Site icon The Bangladesh Chronicle

দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ইসির সংলাপ ব্যর্থ হবে

দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ইসির সংলাপ ব্যর্থ হবে – ফাইল ছবি


নুরুল হুদা কমিশনের মেয়াদ শেষে নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পাওয়ার পর আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে সংলাপ শুরু করেছে। সংলাপে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের মতামতকে নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচন কমিশন কতটুকু গুরুত্ব দেবে তা সময় হলেই বোঝা যাবে। তবে আলোচনার মাধ্যমে কিছু জ্ঞানার্জন করা যায় এতে কোনো সন্দেহ নেই।

গত ১৩ মার্চ প্রথম সংলাপ করেন শিক্ষাবিদদের সাথে, দ্বিতীয় সংলাপ করেন বিশিষ্ট নাগরিকদের সাথে। তৃতীয় দফার সংলাপটি করেন প্রিন্ট মিডিয়ার সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সাথে। প্রথম ও দ্বিতীয় সংলাপে আমন্ত্রিত অতিথিদের ৫০ শতাংশেরও কম উপস্থিত হয়েছেন। এত কম আমন্ত্রিত উপস্থিত হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, সংলাপকে তারা একটা অহেতুক বিষয় হিসেবে মনে করছেন। সংলাপে যা আলোচনা হয় বা যেসব প্রস্তাব সামনে আনা হয় কার্যত নির্বাচনের সময় তার কোনোটাই বাস্তবায়ন করা হয় না। সরকারকে রাজি, খুশি করানোর জন্য যা করার দরকার নির্বাচন কমিশন মূলত সেই কাজটিই করে থাকে, যেটি রকিবউদ্দিন ও নুরুল হুদা কমিশনের বেলায় শতভাগ দেখা গেছে।

ইসির চতুর্থ ধাপের সংলাপ হয় বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রধান নির্বাহীসহ জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সাথে। সেখানে এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জ ই মামুন বলেন, ‘‘বাংলাদেশের কোনো নির্বাচন কমিশনই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। সবাই বলেছেন, যারা পরাজিত হন তারা নির্বাচনের সমালোচনা করেন। কিন্তু আপনারা অনেকেই বলেছেন, রাতে তো নির্বাচন হয় না। আসলে রাতে ভোটের বাক্স ভরে রাখা হয়েছিল ব্যালটপেপার দিয়ে। ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে পরের দিন। এগুলো ঘটেছে বাংলাদেশে। আমরা এই কথাগুলো জেনেশুনেও বলি না। কারণ, আমরা বলতে ভয় পাই, লিখতে ভয় পাই। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কতখানি তা আমরা সবাই জানি; কিন্তু এখন আমার স্বাধীনতা আর নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা যদি এক রকম হয় তাহলে আমাদের এখানে ডাকার কোনো মানে হয় না। আমি মনে করি, নির্বাচন কমিশন আমার চেয়ে স্বাধীন। নির্বাচন কমিশন যদি স্বাধীনভাবে কথা বলতে চায়, স্বাধীনভাবে কাজ করতে চায় তাহলে তাদের পক্ষে অনেক কিছু করা সম্ভব। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য ‘গণ-প্রতিনিধিত্ব আদেশ’ যথেষ্ট। নির্বাচন কমিশনের মেরুদণ্ড শক্ত থাকলে সরকারের খুব বেশি কিছু করার ক্ষমতা থাকে না। আপনারা চাইলেই সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবেন। বাংলাদেশের মানুষ, গণমাধ্যম আপনাদের সহায়তা করবে।’’

জ ই মামুন সত্যটাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। তার বক্তব্যকে যদি সামনে আনি তাহলে বলতে হয়, ২০১৪ সালে নির্বাচনিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় যেমন একজন আসামিকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন দিয়ে থাকে, তেমনি করেই নির্বাচন প্রক্রিয়াকেও মৃত্যুদণ্ড দিয়ে এ দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে গণতন্ত্রকে চিরতরে বিদায় করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে নির্বাচন কমিশন যার নেপথ্যে কাজ করেছে সরকার। অর্থাৎ সরকারের অধীনে কোনোভাবেই নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবে না।

স্বাধীনতার পর একাদশ সংসদ নির্বাচনসহ মোট ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঘুরেফিরে তিনটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ পাঁচবার, বিএনপি চারবার করে ক্ষমতায় এসেছে। এই নির্বাচনগুলোর মধ্যে সাতটি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে; কিন্তু এর কোনোটিই বিতর্কমুক্ত হতে পারেনি। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় নির্বাচন শেখ মুজিব সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচনেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠেছিল। সবচেয়ে ন্যক্কারজনক নির্বাচন হয়েছে দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনে।

এর একটিতে বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় ভোটাররা ভোট দিতে যায়নি। অন্যটিতে দিনের ভোট আগের দিন রাতেই সম্পন্ন করে ফেলেছে সরকারদলীয় লোক, পুলিশ ও আমলারা মিলে। ভোট গণনায় দেখা যায়, অনেক জায়গায় শতভাগ বা তার থেকেও বেশি ভোটার ভোট দিয়েছেন। অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও এর কোনো প্রতিকার হয়নি। এমনকি ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখা এবং বিরোধীদলীয় ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে না দেয়ার মতো ঘটনা সারা দেশের সব ভোটকেন্দ্রে ঘটলেও নির্বাচন কমিশন থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বরং সিইসির বক্তব্য ছিল এ রকম- ‘আমি দেখিনি, আপনিও দেখেননি। আপনারা দেখেছেন? রাতে হয়েছে- এটি (শুধু) অভিযোগ। এখন যদি তদন্ত হতো আদালতের নির্দেশে, যদি বেরিয়ে আসত, নির্বাচন বন্ধ হয়ে যেত আদালতের নির্দেশে। হয়তো সারা দেশের নির্বাচনও বন্ধ করে দিতে পারত, নতুন করে নির্বাচন করতে পারত যদি সেরকম হতো। রাজনৈতিক দল কেন সে সুযোগ নেয়নি, তারাই বলতে পারবে।’

তিনি আরো বলেছিলেন, “কেবল অভিযোগের উপর ভিত্তি করে ‘কনক্লুসিভ’ কিছু করা যায় না। একজনও আদালতে গিয়ে সংক্ষুব্ধ হওয়ার কথা জানাননি। প্রতিকার চাননি। তখন আমাদের কিছু করার থাকে না। আদালতে যাননি, (তার মানে) অভিযোগ নেই। এটিই আমাদের গ্রহণ করতে হয়।”

নির্বাচন কমিশন সব কিছু জানার পরও এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে তাদের কাজ তারা সেরে ফেলেছে। এখন যদি কিছু করতে হয় তা রাজনৈতিক দলগুলোকেই করতে হবে। যা নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ভোটব্যবস্থার প্রতি চরম উপহাস বৈ অন্য কিছু নয়। সুতরাং কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন কমিশনের কাছে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট দাবি করা বোকামি ছাড়া অন্য কিছু নয়।

একটি দেশের নির্বাচনব্যবস্থা গণতন্ত্রের মাপকাঠিস্বরূপ। সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনমতের প্রতিফলন ঘটে ও জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করার জন্যই সংবিধানে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কথা বলা হয়েছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলেও বাংলাদেশের ইতিহাসে দলীয় সরকারের অধীনে কখনোই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। যদিও বাংলাদেশ সংবিধানের ১১৮(৪) অনুচ্ছেদ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকার নিশ্চয়তা দিয়েছে এবং তাদেরকে কেবলই সংবিধান ও আইনের অধীনে থাকার কথা বলা হয়েছে; কিন্তু নির্বাচন কমিশনদেরকে তাদের ওপর অর্পিত এই স্বতন্ত্র ক্ষমতাকে কখনোই স্বতন্ত্রভাবে প্রয়োগ করতে দেখা যায়নি। বিশেষ করে রকিবউদ্দিন এবং নুরুল হুদা কমিশন একেবারেই মেরুদণ্ডহীনতার পরিচয় দিয়ে সরকারের একান্ত বাধ্যগত গোলাম হয়ে নির্বাচন পরিচালনা করেছেন।

নিয়োগ পাওয়ার পর প্রায় সব নির্বাচন কমিশনকে একই ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখা যায়। যেমন নতুন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল নিয়োগ পাওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘একটি দায়িত্ব আরোপিত হয়েছে। এই দায়িত্ব আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করার চেষ্টা করব। কমিশনের অপর সদস্যদের দায়িত্ব গ্রহণের পর তাদের নিয়ে বসে কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করব।’ (২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, প্রথম আলো)

এখন ২০২৩-এর নির্বাচনে বোঝা যাবে, তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব কতটুকু নিষ্ঠার সাথে পালন করতে পারেন। একই ধরনের বক্তব্য দিয়েও নুরুল হুদা ইতিহাসের নিকৃষ্ট নির্বাচনের আয়োজন করেছেন। অথচ তিনিও তার প্রথম প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘সবাইকে নিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারব বলে আশা করি। নিরপেক্ষ ও সাংবিধানিকভাবে কাজ করাই হবে আমার লক্ষ্য। আমাকে ও আমার কাজ নিয়ে কোনো বিতর্ক হবে না বলেই আমার প্রত্যাশা।’ (৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২)। তার বক্তব্যের পুরো বিপরীত কর্ম করে তিনি ইতিহাসের নিকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।

তাই বলতে চাই, সংলাপ করে ততক্ষণ কোনো লাভ হবে না যতক্ষণ নিজেরা মেরুদণ্ড সোজা করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নিরপেক্ষ নির্বাচন করার সংকল্প দ্বারা আবদ্ধ না হবেন।

সব শেষে বলতে চাই, নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের মধ্য দিয়েই জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে সুধী সমাজ, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া, রাজনৈতিক দলগুলো সর্বোপরি নির্বাচন সংক্রান্ত সব ধরনের স্টেক হোল্ডারদের সাথে সংলাপ করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের চক আউট তৈরি করা যেতে পারে। আর সব কিছুই নির্ভর করবে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের ওপর। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে শুধু লোক দেখানো সংলাপ করে কোনো লাভ হবে না। নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে সংলাপের মূল বিষয় হওয়া উচিত নির্বাচনকালীন সময়ে কিভাবে একটি নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। তবে নির্বাচন কমিশনের সাথে সাথে স্টেক হোল্ডারদেরও মনে রাখতে হবে, সুষ্ঠু নির্বাচন কেবল নির্বাচন কমিশনের একক দায়িত্ব নয়, নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত সাহায্য-সহযোগিতা ও দায়িত্বশীল ভ‚মিকা ছাড়া এই প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব নয়।

harun_980@yahoo.com

Exit mobile version