Site icon The Bangladesh Chronicle

দেশে-বিদেশে আস্থার ঘাটতি বাড়বে

 

এম সাখাওয়াত হোসেন : শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে আস্থার ঘাটতি শুধু বিরোধীদের মধ্যে ছিল না, অনেকের মনেই তা ছিল। এবারের ২৮ অক্টোবরের সংঘাত, রক্তপাত, মৃত্যু সেই আস্থার সংকট আরও বাড়িয়ে দিল।

আমরা দেখেছি, সরকারি দলের নেতাদের পক্ষ থেকে ২৮ অক্টোবরে লাঠি-বৈঠা হাতে আসতে বলা হয়েছিল সমর্থকদের। আরেকটা শাপলা চত্বরের ঘটনার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এর পর পুলিশের সঙ্গে বিএনপির কর্মীদের সংঘাত শুরু হলো। এখন কে কী করেছে, কে আগে শুরু করেছে; সেটা পরের কথা। এক দল দোষ দেবে পুলিশকে। পুলিশ বলবে, বিএনপিই আগে হামলা শুরু করেছে। গতবারও এ রকম দোষারোপের ধারা আমরা দেখেছি। ২০০৬ সালের মতো এবারও জামায়াত মাঠে আছে, বিএনপি তো ছিলই।

দৃশ্যত মনে হয়, ২৮ অক্টোবরের সংঘাত হয়েছে পুলিশ বনাম বিএনপির মধ্যে। পুলিশ নিজে থেকে করেছে, নাকি অন্যভাবে করেছে, নাকি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বাধ্য করেছে; তা জেনে বলতে হবে। পুলিশের ভূমিকা বেশি রকম আক্রমণাত্মক ছিল। সেখানে একজন পুলিশের কনস্টেবল ডিউটি করতে এসে নিহত হলেন। কী রকম অমানবিক হতে পারে মানুষ! ২০০৬ সালে যেভাবে সাপের মতো মানুষকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, এবারও সে রকমই ঘটেছে। এটা যাদের নামেই হোক, ভয়ংকর।

সরকারের প্রতিনিধিরা দ্ব্যর্থহীনভাবে অভিযোগ করে যাচ্ছেন। সেটা হয়তো তাদের দলের মানুষ বিশ্বাস করবে, কিন্তু তার বাইরেও তো অনেক মানুষ রয়েছে। কেন কার কারণে সহিংসতা হলো, নাকি হতে দেওয়া হলো, নাকি কোনো দলের ক্ষুদ্র একটি অংশের ইন্ধনে এটা হলোু তা তো রীতিমতো গবেষণা করে বলতে হবে।

এ অবস্থায় আস্থার সংকট শুধু দেশের মানুষের মধ্যেই তৈরি হলো না; যারা বাংলাদেশের রাজনীতির দিকে নিবিড় নজর রাখছে, তাদের মধ্যেও সেই সংকট দেখা দিতে পারে। এরই মধ্যে সমাবেশ ঘিরে সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জানিয়েছেন, তারা ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিতে সহিংসতার ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করবে।

এ ধরনের চূড়ান্ত বিবাদের পরিস্থিতি বাইরের হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেয়। ২০১৪ সালেও আমরা সরাসরি বাইরের দেশের হস্তক্ষেপ দেখেছি। এবার তো অনেক আগে থেকেই হস্তক্ষেপ শুরু হয়েছে। এখানে তো শুধু দল নয়, ব্যক্তিবিশেষকেও প্রশ্ন করা হচ্ছে।

আজকের পত্রিকায় যে দেখলাম, ব্রিফিংয়ে সব পার্টিকে শান্ত থাকতে বলেছে। ভিসা নীতির আলোকে সহিংসতার দায় দেখা হবে। এটা আমার জন্য সমস্যা না; কিন্তু যাদের যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হবে, তাদের তো ভাবতে হবে। এটা তো একটা জাতির জন্য অপমান। আমাদের মতো একটা উঠতি দেশ, এমন অপমান কেন আমরা ডেকে আনব। আমাদের স্বাধীনতা তো টেবিলে আসেনি; স্বাধীনতা তো রক্তের মাধ্যমে এসেছে। সে রকম একটা দেশ এ রকম একটা বদনামের মধ্যে পড়ে গেলাম।

সংকট শুধু আস্থার নয়, গণতন্ত্রের জন্য জরুরি প্রতিষ্ঠানগুলোও আস্থার সংকটে। তাই কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই বিবাদ মীমাংসা করা সম্ভব হয় না। শোনা যায়, নভেম্বরের মাঝামাঝি তপশিল ঘোষণা করতে হবে। তার আগে যে পরিস্থিতি থাকার কথা, সেটা যে নেই, সেটা তো সিইসি লিখিতভাবেই জানিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, এখনও অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়নি। তিনি বলেছেন, এর পরও সংবিধান অনুযায়ী তাঁকে নির্বাচন করতে হবে। তাঁকে তো নির্বাচন করতেই হবে। উনি তো সরকারের সঙ্গে আলাপ করলেন না যে এ পরিস্থিতিতে কী করা যায়। উনি তো বিচার বিভাগের সঙ্গেও আলোচনা করতে পারতেন; সেটাও করেননি।

এটা খুবই লজ্জাকর যে প্রতি পাঁচ বছর পর নির্বাচন করার জন্য এ রকম করে মারামারি করতে হবে। নেপালে, ভুটানে, শ্রীলঙ্কায় নির্বাচন হতে পারছে; কিন্তু আমরা পারছি না। পাকিস্তানেও নির্বাচন নিয়ে মারামারি হয় না, হলে অন্য বিষয়ে হয়। আর এখানে নির্বাচন এলেই হয়, এই পক্ষ নয়তো অন্য পক্ষ সংকট তৈরি করবে। ২০০৮-এর পর আমি নির্বাচন নিয়ে কোনো উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখিনি।

ভবিষ্যতে যে আমাদের রাজনীতির উভয় পক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে, সেটাও বলতে পারছি না। দেশে কোনো রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলে, শক্তিশালী নাগরিক সমাজ থাকলে, তারা দুই দলের মধ্যে একটা মীমাংসার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের বুদ্ধিজীবীরা বিভক্ত, মিডিয়াগুলো সব ব্যক্তিমালিকের হাতে, সেখানেও মেরূকরণ। সুতরাং বুনিয়াদি জিনিসই তো আমরা ঠিক করতে পারিনি; রাষ্ট্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোই ঠিক করতে পারিনিু প্রতিষ্ঠান ঠিক হবে কীভাবে?

এখনও আশা করি যে আমাদের রাজনীতিকরা দেশের খাতিরে, মানুষের খাতিরে কোনো আপস-মীমাংসায় আসবেন। নইলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে দেশের।

এম সাখাওয়াত হোসেন: বাংলাদেশের সাবেক নির্বাচন কমিশনার

সূত্র : সমকাল

Exit mobile version