আশরাফুজ্জামান মণ্ডল | ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ এবং ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগ থেকে ২০১৮ সালে বিএসসি শেষ করেন কামরুল হাসান। এখন উচ্চতর পড়াশোনা ও ‘নিরাপদ কর্মসংস্থানের’ খোঁজে বিদেশ পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষায় তিনি। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র তানভীর আহমেদ ও মশিউর রহমান। এ দুজনেরও ইচ্ছা বিদেশে স্থায়ী হওয়ার। তাদের মতে, পড়াশোনা শেষে দেশে অনেক কাজের সুযোগ থাকলেও যোগ্যতা অনুযায়ী তা যথাযথ নয়। চাকরির নিম্ন বেতন, অনুন্নত কর্মপরিবেশ, দক্ষতা যথাযথভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ না থাকা ও রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশগুলোকেই শেষ ভরসা হিসেবে দেখছেন তারা। আর শুধু কামরুল, তানভীর ও মশিউর নন, প্রতি বছর এমন হাজার হাজার তরুণ উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে কর্মসংস্থান নেইÑ এ অজুহাতে কাক্সিক্ষত ক্যারিয়ার গড়তে বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছেন।
তবে দেশে কর্মসংস্থান নেই, এমন অজুহাতে উচ্চশিক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা বিদেশে পাড়ি জমালেও নিয়োগদাতারা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, ফ্যাশন ও ডিজাইনিং, ভারী যন্ত্র পরিচালনা এবং বিপণন ও সরবরাহ চেইন ব্যবস্থাপনাসহ নানা খাতে দেশীয় দক্ষ কর্মীর যথেষ্ট অভাব
রয়েছে। এ ঘাটতি মেটাতেই বিদেশি কর্মী নিয়োগ দিয়ে উন্নয়ন, উৎপাদন ও রপ্তানি কার্যক্রম সচল রাখতে হচ্ছে তাদের। আবার অনেকের মত, সরকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্র্যাজুয়েটদের পেছনে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করলেও তারা বিদেশে চলে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে দেশপ্রেমের অভাব রয়েছে। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষা শেষে তরুণদের দেশ ছাড়ার পেছনে স্থানীয় শ্রমবাজারের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কারিকুলামের সমন্বয়হীনতাকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। এছাড়া উচ্চ দক্ষতার শিক্ষার্থীদের জন্য হাইভ্যালু এডিশন ইন্ডাস্ট্রি গড়ার ওপরও গুরুত্বারোপ করেছেন তারা।
৫ লাখ বিদেশি কর্মী ও বিদেশমুখী মেধা : চলতি বছরের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ (বিডা) সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা ও শিল্প বণিক সমিতিতে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে বিদেশি কর্মীর সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়েছে। আর এসব বিদেশি কর্মী দেশ থেকে বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। বিডার চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, নিয়োগদাতারা মনে করেন ফ্যাশন ও ডিজাইনিং, ভারী যন্ত্র পরিচালনা, বিপণন ও সরবরাহ চেইন ব্যবস্থাপনাসহ নানা খাতে দেশীয় দক্ষ কর্মীর যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এ ঘাটতি মেটাতে বিদেশি কর্মী নিয়োগ দিয়ে উন্নয়ন, উৎপাদন ও রপ্তানি কার্যক্রম সচল রাখতে হচ্ছে।
উচ্চশিক্ষা শেষে বিদেশে স্থায়ী হওয়া শিক্ষার্থীর প্রকৃত সংখ্যার বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছেই সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ২০১৬ সালে গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো)। সেখানে বলা হয়েছিল, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৬০ হাজার শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাচ্ছেন। আর এ বছরের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওপেন ডোরস রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশটির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আট হাজারের বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। এ সংখ্যা বছরে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্রকল্যাণ পরিচালক (ডিএসডব্লিউ) কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক অরুনাংশু বড়–য়া দেশ রূপান্তরকে জানান, প্রতি বছর এ বিশ্ববিদ্যালয়টির ১৮টি বিভাগ থেকে এক হাজার শিক্ষার্থী স্নাতক সম্পন্ন করেন। এর মধ্যে ইইই, কম্পিউটার সায়েন্স, মেকানিক্যাল ও বায়ো মেডিকেল বিভাগের ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থীই পিএইচডি ও ভালো কর্মসংস্থানের খোঁজে দেশের বাইরে চলে যান। পড়াশোনা শেষে অনেকে দেশে ফিরলেও ৩০ শতাংশের বেশি বাইরেই থেকে যান। বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য বলছে, কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের ১৯৮৬-এর ব্যাচে মোট শিক্ষার্থী ছিলেন ৩১ জন। তাদের ২৫ জনই এখন বিদেশে। ১৯৯৪-এর ব্যাচের ৪৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৫ জন রয়েছেন দেশের বাইরে। ১৯৯৮-এর ব্যাচের ৬৫ জনের মধ্যে ৩০ জন বিদেশে। তারা বিশ্বের নানা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন।
বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. ফয়সাল আহমেদ জানান, ২০০০ সালে পাস করে বের হওয়া তাদের ব্যাচে ১৩০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে অর্ধেকই দেশের বাইরে স্থায়ী হয়েছেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের স্টুডেন্ট এফিসিয়েন্সি (দক্ষতা) অনুযায়ী দেশে কাজ পাওয়া যায় না। এসব স্টুডেন্ট বিদেশে গিয়ে মাইক্রোসফট ও ইন্টেলসহ বড় বড় মোবাইল এবং মোটর কোম্পানিতে চাকরি পাচ্ছে। দেশে এখন পর্যন্ত বড় একটি মোবাইল কোম্পানি হলো না, যেখানে আমাদের ছেলেরা নিজেদের মেধা কাজে লাগিয়ে কাজ করবে। এসব হতাশায় দেশ ছাড়েন তারা।’
জানা গেছে, শুধু বুয়েট নয়, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরাও বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য ভিড় করছেন। এছাড়া পিএইচডি করতে গিয়ে নানা সময় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকও আর দেশে ফিরে আসেননি। ইউজিসির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩৭টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ হাজার ৯৪০ জন শিক্ষক শিক্ষা ছুটিতে বিদেশে আছেন। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা একজন শিক্ষার্থীর পেছনে সরকারের মোট ব্যয় ৫ লাখ টাকার বেশি। অন্যদিকে বুয়েটে এ ব্যয় কমপক্ষে ১০ লাখ এবং সরকারি মেডিকেল কলেজে ১৫ লাখ টাকার ওপর। আর জনগণের দেওয়া করের টাকায় ওই অর্থ জোগায় সরকার।
দেশ ছেড়ে বিদেশে স্থায়ী হওয়ার কারণ জানতে চাইলে বুয়েটের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ সবার মুখেই উঠে আসে দেশ সম্পর্কে নানা হতাশার কথা। বুয়েটপড়–য়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার সন্তানকে আমি কী উদ্দেশ্যে দেশে রাখব? প্রথমত দেশে ওর যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ নেই, দ্বিতীয়ত সৎ হিসেবে বাঁচার উপায়ও নেই।’
বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এমএসসির ছাত্র জায়িদ ইবনে মাহমুদ বলেন, ‘দেশের টেকনিক্যাল খাতগুলো চালায় নন-টেকনিক্যাল লোক। তারা কাজ না বুঝলেও কাজে বাধা দেন ঠিকই।’
শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশ ছেড়ে বিদেশে স্থায়ী হওয়ার প্রবণতার কারণ জানতে চাইলে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের দুই ধরনের সমস্যা হয়েছে। প্রথমত লেবার মার্কেটের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামের সমন্বয় হচ্ছে না। এতে যেসব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হচ্ছে, তারা জব মার্কেটের জন্য প্রস্তুত নয়। আবার মার্কেটে মিড লেভেলের টেকনিক্যাল কর্মীর চাহিদা আছে, কিন্তু সেটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করছে না। ফলে অধিক খরচে বিদেশি কর্মী আনছে উদ্যোক্তারা। আর উচ্চ দক্ষতার শিক্ষার্থীদের জন্য হাইভ্যালু এডিশন ইন্ডাস্ট্রি গড়তে হবে। এজন্য প্রচুর বিনিয়োগ দরকার।’
তবে পরিকল্পনা কমিশনের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. শামসুল আলম বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশে কাজ নেই বললেও বিদেশিরা এসে কাজ করছেন। হয়তো মনমতো কাজের অভাব আছে, তাই বলে কাজ নেই এ ধারণা অবান্তর। সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের পেছনে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে। অথচ তারা বিদেশে চলে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে দেশ প্রেমের অভাব রয়েছে।’
মেগা বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মসংস্থানের হাতছানি : রাশিয়ার অর্থায়ন ও কারিগরি সহযোগিতায় নির্মাণাধীন পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে এক্সিকিউটিভ (প্রশিক্ষণ) হিসেবে গত এপ্রিলে যোগ দিয়েছেন ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) ছাত্র শ্যামল রায়। গেল সেপ্টেম্বরে পরমাণু প্রকৌশল ও প্রযুক্তির ওপর প্রশিক্ষণ নিতে তাকে রাশিয়ার রোসাটম টেকনিক্যাল একাডেমিতে পাঠায় রূপপুর কর্র্তৃপক্ষ। গত শুক্রবার রাশিয়া থেকে টেলিফোনে দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট চালানোর জনশক্তি হিসেবে দেশীয় ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করা হচ্ছে। আমাদের গ্রুপে ১০ জন ফ্রেশ ও হালকা অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার এসেছে। আরও কয়েকটি গ্রুপে অন্যরা ট্রেনিং করছেন। এর আগেও অনেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে গেছেন। নিজের দেশেই এত বড় কাজের সুযোগ, সত্যি এ এক দারুণ অভিজ্ঞতা।’
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জনসংযোগ বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, কেন্দ্রটির দুটি চুল্লি উৎপাদনে এলে এটি ব্যবস্থাপনার জন্য ২ হাজার ৭০০ জনশক্তির প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে পরমাণু প্রকৌশল ও প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন প্রকৌশলী থাকবেন ১ হাজার ৭০০ জন। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে ৩০০ জন (অভিজ্ঞ-অনভিজ্ঞ) প্রকৌশলী নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
অন্যদিকে ১৩২০ মেগাওয়াটের রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা আনোয়ারুল আজীম দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, প্রকল্পটি শুরুর সময় ৫০ জন ভারতীয় কর্মকর্তা কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪০ জন। কেন্দ্রটির মূল প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল) এখন তাদের নিজস্ব জনবল তৈরি করছে। বর্তমানে সেখানে অভিজ্ঞ-অনভিজ্ঞ মিলে ৩০ জন প্রকৌশলী কর্মরত। এছাড়া আরও ৩০ জন প্রকৌশলী নিয়োগের প্রক্রিয়া চলমান আছে। আর আগামী এক বছরে এই সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যাবে। একইভাবে নির্মাণাধীন পায়রা ও মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বড় প্রকল্পগুলো পরিচালনায় দেশীয় জনশক্তি তৈরির কাজ চলছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বড় প্রকল্প তৈরির অভিজ্ঞতা আমাদের না থাকায় বিদেশি প্রযুক্তি ও জ্ঞানে এগুলো তৈরি করা হচ্ছে। নির্মাণ শেষে আমাদের প্রকৌশলীরাই এগুলো চালাবেন। দেশে এখন টেলিকম, বিদ্যুৎ ও জ¦লানি খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে কেউ যদি মনে করেন বিদেশের মতো শুরুতেই মাসে ২ লাখ টাকা বেতন পাবেন, তাহলে এই সুযোগ দেশে এখনো নেই, ভবিষ্যতেও হবে না।’