Site icon The Bangladesh Chronicle

দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের ফ্ল্যাট-বাড়ি: শান্ত থাকুন এবং আতঙ্কিত হোন!

দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের ফ্ল্যাট-বাড়ি: শান্ত থাকুন এবং আতঙ্কিত হোন!

হাসান ইমাম

২০২২ সালে দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের খাবার কেনার খরচ ছিল মাসে মাথাপিছু ১ হাজার ৮৫১ টাকা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৯২৩ টাকা। অর্থাৎ দুই বছর আগের তুলনায় খাবারের পেছনে ব্যয় বেড়েছে ১ হাজার ৭২ টাকা, শতাংশের হিসাবে যা ৫৮। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) এ তথ্য ১৭ মে প্রধান খবর হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে প্রথম আলোয়।

একই দিন পত্রিকাটির ৯ পৃষ্ঠায় ‘দুবাইয়ে ৫৩২ বাংলাদেশির ফ্ল্যাট-বাড়ি’ শিরোনামে আরেকটি খবর ছাপা হয়েছে। খবর দুটির মধ্যে বাহ্যত মিল নেই বটে, আবার অমিল আছে, তা বলারও জো নেই। অনেকটা তেল ও জলের মতো—দুটিই তরল, কিন্তু একসঙ্গে মেশে না।

যাঁর টাকা আছে, তিনি তা ইচ্ছেমতো খরচ করার অধিকার রাখেন বটে। কিন্তু কথা হলো, টাকার উৎস বা আয়ের পন্থা যেমন বৈধ হওয়া চাই, তেমনি ব্যয়ের তরিকায়ও থাকতে হবে স্বচ্ছতা। ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরির তথ্য বলছে, বিশ্বব্যাপী করস্বর্গ বা কর ফাঁকির অভয়ারণ্যগুলোয় বাংলাদেশিদের ৫ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ রয়েছে। এটি বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ১ দশমিক ৩ শতাংশ। বাংলাদেশিদের এই বিপুল পরিমাণ অর্থের ৫ বিলিয়নই রয়েছে এশিয়ায় (হংকং, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত), বাকিটা ইউরোপ-আমেরিকায়।

ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুবাই শহরে আবাসন সম্পদ কিনেছেন, এমন বাংলাদেশির সংখ্যা ২০২২ সালে ছিল ৩৯৪ জন। ওই বছর তাঁরা মোট ২২ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের সম্পদ কিনেছেন। ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি ধারণা, সংখ্যাটি বেড়ে ৫৩২ জন হতে পারে। সংখ্যা যা-ই হোক, তাঁরা যে বৈধভাবে দেশ থেকে টাকা নিয়ে যাননি, তা অজানা নয় কারও—না সরকারের, না জনগণের। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা আর বাঁধা হয় না।

১৬ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের লেখা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় আগামীর করণীয় শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। সেই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ঋণখেলাপি ও মুদ্রা পাচারকারীরা একসূত্রে গাঁথা। আর সেখানে অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ তাঁর বক্তব্যে বলেন, তিনি মনে করেন, দেশে ‘গণতন্ত্রের আনুষ্ঠানিকতা’ চলছে। এ দুই বিশিষ্ট ব্যক্তির কথায় বোঝা যায়, ‘অনুকূল’ পরিবেশ পাচ্ছে আগাছা বাড়বৃদ্ধির, তাই বুঝি কাঙ্ক্ষিত ফলন হচ্ছে না।

গত বছর দুবাই চেম্বার অব কমার্সের এক হিসাবে বলা হয়েছিল, ওই বছরের প্রথমার্ধে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সদস্যপদ নেওয়ার হার বেড়েছিল ৪৭ শতাংশ। এতে দুবাই চেম্বারের সদস্যপদ পাওয়া বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন কোম্পানির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৯৭৫। না বললেও চলে, তবু বলার জন্যই বলা যে বৈধভাবে বিনিয়োগের অনুমতি নিয়ে কেউই এসব ব্যবসা-বাণিজ্য করছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে তা পরিষ্কার; মাত্র ১৭টি প্রতিষ্ঠান সরকারের অনুমোদন নিয়ে বিদেশে কার্যালয় কিংবা কারখানা স্থাপন করেছে।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তথ্যে প্রায় প্রতিনিয়তই বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের কথা উঠে আসছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) হিসাবে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। আর সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। যদিও পাচার করা অর্থের পরিমাণ আরও অনেক বেশি হবে বলে অনেকেই মনে করেন।

আর খেলাপি ঋণের গ্রাফ তো বরাবরই ঊর্ধ্বমুখী। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বরের শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৯ শতাংশ। বিভিন্ন দেশে এত এত ‘বেগমপাড়া’ গড়ে ওঠার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায় বৈকি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খাদ্যনিরাপত্তা পরিসংখ্যান-২০২৩ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা মেটাতে দেশের এক-চতুর্থাংশ পরিবার ঋণ করে।

খাদ্যের পেছনেই যদি ব্যয় বাড়ে ৫৮ শতাংশ, তাহলে অন্যের কাছ থেকে ধারকর্জ না করে উপায়ই–বা কী! পেটে টান পড়লেও সাধারণ মানুষ ‘চুরির’ কথা ভাবতেও পারেন না। চুরি বরং তাঁরাই করেন, যাঁদের থালা উপচে পড়ছে। পাশেই অন্যদের পাত ফাঁকা, তখন নিজেদের বাড়তি খাবার আড়াল করতে নানা ফন্দিফিকির করেন তাঁরা।

আলোচিত দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী স্লাভয় জিজেকের প্যানডেমিক: কোভিড-১৯ শেকস দ্য ওয়ার্ল্ড নামে একটি বই আছে। বিষয়বস্তু করোনা অতিমারির সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি। বইটির একটি চ্যাপ্টারের শিরোনাম ‘কাম ডাউন অ্যান্ড প্যানিক!’ অর্থ পাচারের ‘অতিমারির সময়ে’ জিজেকের পর্যবেক্ষণ যেন সমান প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে—সব দেখে-শুনে ‘শান্ত থাকুন এবং আতঙ্কিত হোন!’ আচ্ছা, বিপরীতমুখী এ অবস্থা কি ‘পাথর হয়ে যাওয়া’?

prothom alo

Exit mobile version