নিজস্ব প্রতিবেদক
এক সময় ক্রমাগত রুপি ছাপিয়ে বাজারে তারল্য বাড়িয়ে তুলছিল সিবিএসএল। দেশটির মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পেছনে এটিকেও দেখা হচ্ছিল অন্যতম বড় কারণ হিসেবে। বর্তমানে দেশটির পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ার পেছনে অন্যতম বড় কৃতিত্ব দেয়া হচ্ছে সিবিএসএলের গভর্নর নন্দলাল বীরাসিংহকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মুদ্রা ছাপানো এখন পুরোপুরি বন্ধ রেখেছেন তিনি। সুদহার বাড়িয়ে নিয়ন্ত্রণ করেছেন ঋণের প্রবাহ। আবার এ বর্ধিত সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়েছে বাজারভিত্তিক পদ্ধতিকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা (বিশেষ করে ডলার) ক্রয়-বিক্রয়ের প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রুপির বিনিময় হারে পতন ঠেকিয়েছেন। বর্তমানে ডলারসহ অন্যান্য মুদ্রার বিপরীতে লংকান রুপির বিনিময় হার বাড়ছে। ব্যাংকগুলোয় নগদ অর্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ। ঋণ বাড়ানোর পরিবর্তে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নির্দিষ্ট হারে তারল্য আমানত হিসেবে জমা রাখতে হচ্ছে। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলেও তা ছাড় করায় নগদ অর্থের পরিবর্তে ব্যবহার হচ্ছে বিনিময়যোগ্য অন্যান্য সম্পদ। এতে বাজারে বা ব্যাংকগুলোয় তারল্য প্রবাহ না বাড়লেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়ছে।
সেপ্টেম্বরে দ্বীপদেশটিতে মূল্যস্ফীতি যখন প্রায় ৭০ শতাংশে উঠে দাঁড়ায়, সে সময় বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। ১০ মাস পর এখনো তা ৯ শতাংশের ঘরেই রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, জুনে দেশে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এর আগে মে মাসে দেশে মূল্যস্ফীতির হার এক যুগে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে দাঁড়ায়। জুলাইয়ের তথ্য এখনো প্রকাশ না হলেও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ও দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের নিচে নামার সম্ভাবনা কম।
নীতিনির্ধারকসহ অর্থনীতিবিদদের একাংশ বিভিন্ন সময় বলেছেন, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি আমদানীকৃত। বৈশ্বিক ভোগ্যপণ্যের বাজারে মূল্যের অস্থিতিশীলতার কারণে আমদানীকৃত পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরাও। এজন্য কভিডের প্রাদুর্ভাব থেকে শুরু করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত, বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের ব্যাঘাতসহ নানাবিধ কারণকে দায়ী করা হয়েছে। যদিও গত কয়েক মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি থেকে শুরু করে অধিকাংশ পণ্যের দাম অব্যাহত হারে কমেছে। কোনো কোনো পণ্যের দাম এরই মধ্যে প্রাক-কভিড পর্যায়ে নেমে এসেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য ক্রমেই কমতে থাকায় বিশ্বের প্রায় সব দেশেই মূল্যস্ফীতির চিত্রে দেখা গেছে বড় পরিবর্তন। যদিও দেশের বাজারে দেখা যাচ্ছে পুরোপুরি বিপরীত চিত্র। বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্যসহ সব পণ্যের দাম এখনো অস্থিতিশীল। নিয়ন্ত্রণে আসছে না মূল্যস্ফীতির হার।
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত পিংক শিটের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি পণ্য, ভোজ্যতেল, তুলা, সার ও ব্যবহারিক (শিল্প) ধাতুর মূল্য ছিল নিম্নমুখী। গত বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ ব্রেন্টের গড় মূল্য ছিল প্রতি ব্যারেল ১১২ ডলার ৭০ সেন্ট। চলতি বছরের জুনে পণ্যটির মাসভিত্তিক গড় মূল্য দাঁড়ায় প্রতি ব্যারেল ৭৪ ডলার ৯০ সেন্টে। একইভাবে পাম অয়েল ও সয়াবিন তেলের গড় মূল্য ২০২২ সালের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ছিল টনপ্রতি যথাক্রমে ১ হাজার ৬৩৪ ডলার ও ১ হাজার ৮৮৭ ডলার। চলতি পঞ্জিকাবর্ষের জুনে পণ্য দুটির গড় মূল্য নেমে আসে টনপ্রতি যথাক্রমে ৮১৭ ডলার ও ১ হাজার ৭ ডলারে। গমের দাম এ সময় টনপ্রতি ৪৯২ ডলার ৪০ সেন্ট থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৩৪৫ ডলার ৫০ সেন্টে। তুলার গড় দাম গত বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ছিল প্রতি কেজি ৩ ডলার ৪৮ সেন্ট। ২০২৩ সালের জুনে পণ্যটির মাসভিত্তিক গড় মূল্য ছিল ২ ডলার ৪ সেন্ট। একইভাবে অ্যালুমিনিয়াম ছাড়া অন্য সবক’টি ব্যবহারিক ধাতুরই (তামা, আকরিক লোহা, সিসা, নিকেল, টিন ও দস্তা) দাম এ সময়ে কমেছে। এ সময় ডিএপি সারের দাম টনপ্রতি ৮৬০ ডলার ১০ সেন্ট থেকে ৪৫৪ ডলার ৬০ সেন্টে নেমেছে। একই সঙ্গে এমওপি সারের দাম টনপ্রতি ১ হাজার ১৫৮ ডলার থেকে নেমেছে ৩২৮ ডলারে। এছাড়া টিএসপি সারের দাম ৮০৪ ডলার ৫০ সেন্ট থেকে নেমেছে ৩৯০ ডলারে। যদিও বাংলাদেশের বাজারে এ সময় পণ্যগুলোর দামে আন্তর্জাতিক বাজারের নিম্নমুখিতার তেমন কোনো প্রতিফলন দেখা দেয়নি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সরকারের অভ্যন্তরীণ নীতিমালার কারণে বাংলাদেশ এখনো আন্তর্জাতিক বাজারের দাম কমার সুযোগ নিতে পারেনি। আগামীতে যেসব পদক্ষেপ আসবে, তার কারণে যে মূল্যস্ফীতি কমবে; সেটিও মনে হচ্ছে না। সরকার পূর্ণভাবে নীতিমালা বাস্তবায়ন এখনো করেনি। এক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো মুদ্রানীতির সঙ্গে আর্থিক নীতির বৈপরীত্য রয়ে গেছে। সুদহার সেভাবে বাড়েনি। টাকার বিনিময় হারও একীভূত করা হয়নি। এগুলোর সমন্বয় হলে মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতি কেমন দাঁড়াবে, তা এখনো বলা মুশকিল। তবে তা কমার সম্ভাবনা কম।’
সিবিএসএল টাকা ছাপানোর পথ পরিহার করলেও বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো তা বজায় রেখেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসার অন্যতম কারণ হিসেবে বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়টিকেও দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সারা বিশ্বে গত এক বছরে ধনী, মধ্যম আয় ও গরিবসহ সব দেশের মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখী। আমাদের এখানে কেন কমল না, এর উত্তর খুঁজতে হবে দুদিক থেকে। সেটি হলো আমাদের এখানে চাহিদা ও জোগানের দিক থেকে কী হয়েছে? বিশ্বে সবাই চাহিদাকে সংকুচিত করেছে। সুদহার বৃদ্ধি করেছে। আমরা সেটা করিনি। আমরা সুদহার বৃদ্ধি করেছি ব্যাংকিং সিস্টেমের ভেতরে। এর ফলে ব্যাংকারদের টাকা নেয়ার খরচ বেড়েছে, কিন্তু বাজারে কোনো প্রভাব পড়েনি। কাজেই সুদহারের বৃদ্ধি আমাদের চাহিদা নিয়ন্ত্রণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, টাকা ছাপিয়ে সরকারি কাজে অর্থায়ন করা হয়েছে, অর্থনীতিতে টাকার জোগান হয়েছে প্রচুর। ফলে চাহিদা সংকোচনের জায়গায় সম্প্রসারণ হয়েছে অনেক বেশি। এটি মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দিয়েছে। সারা বিশ্ব যখন চাহিদা সংকোচনের দিকে এগিয়েছে, আমরা চাহিদা সম্প্রসারণের মতো পদক্ষেপ নিয়েছি। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস, সারসহ সব পণ্যের দাম কমেছে। আমাদের এখানে তা সংক্রমিত হলো না। যখন দাম বেড়েছিল তখন ঠিকই সংক্রমণ করেছে। সরকার যেসব পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে যেমন জ্বালানি তেল, গ্যাস ইত্যাদি; সেগুলোর দাম কিন্তু কমানো হয়নি। আরেকটি বিষয় হলো বাজারে প্রতিযোগিতার অভাব রয়েছে। বড় কিছু খেলোয়াড় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলেও একচেটিয়া বাজারের খেলোয়াড়রা দাম কমায়নি। ডলার সংকট মোকাবেলার জন্য আমদানির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। যার ফলে জোগান কমেছে, জোগান যে শুধু ভোগ্যপণ্যের কমেছে তা নয়—শিল্প, কৃষি, সেবা খাতের উৎপাদনের জন্য যে যন্ত্রপাতি লাগে, সেগুলোর আমদানিও পর্যাপ্ত পরিমাণ করা যায়নি। ফলে আমাদের উৎপাদন বিঘ্নিত হয়েছে, জোগান কমেছে। এতে চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বেড়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ডলার সংকট কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশ ব্যাংক সেপ্টেম্বরে বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হারের দিকে যাবে বলছে। তাহলে হয়তো বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বাড়তে পারে। তখন এলএনজি-যন্ত্রপাতি আনতে পারব, পণ্যের উৎপাদন বাড়বে, বিদ্যুৎ বিভ্রাট যে পরিমাণ হচ্ছে তা হবে না। সেক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির ওপর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আবহাওয়া অনুকূল হলে আমনের ফলন যদি ভালো হয়, শাকসবজি যদি ভালো উৎপাদন হয়; তাহলে জোগান বাড়বে। এটা তো একদম ভাগ্যের ওপর নির্ভর করবে।’
দেউলিয়া হয়ে পড়া শ্রীলংকার ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে সন্দিহান ছিলেন অর্থনীতিবিদসহ বিশেষজ্ঞরা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) এ অনিশ্চয়তার কারণে চলতি বছরের মার্চের আগে শ্রীলংকার জন্য বেইলআউট প্যাকেজ ছাড় করেনি। যদিও ওই সময়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বেশ উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছে দেশটি। নাসডাকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত দেশটির মুদ্রা শ্রীলংকান রুপির বিনিময় হার বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। এজন্য সিবিএসএলের বিনিময় হারের দক্ষ ও কার্যকর ব্যবস্থাপনাকে কৃতিত্ব দিচ্ছেন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য গত মার্চ পর্যন্ত দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার বাড়িয়েছিল রেকর্ড ১ হাজার ৫০ বেসিস পয়েন্ট (১০ দশমিক ৫০ শতাংশ)। পরিস্থিতি উন্নয়ন হওয়ায় এখন সুদহার সহজীকরণের কথা ভাবছেন সিবিএসএলের কর্মকর্তারা। গত জুন ও জুলাইয়ে মোট ৪৫০ বেসিস পয়েন্ট (সাড়ে ৪ শতাংশ) সুদহার কমিয়েছে সিবিএসএল। বছরের শেষার্ধ্বে তা আরো কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর নেতারা মনে করছেন, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। এজন্য আমদানিনির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছেন তারা। দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সম্ভাব্য পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের নবনির্বাচিত সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি আরো কমাতে হবে। মূল্যস্ফীতির ওপর সবকিছু নির্ভর করে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। মানুষের ব্যয় বেড়েছে। এগুলো অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আমাদের দেশীয় শিল্পগুলোকে সুরক্ষা দেয়া, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং আস্তে আস্তে আমদানিনির্ভরতা থেকে রফতানিনির্ভরতার দিকে যেতে হবে। একই সঙ্গে রেমিট্যান্সও আনতে হবে। এর বিকল্প কিছু নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে ও নিচ্ছে। কিন্তু এই যে এলসিতে নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি—এটি জরুরি পণ্য ছাড়া অন্যান্য পণ্যের বেলায় ঠিক আছে। যতক্ষণ না আমাদের নিজস্ব উৎপাদন বাড়ানো যাবে, ততক্ষণ আমাদের আমদানিনির্ভর দেশ হয়েই থাকতে হবে। আর আমদানি করলেই মূল্যস্ফীতি বাড়বে।’
শ্রীলংকায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও এখন ঊর্ধ্বমুখী। গত বছরের শেষে দেশটিতে বৈদেশিক মুদ্রার মোট রিজার্ভ ছিল ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন (১৯০ কোটি) ডলার। সেখান থেকে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গত জুন শেষে তা ৩ দশমিক ৭ বিলিয়নে (৩৭০ কোটি) ডলারে দাঁড়িয়েছে বলে সিবিএসএলের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। আইএমএফের ঋণ ও এর পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটায় দেশটি এখন বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে নতুন করে ঋণসহায়তার সুযোগও পাচ্ছে।
দেশটিকে নিয়ে আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা মুডি’সের সর্বশেষ পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, মূলধন নিয়ন্ত্রণ ও আমদানিতে বিধিনিষেধ সহজ করে দিয়েছে শ্রীলংকা। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, দেশটির বৈদেশিক মুদ্রাসংক্রান্ত চাপ এখন প্রশমিত হয়ে আসছে, যা দেশটির ঋণমান পরিস্থিতির জন্য ইতিবাচক।
লংকাদ্বীপকে নিয়ে আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থাগুলোর মূল্যায়নে এখন ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেখা দিলেও বাংলাদেশ নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এখন আগের চেয়ে কিছুটা নেতিবাচক। গত মে মাসের শেষদিকে বাংলাদেশের ঋণমান বিএ৩ থেকে বি১-এ নামিয়ে আনে মুডি’স। এরপর গত মাসের শেষদিকে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি রেটিং আউটলুক স্থিতিশীল থেকে নেতিবাচক পর্যায়ে নামিয়ে আনে ঋণমান নিরূপণকারী আরেক বড় সংস্থা এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল। প্রতিষ্ঠানটির আশঙ্কা, আগামী বছর বাংলাদেশের তারল্য পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরো চাপের মধ্যে পড়বে।
শ্রীলংকার মতো দেউলিয়াত্বের কাছাকাছি পর্যায়ে চলে গিয়েছিল পাকিস্তানও। আইএমএফের বেইলআউট প্যাকেজের কিস্তি ছাড় করাতে পারলেও এখনো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে দেশটি। সর্বশেষ গত মাসে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ২৮ দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে বলে পাকিস্তান ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকসের পরিসংখ্যানে এসেছে। এর মধ্যে আবার দেশটির সরকার গত মঙ্গলবার পেট্রলসহ জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। শিগগিরই দেশটিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসার কোনো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা।
প্রতিবেশী ভারতে দেখা যাচ্ছে এর বিপরীত চিত্র। মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের ওপরে উঠলেই সেটিকে সহনীয় মাত্রার বেশি বলে ঘোষণা দিয়েছে শক্তিকান্ত দাশের নেতৃত্বাধীন রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই)। রয়টার্সে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জুনে দেশটিতে খুচরা মূল্যস্ফীতির হার ছিল আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ। আরবিআই জানিয়েছে, ২০২৩ সালে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ২ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতিকে এ লক্ষ্যসীমার মাঝামাঝি অর্থাৎ ৪ শতাংশের কাছাকাছি বেঁধে ফেলার লক্ষ্য থাকবে ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, ‘শ্রীলংকার অর্থনীতির কাঠামো ও ব্যবস্থাপনা আলাদা। আমাদের অর্থনীতির আকার তাদের চেয়ে অনেক বড়। তাছাড়া তাদের চেয়ে আমাদের চ্যালেঞ্জও ভিন্ন। তাই তাদের মূল্যস্ফীতি কমলে আমাদেরও কমতে হবে, বিষয়টি এমন নয়। তাদের অনেক ব্যর্থতার করণে মূল্যস্ফীতি ৭০ শতাংশের মতো হয়েছিল। কিন্তু আমাদের তো দুই অংকের ঘরে যায়নি। তবে মূল্যস্ফীতি আগের চেয়ে বেড়েছে। এটি কিন্তু অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার জন্য নয়। এটি আমদানীকৃত মূল্যস্ফীতি। আর একবার মূল্যস্ফীতি ঘটে গেলে উৎপাদনের উপকরণের দাম বেড়ে যায়। তখন মূল্যস্ফীতি কমতে সময় লাগে। যতটা দ্রুত বাড়ে ততটা দ্রুত কমে না, এটাই সাধারণ নীতি। আমাদের এখনো এক অংকের ঘরে আছে। আর ধীরে ধীরে এটি কমে আসবে।’