কাকন রেজা
বাংলাদেশের নগদ ও চীনের টেক জায়ান্ট হুয়াওয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। বলা হচ্ছে, স্মার্ট বাংলাদেশে গড়ার লক্ষ্যে এই সমঝোতা, যা বাংলাদেশে ডিজিটাল আর্থিক প্লাটফর্ম তৈরিতে সহায়তা করবে। আর এই লক্ষ্যেই বিনিয়োগ করবে হুয়াওয়ে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক চীন সফরকারীন সময়ে এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
এছাড়া পুঁজিবাজারে ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ডেক্স বাংলাদেশের সাথে হুয়াওয়ের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। ইন্টারেস্টিং, হুয়াওয়ে ঢুকছে বাংলাদেশে। টাকার অঙ্কে বিনিয়োগ হয়তো খুব বেশি নয়, দুইয়ে মিলে সম্ভবত সাত কোটি ডলার। কিন্তু সুচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোনোর প্রবাদটা তো আমাদের দেশেরই।
হুয়াওয়ে নিয়ে বলি, গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ২০১৯ সালে হুয়াওয়ের স্মার্টফোনসহ যাবতীয় পণ্য নিষিদ্ধ করেছিল যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, নিউজিল্যান্ড ও তাইওয়ান। একই সাথে যুক্তরাজ্য তার দেশের ফাইভ-জি প্রযুক্তিতে হুয়াওয়ে উপস্থিতিও নিষিদ্ধ করে। ২০১৯ এর এনডিএএ আইনে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার হুয়াওয়েকে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। জার্মান এবং ফ্রান্সও প্রযুক্তি চুরির অভিযোগে হুয়াওয়ের স্মার্টফোন নিষিদ্ধ করেছে ২০২২ সালে। গুগলও সম্পর্ক ছিন্ন করেছে হুয়াওয়ের সাথে। ফলে হুয়াওয়ের ফোনে সরাসরি গুগল এর অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। আর এসবই হয়েছে হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগের কারণে।
সেই হুয়াওয়ে বাংলাদেশের প্রযুক্তির সাথে কাজ করলে কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে হুয়াওয়ে নিষিদ্ধের কারণ হলো চীনের পক্ষে গুপ্তচর বৃত্তি করা। আর এখন যদি বাংলাদেশের সাথে হুয়াওয়ে কাজ করে। অর্থাৎ বাংলাদেশে হুয়াওয়ের অবাধ প্রবেশাধিকার পায় এবং গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে সে অভিযোগের ধারণা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হবে মূলত ভারত।
কারণ প্রতিযোগিতাটা চীনের বাংলাদেশের সাথে নয়, ভারতের সাথে। সুতরাং এই চুক্তি নিয়ে ভারতের অস্বস্তি থাকাটা স্বাভাবিক। অথচ বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সাথে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক ভারতের। কারণ সরকারের দায়িত্বশীলরা এবারের নির্বাচন করতে ভারত সহায়তা করেছে এমন কথা প্রকাশ্যেই বলেছেন। আর সে নির্বাচনে ক্ষমতায় এসেছে বর্তমান শাসকদল। ভারত সহযোগিতা না করলে হয়তো দৃশ্যচিত্র অন্যরকম হতো।
এদিকে আবার ভারতের ট্রেন চলবে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে। বাংলাদেশ রেল করিডর দিচ্ছে ভারতকে। দেশের ভেতর হাজার সমালোচনা রয়েছে ভারতকে ট্রেন করিডর দেওয়ার ব্যাপারে। সরকার যদিও বলছে, ট্রানজিট, কিন্তু সংজ্ঞানুযায়ী তা করিডরই। কারণ ভারতের ট্রেন বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে আবার ভারতেই যাবে। সুতরাং এটা স্রেফ করিডর।
ট্রানজিট হতো ট্রেন চলাচলে অন্যান্য দেশ সংযুক্ত হলে এবং এই সংযুক্ত হওয়ার ব্যাপারটি শুধু ভারতীয় ট্রেনের ক্ষেত্রেই নয়। একদিকে সশরীরে ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ছে ভারত। অন্যদিকে চীন ঢুকে পড়ছে প্রযুক্তিতে। তাও আবার তথ্যপ্রযুক্তিতে। যা সশরীরের অবস্থানের চেয়েও বেশি কিছু।
সুতরাং এই দুই পরাশক্তির লড়াইয়ের সম্ভাব্য ক্ষেত্র হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের যে ভৌগোলিক অবস্থান তা অন্তত গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বের প্রধানতম শক্তিগুলোর কাছে। এশিয়ার দুই পরাশক্তি ভারত ও চায়নাকে নিয়ন্ত্রণ করার চাবিটাই বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানে। কাজেই এ নিয়ে ভারত ও চায়নার মধ্যে যেমন প্রতিযোগিতা থাকবে। তেমনি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াও পিছিয়ে থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্রকে চায়না তো বটেই ভারতকে নিয়ন্ত্রণের জন্যও বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক রাখতে হবে।
অনেক বলবেন, ভারত তো যুক্তরাষ্ট্রের আস্থায় রয়েছে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার কী প্রয়োজন। ভূরাজনীতিতে আস্থা বলতে কিছু নেই। লেন্দুপ দর্জি টাইপ শাসক ছাড়া নিজের হাতের ক্ষমতা কেউ অন্যকে দিতে চাইবে না। ভারত দক্ষিণ এশিয়ার দায়িত্ব ঠিকমতো সামলাতে পারেনি, সেটা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মাঝখান থেকে তাদের আধিপত্য দক্ষিণ এশিয়া থেকে একরকম নাই হয়ে গিয়েছে বলা যায়। অতএব সমীকরণটা খুব সহজ নয়।
কিন্তু বাংলাদেশকে ঘিরে ভারত ও চায়না এই দুই পরাশক্তির যে অদৃশ্য লড়াইটা শুরু হয়েছে তা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে তাই দেখার বিষয় এবং সাথে আমাদের জন্য চিন্তার বিষয় তো অবশ্যই। সেই চিন্তার সময়টাও প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। চীনের টাকায় শ্রীলঙ্কার কী হয়েছে আমরা দেখেছি। আবার ভারতের আনুকূল্যে নিজেদের সর্বনাশও প্রত্যক্ষ করেছি অনেকক্ষেত্রে। সুতরাং সময় শেষ হওয়ার আগেই সাধন না করতে পারলে ভবিষ্যতে বিপদ নিশ্চিত।
Bangla Outlook