Site icon The Bangladesh Chronicle

দর বেঁধে দিয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না

আবু আহমেদ

বাংলাদেশের অর্থনীতি রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত নয়। এটা হলো বাজার অর্থনীতি। এ ধরনের অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা হলে সবচেয়ে ভালো। তা না হলে প্রতিযোগিতার কাছাকাছি একটি পদ্ধতি কার্যকর থাকতে হয়। অন্যদিকে বাজার অর্থনীতিতে সবচেয়ে খারাপ হলো একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ বা মনোপলি। এর মানে একজন সরবরাহকারী, যাকে আমরা সাপ্লায়ার বলে থাকি; একক কর্তৃত্বে যখন সাপ্লাই ন্যস্ত থাকে, তখন তাকে মনোপলি বলে। এ অবস্থায় দর বেঁধে দিয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

বাজার অর্থনীতির সৌন্দর্য হলো প্রতিযোগিতায়। প্রতিযোগিতারও মাত্রা আছে। কোনো কোনোটাকে আমরা ‘যথাযথ প্রতিযোগিতাপূর্ণ’ বা পারফেক্টলি কম্পিটিটিভ বলি। খুব বেশি চার্জ করলে ক্রেতারা ওখান থেকে চলে আসে। সুতরাং সবাই প্রায় একই দামের কাছাকাছি চার্জ করে। সেটার জন্য দরকার অনেক লেয়ার। মানে অনেক ক্রেতা ও অনেক বিক্রেতা। যে বাজারে অনেক ক্রেতা ও বিক্রেতা থাকে, সেটাকে আমরা বলি প্রতিযোগিতামূলক বাজার। সেটা ভোক্তার জন্য ভালো। ভোক্তার স্বার্থে যায়।

অন্য দেশের বাজারগুলো যে সবসময় প্রতিযোগিতাপূর্ণ থাকে, তা কিন্তু নয়। বাজারের কোনো কোনো অংশ প্রতিযোগিতাপূর্ণ, আবার কোনো কোনো অংশ প্রতিযোগিতাপূর্ণ নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেখানে অলিগোপলি দেখা যায়; যেখানে ক্রেতা অনেক হলেও সরবরাহকারী বা সাপ্লায়ার গুটিকয়েক।

আমাদের এখানেও অলিগোপলি আছে। যেমন টেলিফোন মার্কেট। সেখানে চার বা পাঁচটি কোম্পানি বাজারে আধিপত্য রাখে। ভোজ্যতেলেও অলিগোপলি। মাত্র কয়েকটি কোম্পানি বাজারের মূল শেয়ারের অধিকারী। তারাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। অলিগোপলির ক্ষেত্রেও বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। কিন্তু যথাযথ প্রতিযোগিতাপূর্ণ অবস্থায় বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হয় না। এর পর থাকে ডুয়োপলি, যেখানে মাত্র দু’জন ব্যক্তি বা কোম্পানি বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এ রকম বাজারকেও নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। স্বাধীন রেগুলেটর দরকার হয়। আমাদের ভালো মানের স্বাস্থ্যসেবাও অলিগোপলির ভিত্তিতে চলে। ওরা চাইলে দাম বেশি নিতেই পারে। যোগসাজশে ওরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তারা একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় না গিয়ে বোঝাপড়া করে বাজারদর ঠিক করে। এগুলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালনা করতে হয়।

আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতে নিয়ন্ত্রণের যথেষ্ট অভাব আছে। এখানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কাজটি করে। অথচ অধিদপ্তর কখনও ভালো রেগুলেটর নিয়ন্ত্রক হতে পারে না।
বাদবাকি পণ্যের বাজারের কথাই বলা যাক। খুচরা ও পাইকারি বাজারের অবস্থা আলাদা। মূলত সাপ্লাই চেইন নিয়ন্ত্রণ করে যথাযথভাবে পরিচালনা করতে হবে। ডিম, পেঁয়াজ, গোলআলু, চালের মতো দ্রব্যের বাজার একটু আলাদা। এসব দ্রব্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দামের কমবেশি হতে পারে। কেউ আমদানি করছে, কেউ স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করছে। তাই দাম বেঁধে দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে দরকার হলো বড় কোনো কোম্পানি বা ব্যক্তির কাছে যেন এ বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে না যায়।

কিছুদিন আগে ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশনকে দায়িত্ব দেওয়ার কথা শোনা গেছে। এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া বেআইনি। এটা আমাদের প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার ব্যবস্থাপনা আইনবিরোধী। এ ক্ষেত্রে ভোক্তা অধিদপ্তর বা অন্যান্য এজেন্সি বিষয়গুলো দেখবে। দাম বেশি নিয়ে ওজনে কম দেওয়ার বিষয়গুলোও তারা তত্ত্বাবধান করতে পারে। বিভিন্ন জায়গায় বাজারের অবস্থা ভিন্ন হতে পারে। উৎপাদন অঞ্চলে দাম কম হবেই। দ্রব্যের হাত বদল হতে হতেই দাম বেড়ে যেতে পারে। এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। আমদানির ক্ষেত্রে কতজন এ ক্ষেত্রে জড়িত, তাও বিবেচনায় রাখতে হবে। মুদ্রাবিনিময় বাজারে দেশীয় টাকার মান কমলে ডলারের তুলনায় টাকার দাম কমবেই। এর প্রভাব আমদানি ব্যয়ে পড়বেই। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে অভ্যন্তরীণ বাজারেও দাম বাড়বে। এগুলো স্বাভাবিক।

সরকার মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ, অকটেন, ডিজেল, গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দেয়। এগুলোর সঙ্গেও মূল্যস্ফীতি জড়িত। যদি সরকার নিজের উদ্যোগে এগুলোর দাম বাড়াতে থাকে, তাহলে বিষয়টা স্বাভাবিক নয়। সরকারের যুক্তি হলো, তাদের লোকসান হচ্ছে। লোকসানের পেছনে মূল কারণ হলো দুর্নীতি কিংবা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব। প্রশ্ন হলো, এর দায় কেন সাধারণ ভোক্তা নেবে? সেটা বিদ্যুতের ক্ষেত্রে হোক কিংবা গ্যাসের ক্ষেত্রে হোক অথবা জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে। চার বছর আগে এগুলোর দাম বাড়িয়ে দিয়ে মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দেওয়া হয়েছে। এত চেষ্টার পরও মূল্যস্ফীতি ৯ বা সাড়ে ৯ শতাংশের কমে আনা যাচ্ছে না। এমনকি মুদ্রা সংকোচন নীতি দিয়েও মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনা সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণ হলো, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যেসব বিষয় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে, সেগুলো সরকার ঠিকঠাক নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। সরকার নিজে এসব প্রভাবকের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এর ওপর কমেছে টাকার মান।

দেশের আয় ও ব্যয়ের হিসাবে সামঞ্জস্য রাখতে হবে। বাংলাদেশ অনেক বছর এই ভারসাম্য রক্ষা করতে পেরেছে। চার বছর ধরে বাংলাদেশ আয়ের তুলনায় বেশি খরচ করেছে। এটা সরকারি খাতে ঘটেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সেটারই মূল্য দিচ্ছে। ডলারের সংকট এমনিতেই হয়নি। অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সময় অর্থ পাচারের ঘটনা বেশি ঘটে। মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়; নিরাপত্তার অভাব দেখা দেয়। গত ১০ বছরে একটা শ্রেণি সরকারের আনুকূল্যে অভাবনীয় সুযোগ নিয়েছে। এসব সুবিধা প্রত্যাহার করে নেওয়া হোক। এতে দুর্নীতি বেড়ে যাচ্ছে। দুর্নীতি, বাজারে দু’চারটি কোম্পানি বা ব্যক্তির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ জনসাধারণকে শোষণ করছে। দুর্নীতির কাফফারাও জনগণকে দিতে হচ্ছে। ৫ শতাংশ লোক সুবিধাগুলো বেশি পাচ্ছে। কম দামে প্রকল্প পাওয়া থেকে শুরু করে সরকারি সব ধরনের সুযোগ তারাই নিচ্ছে। শুধু পদাধিকারবলে এরা সুযোগ পাওয়ায় অনেক অব্যবস্থাপনা তৈরি হচ্ছে। এ কারণে রাজনৈতিক পদ নেওয়ার জন্য দেশে এত মারামারির ঘটনা ঘটছে। কারণ এতে রাষ্ট্রীয় সুবিধা পাওয়া যায়; খুলে যায় শোষণের দরজা। সরকার জনগণের টাকায় সুবিধাভোগী শ্রেণিকে আরও সুযোগ দিচ্ছে। এ কারণে একজন ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারও অনেক টাকা খরচ করে সংসদ সদস্য হতে চান। সরকারকেই এসব অব্যবস্থাপনা বন্ধের দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ সরকারই কর্তৃত্ব প্রয়োগের ক্ষমতা রাখে। দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা দূর করতে হলে বিশেষ কোনো শ্রেণিকে সুবিধা দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

আবু আহমেদ: প্রাক্তন অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

samakal

Exit mobile version