- ইকতেদার আহমেদ
- ০৬ জুলাই ২০২০
‘নীতি’ শব্দটির বিপরীত শব্দ দুর্নীতি। যেকোনো ধরনের অনিয়ম দুর্নীতির অন্তর্ভুক্ত হলেও সাধারণ্যে একটি ধারণা বহুল প্রচলিত যে, দুর্নীতি শুধু ঘুষকে আকৃষ্ট করে। ঘুষ অবশ্যই দুর্নীতি; তবে ঘুষের পাশাপাশি অন্যায় ও অনিয়মও দুর্নীতি। একজন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ বা স্কুলের শিক্ষক যদি যেকোনো কারণে একটি ছাত্র বা ছাত্রীর কাছে দুর্বল এ বিবেচনায় তাকে পরীক্ষায় ভালো নম্বর দিয়ে অতি মূল্যায়িত করেন সে ক্ষেত্রে এটি দুর্নীতি। অনুরূপ সরকারের যেকোনো বিভাগের একজন কর্মকর্তা কনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও জ্যেষ্ঠদের সততা, দক্ষতা ও যোগ্যতাকে অবমূল্যায়ন করে যদি কনিষ্ঠকে বিভাগের সর্বোচ্চ পদে বসানো বা পদোন্নতি দেয়া হয় সেটিও দুর্নীতি। ঘুষ বা উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে চাকরি দেয়া যেমন দুর্নীতি অনুরূপ নিজের আত্মীয়-স্বজন বা নিজ গ্রামের বা নিজ জেলার কোনো ব্যক্তিকে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে চাকরি দেয়াও দুর্নীতি। একজন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অর্থ দিয়ে যদি জীবনযাপন করেন তাও দুর্নীতি। আবার একজন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী কর্তৃক সরকারি সম্পদের যেকোনো ধরনের অপব্যবহারও দুর্নীতি; যেমন গাড়ির অপব্যবহার, টেলিফোনের অপব্যবহার। অফিসের মধ্যে গল্পগুজবের মাধ্যমে সময় অপচয় করাও দুর্নীতি। সহজ-সরল ভাষায় নীতিবহির্ভূত যেকোনো কিছুই দুর্নীতি।
বাঙালি জাতি ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা সে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ফলকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষাপূর্বক বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের বাঙালি জাতির প্রতি এ অন্যায়ও দুর্নীতি।
পৃথিবীর যেকোনো দেশের একটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের দুর্নীতি পরিমাপের দু’টি পদ্ধতি রয়েছে। এর একটি হলো একটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সর্বমোট কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যত শতাংশ দুর্নীতিগ্রস্ত সে মন্ত্রণালয় বা বিভাগে দুর্নীতি তত শতাংশ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগে ১০০ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মধ্যে ৯০ জন দুর্নীতিগ্রস্ত হলে সে বিভাগে দুর্নীতির হার ৯০ শতাংশ। অপর পদ্ধতিটি হলো একটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারী বেতন ও ভাতাদি বাবদ সরকারের কাছ থেকে বার্ষিক যে অর্থ প্রাপ্ত হয় ওই মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী যদি দুর্নীতি বা অসদুপায় অবলম্বনের মাধ্যমে তার সমপরিমাণ বা দ্বিগুণ বা ঊর্ধ্বমুখী গুণিতক পরিমাণ অর্থসম্পদ প্রাপ্ত হয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে সে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের দুর্নীতি সমপরিমাণের ক্ষেত্রে শত ভাগ বা ঊর্ধ্বমুখী যত ভাগ হবে তত ভাগ। উপরোক্ত দু’টি পদ্ধতির মধ্যে শেষোক্ত পদ্ধতিটি আমাদের দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগের দুর্নীতির চিত্র সামনে রেখে বিবেচনায় নেয়া হলে বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশে এমন কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগ পাওয়া যাবে না যেখানে দুর্নীতি শত ভাগ নয়। আবার এ কথাটিও ঠিক, দুর্নীতির মাত্রা শত ভাগের ১০ গুণ অর্থাৎ এক হাজার ভাগ অতিক্রম করে গেছে এমন মন্ত্রণালয় বা বিভাগ যে রয়েছে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
বিশ্বব্যাপী যে সংস্থাটি বিভিন্ন দেশের দুর্নীতির মাত্রা পরিমাপপূর্বক মান নির্ধারণ করে সেটির নাম ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)। এ সংস্থাটির কার্যক্রম বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বিদ্যমান রয়েছে। এ সংস্থাটির ধারণাসূচকে বাংলাদেশ ২০০০-২০০৪ এ পাঁচ বছর পরপর বিশ্বের সর্বোচ্চ দুর্নীতগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হতে থাকলেও বিগত বছরের চেয়ে এ বছর দু’ধাপ নেমে বাংলাদেশের অবস্থান নিম্নের দিক থেকে ১৪তম। অতীতে দেখা গেছে, যখনই বাংলাদেশ টিআই কর্তৃক শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে অথবা যখনই দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান নিম্নমুখী হয়েছে তখনই ক্ষমতাসীনরা এটিকে সহজভাবে নেয়নি। এ বছরও যখন বাংলাদেশের অবস্থান ১৬তম থেকে ১৪তে নেমে এলো সরকার এটিকে সহজভাবে নেয়নি এবং সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হলো ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) দেশের রাঘববোয়ালদের দুর্নীতিকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষাপূর্বক ছোটখাটোদের দুর্নীতি নিয়ে অধিক ব্যস্ত।
টিআইবি কর্তৃক দেশের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বিষয়ে অতীতে যেসব জরিপ পরিচালিত হয়েছে তা পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশের প্রধান বিভাগগুলোর মধ্যে অন্যতম ভূমি প্রশাসন, রাজস্ব, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থাপনা, জনপ্রাশাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান প্রভৃতির যেকোনো একটি বা একাধিক কোনো না কোনো বছর শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত বিভাগ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যে বছর যে এক বা একাধিক বিভাগ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে সে বছর দেখা গেছে টিআইবি’র প্রতিবেদন বস্তুনিষ্ঠ নয় সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করে তা খণ্ডন করার প্রয়াস নেয়া হয়নি বা নেয়া হলেও তা খণ্ডন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আমাদের বাংলাদেশে টিআইবি একটি ট্রাস্টি বোর্ডে পরিচালিত। টিআইবি দেশের সব বিভাগের দুর্নীতি নিয়ে মাথা ঘামালেও কোনো এক বছর দেখা গেল বাংলাদেশ যখন শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ তখন টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন। এ বিষয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হলেও দুঃখজনক হলেও সত্য অদ্যাবধি টিআইবি লিখিত বা মৌখিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। তা ছাড়া টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডে এবং নির্বাহী দায়িত্বে যারা আছেন তাদের সবাই যে ধোয়া তুলসী পাতা দেশবাসীর সামনে এমন স্বচ্ছ চিত্র এখনো অনুপস্থিত।
বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। ’৭০-এর দশকে প্রতি বছর আমাদের খাদ্য আমদানি করতে হতো। আজ আমাদের জনসংখ্যা ’৭০-এর দশকের তুলনায় দ্বিগুণ অতিক্রম করলেও আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এটি সম্ভব হয়েছে একমাত্র কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে। যে কৃষক আমাদের অর্থনীতিতে অনন্য অবদান রেখে চলেছেন, সে কৃষকের ন্যূনতম চাহিদা গণতন্ত্র ও শোষণমুক্ত সমাজ আমরা কি দিতে পেরেছি? আর পারিনি বলেই এখন পর্যন্ত আমাদের কাক্সিক্ষত অগ্রগতি ও উন্নতি সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতা-পরবর্তী বারবার আমাদের দেশে গণতন্ত্র ব্যাহত হওয়ার কারণে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের পূবশর্ত হলো সুশাসন এবং একমাত্র গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে।
আমাদের দেশে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে এক দিকে যেমন সুশাসন নিশ্চিত হয়নি অপর দিকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জাতি আজ দু’টি ধারায় বিভক্ত। এ ধরনের বিভাজন একটি জাতি ও দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্তরায়। তাই এ বিভাজন রোধের উপায় রাজনীতিবিদদেরই বের করতে হবে।
আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে ২০২১ সালে সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে যাচ্ছি। সরকারের পক্ষ থেকে জোর দিয়ে বলা হচ্ছে ২০২১ সালের আগেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে এবং এর ২০ বছর পর বাংলাদেশের স্থান হবে উন্নত দেশের সারিতে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারবে কি না অথবা ২০৪১ সালে উন্নত দেশের সারিতে পৌঁছতে পারবে কি না এ দু’টি বিষয়ে দেশের সব সচেতন জনমানুষের মধ্যে অনেকের সংশয় থাকলেও এ কথাটি অনেকটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আমরা যদি গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারতাম অর্থাৎ প্রতি পাঁচ বছর পরপর অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা যেত এবং দুর্নীতিকে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসা সম্ভব হতো তাহলে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার বহু আগেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা যেত।
যেকোনো দেশের জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ এবং সশস্ত্র বাহিনী সে দেশের মেরুদণ্ড। একটি দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে এবং দেশটিকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে হলে উপরোক্ত বিভাগগুলোতে জ্যেষ্ঠতা, দক্ষতা, যোগ্যতা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতার মাধ্যমে নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন ও বদলি আবশ্যক। কিন্তু আমাদের দেশের উপরোক্ত বিভাগগুলোর চিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায় রাজনৈতিক কারণে বিভাগগুলোর কর্মকর্তারা দ্বিধাবিভক্ত এবং এ কারণে একটি সরকারের সময় যারা মূল্যায়িত হচ্ছেন অপর সরকারের আগমনে তাদের অবমূল্যায়িত হতে হচ্ছে। অতি মূল্যায়ন ও অবমূল্যায়নের দোলাচলে আজ এসব বিভাগের শৃঙ্খল অনেকটা বিনষ্ট। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মকর্তা বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে চরম হতাশায় দিনাতিপাত করছেন। আবার আত্মসম্মান আছে এমন অনেক কর্মকর্তা অবমাননাকর পরিস্থিতি এড়াতে অপরিপক্ব স্বেচ্ছা অবসরে চলে গেছেন।
বাংলাদেশে অদ্যাবধি ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত না হওয়ায় কে মুক্তিযোদ্ধা এবং কে মুক্তিযোদ্ধা নয় এটি নিরূপণ করা কঠিন। এমন এক অবস্থায় দেখা গেছে সরকারের শীর্ষ পদধারী সচিবসহ অনেকেই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। এ সব সচিবসহ যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহ করেছেন, শুনা যায় তাদের অনেকে এটি সংগ্রহের পেছনে লক্ষ-কোটি টাকা ব্যয় করেছেন। আর লক্ষ-কোটি টাকা ব্যয় করবেন না-ইবা কেন। উচ্চ বা লোভনীয় পদে চাকরির মেয়াদ ২-৩ বছর বৃদ্ধির অর্থই হচ্ছে কী পরিমাণ অবৈধ অর্থ উপার্জনের দ্বার উন্মোচন তা ভেবে দেখলে অবাক না হয়ে পারা যায় না।
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা অনুসৃত হয় এমন সব দেশের নাগরিকরা চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে ভোগ করে থাকেন। একটি দেশের সরকারি বেসরকারি পদে আসীন সব পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী যদি মুক্তভাবে ব্যক্তি ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতার চর্চা করতে পারেন তবে সে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধকতাগুলো তিরোহিত হয় এবং দুর্নীতি লাঘবের পথ সুগম হয়। স্বাধীনতার এত বছর পর আমরা কি বলতে পারি আমাদের দেশের নাগরিকরা যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তি ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা ভোগ করছে। এ কথাটি অনস্বীকার্য যে, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে এ দেশে সব শ্রেণিপেশার মানুষ মহান মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার মূলে ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ।
আজ আমরা এ দেশের জনমানুষের আকাক্সক্ষার গণতন্ত্র এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ থেকে বহু দূরে। আর এ অবস্থায় দুর্নীতির কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যে ভূলুণ্ঠিত এ কথাটি অত্যুক্তি নয়।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com