amardesh.co.uk 2 November 2020
দিল্লীপন্থী বাম চরিত্রগতভাবেই আওয়ামী পদলেহী
মাহমুদুর রহমান
গত শতাব্দীর গল্প। ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসের তিন তারিখের সন্ধ্যা। সবে বুয়েটে ভর্তি হয়েছি। তিনটা দিন প্রথম বর্ষের ক্লাস করে মহা ফুর্তিতে ঢাকা স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা দেখতে গিয়েছিলাম। আমি শের-এ-বাংলা হলের উত্তর ব্লকে ৩৭০ নম্বর রুমে থাকতাম। এই শের-এ-বাংলা হলের উত্তর ব্লকেই গত বছর শেখ হাসিনার গুণ্ডাবাহিনীর ছাত্ররূপী পিশাচেরা ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষার্থে, ভারত এবং হাসিনার কাছে খুবই যৌক্তিক দাবী জানিয়ে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার অপরাধে, আবরার নামের একজন দেশপ্রেমিক মেধাবী তরুণকে কয়েক ঘণ্টা ধরে পিটিয়ে নির্মমভাবে খুন করেছে। মহান আল্লাহ তা’য়ালার কাছে আবরারের জন্য উত্তম পুরস্কারের প্রার্থনা জানিয়ে সাতচল্লিশ বছর আগের গল্পে ফিরছি।
জানুয়ারি মাসের হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় স্টেডিয়াম থেকে হেঁটেই হলে ফিরছিলাম। তোপখানা রোডে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আসতেই দেখলাম আতঙ্কগ্রস্ত মানুষজনরা ছোটাছুটি করছেন। প্রেস ক্লাবের উল্টো দিকে তখন মস্কোপন্থী ন্যাপ যাকে অনেকেই মোজাফফরপন্থী ন্যাপ নামেও ডেকে থাকেন তারই প্রধান কার্যালয় ছিল। প্রেস ক্লাবের সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম মাথায় লাল কাপড় বাঁধা শ খানেক গুণ্ডা শ্রেণির লোক জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে ন্যাপ অফিস আক্রমণ করছে। আধঘণ্টা খানেক ভাংচুর চালিয়ে তারা কাঠের আসবাব, অফিসের কাগজপত্র, বই, ইত্যাদিতে আগুন লাগিয়ে দিল। ন্যাপের কর্মী যে দু-চারজন সেখানে ছিল তাদেরকে হাটুরে মার লাগালো। কিল, ঘুষি, লাথি কোনটাই বাদ গেল না। এমন সময় কৃষ্ণবর্ণ [আমারই মত], মোটাসোটা এক মহিলা রাস্তার ওপার থেকে দৌড়ে প্রেস ক্লাবের দিকে ছুটে এলেন। তাকে তখন জনা দশেক মাথায় লাল কাপড় বাঁধা লোক তাড়া করছে আর তিনিও প্রাণভয়ে ছুটছেন। লোকগুলোকে নেশাগ্রস্ত মনে হচ্ছিলো। মহিলা সেদিন প্রেস ক্লাবে ঢুকতে পেরে সম্ভবত আরও বড় অসম্মান থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। পলায়নপর, বেপথু মহিলাকে চিনতে না পেরে আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম তার নাম ছিল মতিয়া চৌধুরী।
জি, ঠিকই ধরেছেন। তখনকার ডাকসাইটে মস্কোপন্থী বাম-নেত্রী এবং আজকের আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, বিরোধী দল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি সংসদে অবিরাম অশ্রাব্য গালিগালাজের সাথে থুতু বর্ষণকারী এবং শেখ হাসিনার বিশেষ নির্লজ্জ চাটুকার মতিয়া চৌধুরী একই ব্যক্তি। এককালের অগ্নিকন্যার নাম পালটে দুর্গন্ধময় থুতু বুড়ি দিলে মন্দ হয়না। আরও একটি তথ্য পাঠকের জানা আবশ্যক। ১৯৭৩ সালের সেই শীতের সন্ধ্যায় তাকে যারা চড়-থাপ্পড় লাগানোর পর আরও কিছু করবার অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তাড়া করছিলো তারাও আওয়ামী লীগেরই নেতাকর্মী ছিল।
ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল তিন দিন আগে। ভিয়েতনাম দিবস উপলক্ষে ১ জানুয়ারি বাম সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে ঢাকায় মার্কিনবিরোধী মিছিল বের হলে শেখ মুজিবের পুলিশ গুলি চালায়। প্রেস ক্লাবের কাছেই পুলিশের গুলিতে মতিউল এবং কাদের নামের ছাত্র ইউনিয়নের দুই কর্মী নিহত হয়। তোপখানা রোডের ঠিক মোড়ে তখন ইউএসআইএস [USIS] নামে মার্কিন সরকারের একটি অফিস ছিল। বিক্ষোভকারীরা ঐ অফিস অভিমুখে মিছিল নিয়ে আসার চেষ্টা করলে গোলাগুলির ঘটনাটি ঘটে। সেই সময় ডাকসুর ভিপি ছিলেন আর এক ডাকসাইটে বাম নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। এখন টেলিভিশনে তাকে প্রায়ই আওয়ামী লীগের কোলে ঝোল টেনে, মিন মিন করে, অবজ্ঞাসূচক পিচ্ছিল হাসি সহকারে নীতিবাক্য আওড়াতে দেখা যায়। বাম ঘরানার প্রথম আলো, ডেইলি স্টারে এ সমস্ত বাতিল রাজনীতিকদের মুখনিঃসৃত বেদবাক্য সোনার হরফে লেখা হয়ে থাকে। মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান আবার এগুলো বেশ গেলে। পুলিশের গুলিতে মানুষ খুনের [সকল আওয়ামী আমলেই এহেন হত্যাকাণ্ড ঘটে] প্রতিবাদে পরের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের এক বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সমাবেশে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবকে কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হন নাই, তিনি তুমুল করতালির মধ্যে বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে শেখ মুজিবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজীবন সদস্যপদের কাগজটিও সবার সামনে ছিঁড়ে ফেলেন। ডাকসুর পক্ষ থেকে সাত দফা দাবী উত্থাপিত হলে সিপিবি এবং ন্যাপ মোজাফফর সেগুলোকে ন্যায্য আখ্যা দিয়ে শেখ মুজিব সরকারকে মেনে নেয়ার আহ্বান জানায়। দাবীগুলোর মধ্যে প্রকারান্তরে মুজিব সরকারের পদত্যাগও ছিল। তিন তারিখে ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানের অপর এক প্রতিবাদ সভায় মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম আবারও বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রত্যাহার সংক্রান্ত বিপ্লবী বক্তব্য প্রদান করেন। আর যায় কোথায়? স্পর্ধারও একটা সীমা থাকা দরকার।
বাম ঘরানার পল্টন ময়দানের জনসভা শেষ না হতেই শুরু হয় আওয়ামী লীগের পাল্টা অ্যাকশন। আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি আসলে আগেই নেয়া ছিল। লাল বাহিনী নামে আওয়ামী শ্রমিকদের সমন্বয়ে এক লাঠিয়াল ঘাতক বাহিনী তৈরি করেছিলেন বর্তমান ফ্যাসিস্ট শাসক শেখ হাসিনার পিতা একনায়ক শেখ মুজিবুর রহমান। লাল বাহিনীর প্রধান, ছোটখাটো আকৃতির, টেকো মাথার মান্নানের ভয়ে সারা বাংলাদেশ তখন সন্ত্রস্ত থাকত। লুটপাট, ধর্ষণসহ হেন অপকর্ম নেই যেটা করার লাইসেন্স শেখ মুজিব তাকে দেন নাই। শেখ হাসিনার বর্তমান ছাত্রলীগের মত আর কি। বামদের শায়েস্তা করতে শেখ মুজিব লাল বাহিনীকেই স্ট্রাইক ফোর্স হিসেবে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাথে সেদিন মাঠে নামিয়েছিলেন। মান্নান তার দলবল নিয়ে ৩ জানুয়ারি ঢাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। মান্নানের সাথে গুণ্ডামিতে যোগ দিয়েছিলেন তৎকালীন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক এবং ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট শেখ শহীদ। ঐ দিন মুজাহিদুল ইসলামের গুরু মনি সিংয়ের সিপিবি এবং ন্যাপ মোজাফফর অফিস তাদের নেতৃত্বেই আক্রমণ করা হয়েছিলো। প্রেস ক্লাবের নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আমিও আওয়ামী শ্রমিক নেতা মান্নানের লম্ফঝম্প দেখেছিলাম। মতিয়া চৌধুরী একটুর জন্য সেই মান্নানের খপ্পর থেকেই সেদিন বেঁচে গেছিলেন। ওদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের হুঙ্কারও চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই বিড়ালের মিউ মিউতে নেমে এসেছিল। বেচারা মাপটাপ চেয়ে, হাতপা ধরে, নাকে খত দিয়ে সে যাত্রা রক্ষা পেয়েছিলেন। আগেই বলেছি সেলিমের মিউ মিউ আজও চলছে।
উপরের ঘটনার দুই বছরের মাথায় শেখ মুজিব দিল্লীপন্থী বাম নেতৃদ্বয়, মনি সিং এবং মোজাফফর আহমেদকে সাথে নিয়েই একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন। সেই বাকশালে সিপিবি এবং মস্কোপন্থী ন্যাপের সকল নেতাকর্মী যোগদান করেন। আওয়ামী লীগের গুণ্ডাদের হাতে লাঞ্ছনার কথা ভুলে গিয়ে লজ্জাগ্রন্থিহীন মতিয়া চৌধুরী এবং সেলিমও একই পথের পথিক হয়েছিলেন। তারা সবাই একদলীয় বাকশালের নেতা হলেন। বাকশালের একটি ছাত্র সংগঠন হলো যার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন শেখ মুজিবের ভাগ্নে শেখ শহীদ। অবশ্য পেছন থেকে সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠনটি মুজিবপুত্র শেখ কামালই মূলত চালাতেন। প্রখ্যাত ব্যাংক ডাকাত শেখ কামালের সুযোগ্য ভাগ্নে ডিগ্রি ছাড়া ‘কম্পিউটার বিজ্ঞানী’ সজীব জয় মামার মতই বাংলাদেশ ব্যাংকে চমৎকার হাতসাফাই দেখিয়েছেন। পার্থক্য হলো, শেখ কামালের পুরানা মডেলের জিপ, পিস্তল-বন্দুকের পরিবর্তে এখন ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্ট্রং রুম আর আগের মত ভাঙতে হচ্ছে না। এখন ল্যাপটপের বাটন টিপলেই মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার-পাউন্ড আমেরিকা ঘুরে ফিলিপাইনের ক্যাসিনোতে চলে যাচ্ছে। আরে ভাই, হাসিনাপুত্র জয়ের নেতৃত্বে ডিজিটাল বাংলাদেশ কায়েম হয়েছে না! যাই হোক, বাকশাল সরকার পতনের পর প্রেসিডেন্ট জিয়া বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলে আওয়ামী লীগের সাথে গাঁটছড়া বাঁধা মস্কোপন্থী বাম দলগুলো আবারও পুরনো নামে রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছিল। অবশ্য ভিন্ন নামে দল চালালেও এই গোষ্ঠী সর্বদা আওয়ামী লীগেরই লেজুড়বৃত্তি করে গেছেন।
পাঠকমনে প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন এই সমস্ত তথাকথিত বামদের এত আওয়ামী প্রীতি? এর দুটি কারণ রয়েছে। ইসলামবিদ্বেষ এবং হিন্দুত্ববাদী ভারতের প্রতি আনুগত্যের মিশেলেই একই মনিবের ভৃত্য আওয়ামী লীগের সাথে এদের এই মধুর সখ্য গড়ে উঠেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, শহুরে, শিক্ষিত এবং মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে অদ্যাবধি আত্মপরিচয়ের বিষম সঙ্কট রয়েছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বাংলার উনিশ শতকের হিন্দু রেনেসাঁ দ্বারা এদের মগজ ধোলাই হয়েছে। সেই রেনেসাঁটির মূলমন্ত্রই ছিল তীব্র মুসলমান বিদ্বেষের ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে বাঙালি-হিন্দু জাগরণ। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথসহ যে বাঙালি হিন্দু গোষ্ঠী সেই রেনেসাঁয় বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা মুসলমানদের হয় ঘৃণা করতেন [বঙ্কিমচন্দ্র] অথবা চাষাভূষা জ্ঞানে অবজ্ঞা করতেন [রবীন্দ্রনাথ]। আত্মপরিচয় নিয়ে বিভ্রান্ত, বাংলায় মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, হীনম্মন্যতায় আক্রান্ত শহুরে, মধ্যবিত্ত মুসলমানের এই শ্রেণিটি সর্বদা হিন্দুদের তোষামোদি করেই জাতে উঠতে চেয়েছেন। এরা দাদা ডেকে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। একজন স্বল্প শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে, এদের একটু নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর ‘দি অটোবায়োগ্রাফি: অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’ বইটি পড়ার বিনীত অনুরোধ জানাই। তিনি পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন এবং বিশ্বখ্যাত অক্সফোর্ডের অধ্যাপক ছিলেন। তাকে রাজাকার এবং পাকিস্তানের দালাল বলার বোধহয় কোন সুযোগ নাই।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে ভারতের মুসলমানদের জন্য স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও বিস্ময়করভাবে উপরোক্ত শ্রেণির আত্মপরিচয়ের সেই সংকট দূর হয়নি। বরঞ্চ, এদের চরিত্রগত পাকিস্তানবিদ্বেষ কালক্রমে গভীর ইসলামবিদ্বেষে রূপান্তরিত হয়েছে। কোলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু সংস্কৃতির প্রতি তারা আজীবন মোহাচ্ছন্ন থেকেছে। মানসিক অসুখতুল্য হীনম্মন্যতা এক সময় মুসলমান বামপন্থীদেরকে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনির নায়ক রামভক্ত হনুমানে পরিণত করেছে। দীর্ঘ ও মোটাসোটা লেজটারই যা কিছু অভাব রয়েছে আর কি। উপমহাদেশ বিভাগোত্তর পূর্ব পাকিস্তানে বাম রাজনীতির উত্থান প্রধানত বাঙালি হিন্দু এবং এই হীনমন্য, ইসলামোফোবিক ও লেজবিহীন রামভক্ত হনুমান বাঙালি মুসলমানদের নেতৃত্বেই ঘটেছে। এদের সেক্যুলারিজমের যত কচকচানি সব ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে। হিন্দুত্ববাদ তাদের জন্য কোন সমস্যার সৃষ্টি করে না। এই কারণেই আফগানিস্তানে ইসলামপন্থী এবং সেদেশে বিপুল জনপ্রিয় তালেবান রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে এই বামদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। অথচ, গুজরাটের কসাই নরেন্দ্র মোদী চাইলে এখনই এদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাধারী অধিকাংশ আরবি নামীয় সব রামভক্ত হনুমানকুল পরম ভক্তি সহকারে গোমূত্রের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে ধন্য হওয়ার জন্য সারি বেধে বসে পড়বেন। পাঠক ব্যতিক্রমী সর্বজন শ্রদ্ধেয় মৌলানা ভাসানীর নাম উল্লেখ করে আমার সাথে খামোখা তর্ক জুড়ে দিতে পারেন। তবে আমার মত দীনহীন, অর্ধশিক্ষিত ব্যক্তির বিবেচনায় বাংলাদেশের বাম রাজনীতিতে তিনি এক নিঃসঙ্গ পথিক ছিলেন, যে কারণে তার দলে বার বার ভাঙ্গন আসা ছাড়াও শেষ বয়সে মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদের পরিবর্তে মৌলানা ভাসানী ইসলামী রবুবিয়াতের কথাই বেশী বলেছেন।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১, পাকিস্তানী আমলের চব্বিশ বছর ইসলামোফোবিক বামরা ওপার বাংলার স্বপ্ন বুকে নিয়ে পাকিস্তানকে ঘৃণা করেই কাটিয়েছেন। ইন্ডিয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায় বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এরা ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে শেখ মুজিব জাতীয় সরকারের পরিবর্তে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তারা প্রচণ্ড হতাশ হন। ১৯৭৩ সালের যে ঘটনার গল্প বলে আজকের সম্পাদকীয়টি শুরু করেছিলাম সেই সব ঘটনা বামদের সার্বিক হতাশারই প্রতিফলন ছিল। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে উল্লেখ করা আবশ্যিক। আর কোন ইতিবাচক পরিবর্তন না হোক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে বামদের কোলকাতা নিয়ে রোমান্টিকতার অবসান ঘটেছিল। ভারতে বাঙালি হিন্দুদের দুরবস্থা স্বচক্ষে দেখে তবেই তাদের মোহভঙ্গ হয়েছিলো। পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামোফোবিক বামদের আদর্শের বাঙালি হিন্দু দেবতার রঙ মুছে গিয়ে, মাটি গলে গিয়ে, ততদিনে ভিতরের ভাঙ্গাচোরা কাঠ আর পচে যাওয়া বাঁশের কাঠামো বেরিয়ে পড়েছে। পশ্চিম বঙ্গের বাঙালি হিন্দুরা অবাঙালিদের সেবা দিয়ে ধন্য হচ্ছেন। মাড়োয়ারি হিন্দুদের দোকানে সেলসম্যানের উপরে পশ্চিম বঙ্গের বাঙালি হিন্দুরা আর উঠতে পারেননি। জ্যোতি বসুর মত লোক গোনার বাইরেই ছিল। বাংলাদেশী বামদের নতুন দেবতার সন্ধান পেতে অবশ্য বিলম্ব হয়নি। মূর্তিমতী দেবী ইন্দিরা গান্ধী তখন দিল্লীর সিংহাসন আলো করে বসে আছেন। তাকেই বাংলাদেশের রামভক্ত বামরা দেবী দুর্গার আসনে বসিয়ে দিলেন। সেই থেকে বাংলাদেশের এই শ্রেণির বামদের কেবলা কোলকাতা থেকে পশ্চিমে দিল্লীতে স্থানান্তরিত হলো।
কিন্তু, গোল বাধল অন্যত্র। ভক্ত দেবীকে মানলে কি হবে, দেবী তো শেখ মুজিবকেই বাংলাদেশে তার প্রধান ভক্তের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন। অতএব, ঢাকায় ক্ষমতার স্বাদ পেতে হলে মুজিবকেই দেবতা জ্ঞানে পূজা করতে হবে, তার মাধ্যমেই মোক্ষলাভ ঘটবে। এই বিবেচনা থেকেই মনি-মোজাফফর এক হয়ে শেখ মুজিবকে দিয়ে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করিয়ে তবেই ১৯৭৫ সালে কয়েক মাসের জন্য হলেও ক্ষমতার ক্ষীর লেহন করতে পেরেছিলেন। প্রায় অর্ধশতাব্দী কাল ধরে বংশ পরম্পরায় ঢাকায় শেখ পরিবারকেই দিল্লী প্রধান পূজারীর পদটি দিয়ে রেখেছে। কথিত জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি অনেক কাঠখড় পুড়িয়েও পূজারীর সহকারী হওয়া তো দুরের কথা, গত দশ বছরে মন্দিরের চৌকাঠ পর্যন্তও তো যেতে পারেনি। অতএব, দিল্লীপন্থী বামদেরও দিল্লীর দেবতার আদেশে প্রধান পূজারীর পদযুগলেই যাবতীয় অর্ঘ্য নিবেদন করে যেতে হচ্ছে। এতে তাদের বিশেষ আপত্তিও নেই। পিতার পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পারলে কন্যা দোষ করলো কি? গত পঞ্চাশ বছরে দিল্লীর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে বাংলাদেশে ইসলামোফোবিয়া আরও প্রকট রূপ ধারণ করেছে। লক্ষ্য করবার বিষয় হলো যে, সেই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে এদেশের মিডিয়া ও সংস্কৃতি অঙ্গনের যে সকল ব্যক্তি মীর জাফরের ভূমিকা পালন করছেন তাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অভিন্ন দিল্লীপন্থী বামদের কারখানাতেই একসময় জন্মলাভ করেছে।
মাহফুজ আনাম, মতিউর রহমান, শাহরিয়ার কবির, আলী যাকের, রামেন্দু মজুমদার, মালেকা বেগম, আয়েশা খানম, সুলতানা কামাল চক্রবর্তী থেকে শুরু করে হাল আমলের শাহবাগী সম্প্রদায়, সকলেরই জন্ম হয়েছে দিল্লীর উচ্ছিষ্টের পূতিগন্ধময় ডাস্টবিনে। একবিংশ শতকের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইসলাম এবং চীনকে মোকাবেলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইন্দো-যায়োনিস্ট সাম্রাজ্যবাদী অক্ষশক্তি নির্মিত হয়েছে। দেখলেন না, ক’দিন আগেও এক নিম্ন স্তরের [মরহুম আশরাফুল ইসলামের ভাষায় চার আনার] মার্কিন মন্ত্রী সেই ইন্দো-যায়োনিস্ট মোর্চায় যোগদানের জন্য ঢাকায় ফ্যাসিবাদিদের কত খোশামোদ করে গেল। বামরাও রাজনীতিতে নতুনও নন, বোকাও নন। তারা ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের তাৎপর্য ভালোই বুঝেন। ফলে বুদ্ধিমান রামভক্ত বাংলাদেশী বামদের কেবলার সংখ্যাও বেড়ে এখন একের বদলে তিন হয়েছে। দিল্লী, ওয়াশিংটন এবং তেল আবিব [জেরুজালেমকে দখলদার ইসরায়েলের রাজধানীর মর্যাদা দিতে আমি সম্মত নই], তাদের এখনকার তিন তীর্থ। একদা মার্ক্স, লেনিনের নাম মুখস্থ করা গোষ্ঠীটি স্বদেশে শেখ হাসিনার এবং বিদেশে মোদি, ট্রাম্প [সম্ভবত ৩ নভেম্বর পর্যন্ত] আর নেতানিয়াহুর পদতলে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। তাই ইন্দো-যায়োনিস্ট-মার্কিন মদদপুষ্ট ইসলামোফোবিক দেশদ্রোহী দালালশ্রেণির এদেশীয় আখড়া আগুনে পুড়িয়ে ছাই না করে দেয়া পর্যন্ত হিন্দুত্ববাদী অপসংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি নেই। সেই মুক্তি বাংলাদেশের নব্বই শতাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠী চায় কিনা সেটা অবশ্য বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। আর চাইলেও, মুক্তি অর্জনের জন্য আপন রক্ত ঝরাতে আদৌ ইচ্ছুক কিনা; এ নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকেই আমার অন্তত ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। প্রবীণ দেশপ্রেমিক বরেণ্য নাট্যশিল্পী দেশান্তরিত আরিফুল হক হাহাকার করে প্রায় প্রতি সপ্তাহে সেই প্রশ্নেরই জবাব খুঁজছেন আমার দেশের পাতায়।
লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ