই এখন কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যদিও বাস্তবতা হলো এ নির্দেশনা অনুযায়ী সব হাসপাতাল এখনো প্রস্তুতি শেষ করতে পারেনি।
ডা. শারমিন ইয়াসমিন নিজেও একটি বেসরককারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তিনি জানান, তাদের কোভিড রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে আরো অন্তত দুই সপ্তাহ লাগতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল বিভাগের পরিচালক ডা. মো. আমিনুল হাসান দাবি করেন, এখন দেশের সব হাসপাতালে করোনা বেড ফাঁকা রয়েছে। কিন্তু সিলেট, চট্টগ্রাম কুমিল্লার মতো অধিক সংক্রমিত এলাকা এমনকি ঢাকার সরকারি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র।
ঢাকার বাইরে সরকারি দু-একটি হাসপাতালের রোগীদের মেঝেতে রেখেও চিকিৎসা সেবা দিতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এছাড়া অনেকক্ষেত্রে পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার আগেই ছাড়পত্র দিয়ে নতুন রোগী ভর্তির ঘটনা ঘটছে।
‘সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না বহু মানুষকে’
বেসরকারি হাসপাতালগুলোর অভিজ্ঞতায়ও পাওয়া যাচ্ছে সংকটের চিত্র। হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী বলেন, “আমি আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে বলছি, আমরা একটি বেডও এখন রাখতে পারছি না।”
“ইতোমধ্যেই হাসপাতালের যে শয্যাসংখ্যা ছিল, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশই কোভিড এবং সন্দেহজনক কোভিড রোগীর জন্য বরাদ্দ হয়ে গেছে। বাকী অংশে সাধারণ রোগী এবং সাধারণ রোগীর মধ্যে যারা গুরুত্বপূর্ণ, অর্থাৎ যারা নানা রোগে ভুগছে, বাসায় থাকতে পারছে না, তারা আসছে। তাদের জন্য কিন্তু স্থান সংকুলান করতে পারছি না আমরা। আমাদের হাসপাতালে অন্তত বলতে পারি কোনো বেড ফাঁকা যাচ্ছে না।”
দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কতটা চাপের মুখে সেটি নিয়ে ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, “আমি এভাবে বলতে পারি যে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সামর্থ্যের সর্বশেষ সীমানা অতিক্রম করেছে। এজন্যই মানুষ কিন্তু হাসপাতালে শয্যা পাচ্ছে না, জায়গা পাচ্ছে না, চিকিৎসা পাচ্ছে না।”
“গণমাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে আমরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে প্রচুর সংখ্যক মানুষ এখন সেবা না পেয়ে অবহেলার শিকার হচ্ছে, বাড়ি ফিরে যাচ্ছে এবং কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করার মতো ঘটনা ঘটছে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেবে বাংলাদেশে ৬৫৪টি সরকারি এবং ৫০৫৫টি বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারির সময় রোগীর চাপ ও আতঙ্কে সাধারণ রোগীরাও অতি জরুরি না হলে হাসপাতালে যাচ্ছেন না। জরুরি বিভাগে হাসপাতালে গিয়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ঢাকায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে কারো কারো অভিজ্ঞতা থেকে জানা যাচ্ছে।
তবে ঢাকার বাইরে পরিস্থিতি অবনতি হচ্ছে বলেই খবর আসছে।
ব্যহত হচ্ছে অন্য রোগের চিকিৎসা
এদিকে করোনাভাইরাস মহামারিতে সংকট তৈরি হয়েছে সাধারণ রোগের চিকিৎসায়। কিছু কিছু হাসপাতালে ঘোষণা দিয়েই কয়েকটি রোগের চিকিৎসা বন্ধ রেখেছে বলে জানা যাচ্ছে। করোনাভাইরাস আতঙ্কে একেবারে জরুরি না হলে খুব কম রোগীরাই হাসপাতালে যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে সার্বিক চিকিৎসা সেবায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতের মধ্যে কেন্দ্রীয় সমন্বয় কতটা হচ্ছে, সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
সমন্বয়টা যথাযথ হচ্ছে না বলে অভিযোগ করে লেলিন চৌধুরী বলেন, “এর আগেও নানাভাবে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে যে একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেইজ জেলা, মহানগরভিত্তিক করা উচিত, যেখানে খোঁজ নিলে জানা যাবে যে কোন হাসপাতালে কয়টি বেড খালি রয়েছে এবং রোগীটি কোনদিকে যেতে পারে।”
“এরকম একটি ব্যবস্থা যদি করা যেতো তাহলে আমার মনে হয় যে, আমাদের হাসপাতালের যে শয্যাসংখ্যা, যে আইসিউ এবং হাইফ্লো অক্সিজেন যে ফ্যাসিলিটিজ রয়েছে, সবগুলিকে আমরা শতভাগ কাজে লাগাতে পারতাম। এবং এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘোরার জায়গাটি কমে আসতো।”
করোনাভাইরাস মহামারিতে আরেকটি বড় সংকট দেখা দিয়েছে ডাক্তার নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের একটা বড় অংশ আক্রান্ত হওয়ার কারণে। ডক্টরস ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের তথ্যে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৪শ ৩৬জন স্বাস্থ্যকর্মী কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন ৬৬ জন। এর মধ্যে ৬০ জন চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে এবং আক্রান্ত হয়েছেন ১৩৭৬ জন। এ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে পরিস্থিতির সামাল দিতে সবরকম চেষ্টা এবং ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক আয়েশা আক্তার বলেন মহামারির মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে চেষ্টার ত্রুটি নেই। যেখানে যা করা প্রয়োজন সেটি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এমনকি কন্ট্রোলরুমে ফোন করলে কোথায় গেলে আইসিইউ ফাঁকা পাওয়া যাবে বা কোন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া যাবে সে ব্যাপারেও পরামর্শ এবং সেবা দেয়া হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।
“আমাদের রোগীর সংখ্যা কিন্তু এখন বাড়ছে। কোভিড-ননকোভিড সবরকম রোগী ভর্তি হচ্ছে। আমরা আলাদা করে কোভিড, ননকোভিড ভাগ করেছি। যারা অসুস্থ তারা ভর্তি হচ্ছেন, চিকিৎসা পাচ্ছেন। সবরকম সেবাই কিন্তু দুইটা পাশাপাশি আমাদের চলছে।”
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিচ্ছে এবং জানাচ্ছে ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে সবার সহযোগিতা দরকার।
এই মুহূর্তে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ থাকা সর্বোচ্চ রোগীর তালিকায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সাত নম্বরে। গত বেশ কিছুদিন ধরে যে পরিমান টেস্ট করা হচ্ছে তার ২০-২৩ শতাংশ পর্যন্ত আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হচ্ছে। সূত্র : বিবিসি