Site icon The Bangladesh Chronicle

দুর্দশাগ্রস্ত পদ্মা ব্যাংককে একীভূত করবে এক্সিম

নাম পরিবর্তন, নীতি ছাড় ও সরকারি ব্যাংকের মূলধন জোগান ও বিনিয়োগ—এরপরও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি দেশের চতুর্থ প্রজন্মের পদ্মা ব্যাংক। সংকটের কারণে এখনো বড় গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকটি। সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতকে শেয়ারে রূপান্তরের উদ্যোগ নিয়েও তা ব্যর্থ হয়েছে। সব শেষে এখন শরিয়াভিত্তিক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে যাচ্ছে পদ্মা ব্যাংক। ব্যাংক দুটির পরিচালনা পর্ষদ একে অপরের সঙ্গে একীভূত হওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, একীভূত হতে ব্যাংক দুটির মধ্যে আগামী সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের উপস্থিতিতে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হওয়ার কথা রয়েছে। এতে দুই ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি উদ্যোক্তাদেরও উপস্থিত থাকার কথা।

ব্যাংক খাতের নানা সমস্যা সমাধানে গত মাসে একটি পথনকশা অনুমোদন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে ব্যাংক একীভূত করার বিষয়টি ছিল। দুর্বল ব্যাংক একীভূত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক উদ্যোগের পর দুটি ব্যাংকের একীভূত হওয়ার এটিই প্রথম সিদ্ধান্ত। একীভূত হওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গতকাল পরিচালনা পর্ষদের সভা করে ব্যাংক দুটি। এই দুটি সভাতেই একীভূত হওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক দুটি।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কে কার সঙ্গে একীভূত হচ্ছে এটা গুরুত্বপূর্ণ। একীভূত বা অধিগ্রহণ পেশাদারির সঙ্গে হচ্ছে কি না, সেটাও দেখতে হবে। দুর্বল ব্যাংকটির খারাপ সম্পদ ও আর্থিক মূল্যায়নও করতে হবে ভালোভাবে। এ ছাড়া এক ব্যাংকের সঙ্গে অন্য ব্যাংককে একীভূত করলে কোনো ফল পাওয়া যাবে না।

দুর্বল ব্যাংক হিসেবে একীভূত হতে যাওয়া পদ্মা ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয় ২০১৩ সালে। তখন ব্যাংকটির নাম ছিল ফারমার্স ব্যাংক। ২০১৯ সালে নাম বদলে পদ্মা ব্যাংক করা হয়।

৪ মার্চ গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক শেষে ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেছিলেন, দেশের ৯০ শতাংশ ব্যাংক ভালো। অর্থনীতির স্বার্থে ১০ শতাংশ ব্যাংকের একীভূতকরণ প্রক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।

এ অবস্থায় গতকাল নজরুল ইসলাম মজুমদারের মালিকানাধীন এক্সিম ব্যাংক সিদ্ধান্ত নেয় পদ্মা ব্যাংককে একীভূত করার।

একীভূত করার উদ্যোগ যেভাবে

২০২২ সালের জুলাইয়ে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগ দিয়ে ১০ দুর্বল ব্যাংকে পৃথক তদারকি শুরু করেন। এতে কোনো সুফল না পেয়ে গত বছরের ডিসেম্বরে ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ)’ শীর্ষক একটি নীতিমালা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে বিভিন্ন সূচকের ওপর ভিত্তি করে ব্যাংকগুলোকে চার ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত হয়। নীতিমালা অনুযায়ী, দুর্বল  বিতরণ, নতুন শাখা খোলা, আমানত ও ঋণ বিতরণ বন্ধ এবং একীভূত করার সিদ্ধান্ত দিতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২৪ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০২৫ সালের মার্চে এটি কার্যকরের কথা বলা হয়।

এর মধ্যে গত ৩১ জানুয়ারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে এক আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়। এ জন্য ভালো ও দুর্বল ব্যাংকের এমডিদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরুরও পরামর্শ দেন গভর্নর।

একই ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয় ৪ মার্চ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকেও। ওই বৈঠকে গভর্নর জানান, চলতি বছরের মধ্যে ৭ থেকে ১০টি দুর্বল ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হতে পারে।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা যায়, সরকারের উচ্চপর্যায়ের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকেও এক্সিম ব্যাংককে পদ্মা ব্যাংকের দায়িত্ব নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। দুই ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের যৌথ ব্যবসা থাকায় প্রথম এই ব্যাংক দুটিকে একীভূত করার জন্য বেছে নেওয়া হয়। এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বর্তমানে ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির চেয়ারম্যান। তাই তিনিও এ প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেন। তবে ব্যাংক দুটি একীভূত হবে নাকি একে অপরকে অধিগ্রহণ করবে, সেই সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।

এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কীভাবে এ একীভূত কার্যক্রম সম্পন্ন হবে, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা ও পরামর্শক্রমে দুই ব্যাংকের আইনজীবী মিলে ঠিক করবেন। এ নিয়ে আগামী সোমবার একটি সমঝোতা চুক্তি হবে।’

পদ্মা ব্যাংক কেন প্রথম তালিকায়

২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়া ৯ ব্যাংকের একটি পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স)। অনিয়মের কারণে আর্থিক পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ায় ২০১৭ সালে পদ ছাড়তে বাধ্য হন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। তখন এই ব্যাংককে বাঁচাতে মূলধন সহায়তা দেয় সরকারি চার ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ সংস্থা আইসিবি। সেই সুবাদে ব্যাংকটির পরিচালনায় যুক্ত হন ওই চার ব্যাংক ও আইসিবির প্রতিনিধিরা। তখন নতুন করে পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত।

ফারমার্স ব্যাংকে অনিয়মের পর দেশ ছাড়েন মহীউদ্দীন খান আলমগীর, আর জেলে রয়েছেন ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী ও তাঁর ছেলে রাশেদুল হক চিশতী।

নাম পরিবর্তন করে পদ্মা ব্যাংক হওয়ার পর ব্যাংকটিকে নানা ধরনের ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব ছাড়ের কারণে প্রকৃত ব্যাংকের চরিত্র হারায় ব্যাংকটি। ব্যাংকটির প্রকৃত আর্থিক চিত্র গোপন করে আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখানোর সুযোগও করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ব্যাংকটির ওপর গ্রাহকের অনাস্থা বেড়ে যায়। ব্যাংকটি লোকসান থেকেও বের হতে পারেনি। দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকটি তাদের বড় আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না। তাই একপর্যায়ে এসব আমানতের বিপরীতে শেয়ার বরাদ্দের উদ্যোগও নেওয়া হয়। কিন্তু তাতে রাজি হয়নি ব্যাংকটিতে মূলধন জোগান দেওয়া সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে একীভূত হওয়া ছাড়া ব্যাংকটির সামনে অন্য কোনো বিকল্প আর ছিল না।

সর্বশেষ গত মাসের শুরুতে পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম ব্যাংকটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন।

বর্তমানে পদ্মা ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ। ২০২৩ সাল শেষে পদ্মা ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আমানতই ২ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। যে টাকা ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকটি।

এক্সিম ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, পদ্মা ব্যাংকের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ, যা কিনে নেবে একটি সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি। ফলে যে কারণে ব্যাংকটির সম্পদ (ঋণ ও বিনিয়োগ) খারাপ হয়ে পড়েছে, তা আর থাকবে না। এরপর ভালো সম্পদগুলো নিয়ে ব্যাংকটির কার্যক্রম নতুন করে শুরু করবে এক্সিম ব্যাংক। তাই দুর্বল পদ্মা ব্যাংককে একীভূত করলেও তাতে এক্সিম ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ার শঙ্কা কম।

পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক রিয়াজ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পর্ষদ এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা ও পরামর্শ মেনে ঠিক হবে পরবর্তী সময়ে কী হবে।’

Prothom alo

Exit mobile version