Site icon The Bangladesh Chronicle

দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্র টিকে থাকার লড়াই করছে

সায়রা বানু

দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্র উদ্বেগজনকভাবে পতনের সম্মুখীন। সূচকগুলির ধারাবাহিকভাবে পশ্চাদপসরণ ঘটেছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক অস্বচ্ছ নির্বাচনের পাশাপাশি মেরুকরণের পটভূমিতে ভারতের আসন্ন নির্বাচন এই অঞ্চলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চলমান অবক্ষয়কে তুলে ধরে।

বাংলাদেশে চলতি বছরের ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনের ফলে আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চতুর্থবারের জন্য টানা পাঁচ বছরের মেয়াদ অর্জন করেছেন। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধানের জন্য ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ প্রতিষ্ঠা করতে আওয়ামী লীগ রাজি না হওয়ায় বিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নির্বাচন বয়কট করে । এরফলে গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়াটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটিকে একটি  “ভুয়া” নির্বাচন হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।  হিংসাত্মক বিক্ষোভ এবং সরকারি দমন-পীড়নের পটভূমিতে এই নির্বাচন সংঘটিত হয় যেখানে  ভোটারের উপস্থিতি  উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে  কর্তৃত্ববাদ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অখণ্ডতা ও অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে।

পাকিস্তানে, ৮ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন অনিয়ম এবং ন্যায্যতার অভাবের অভিযোগে বিধ্বস্ত, বিশেষ করে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) পার্টির  সাথে আচরণের ক্ষেত্রে । রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বিভিন্ন দিকে  কার্যকরভাবে  সামরিক বাহিনীর প্রভাব তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। নির্বাচনের সময়, সামরিক বাহিনী প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের পক্ষে ছিল, যিনি সম্প্রতি লন্ডনে চার বছরের নির্বাসন থেকে ফিরে এসেছিলেন।

সেনাবাহিনী ২০২২ সালের এপ্রিলে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে  প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবং তার পিটিআই দলকে থামানোর জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। নির্বাচনের আগের সপ্তাহে ইমরান খান নিজেই তিনটি পৃথক মামলায় কয়েক দশকের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ফাঁস করা থেকে শুরু করে বেআইনি বিয়েতে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। পিটিআই উল্লেখযোগ্য ক্র্যাকডাউনের মুখোমুখি হয়েছিল, যার মধ্যে রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে তার রাজনৈতিক প্রতীক ক্রিকেট ব্যাটটি ছিনিয়ে নেওয়া। পিটিআইয়ের অনেক নেতাকে হয় গ্রেফতার করা হয়েছে বা দল ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে।

এমনকি এই ধরনের ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জের মুখেও, পিটিআই দ্বারা সমর্থিত প্রার্থীরা সফলভাবে সংসদীয় আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে, ২৬৬টির মধ্যে ৯৩ টিতে জয়লাভ করেছে, মূলত তাদের ভোটারদের একত্রিত করতে   সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের সাহায্য নিয়েছে পিটিআই। নওয়াজ শরীফের দল অন্যান্য দলের সাথে জোটবদ্ধ ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকার গঠন করে, শরীফের ভাই শেহবাজ শরীফ ৩রা মার্চ দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। এটা স্পষ্ট যে ইমরান খানের দল নবগঠিত সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানাতে  থাকবে, এই অভিযোগে যে নির্বাচনে আদতে তারা  ম্যান্ডেট দখল করেছে। এই পরিস্থিতি পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা  আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং  অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলিকে আরও জটিল করতে পারে। পাকিস্তানের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট  এই নির্বাচনে পরিলক্ষিত গণতান্ত্রিক নিয়ম লঙ্ঘন সম্পর্কে ক্রমাগত উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছে ।
মালদ্বীপ প্রায় একই রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের শিকার না হলেও  গত বছরের সেপ্টেম্বরে তার চতুর্থ বহুদলীয় প্রেসিডেন্ট  নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যার ফলে বিরোধী নেতা মোহাম্মদ মুইজ্জু ক্ষমতায় আসেন । পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট  ইব্রাহিম সোলিহ,  নির্বাচনের ঠিক আগে দলে বিভাজনের জেরে হেরে যান । যদিও নির্বাচনটি তুলনামূলকভাবে প্রতিযোগিতামূলক এবং শান্তিপূর্ণ ছিল, তবে স্বাধীন পর্যবেক্ষকরা   নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করার জন্য রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহার করার এবং অনুকূল কভারেজের বিনিময়ে আর্থিক পুরস্কার দিয়ে মিডিয়াকে উৎসাহিত করার অভিযোগ তুলেছেন  সরকারের বিরুদ্ধে । এই সময়কালে ব্যাপক ভোট কেনার অভিযোগও উঠেছে , যা নির্বাচনের ন্যায় ও নিরপেক্ষতাকে ক্ষুণ্ন করে।

অবশেষে, ভারত বিশ্বের  বৃহত্তম গণতান্ত্রিক অনুশীলনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। কারণ  এপ্রিল-মে মাসে একটি নতুন সংসদ নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশটি । ভারতের  রাজনৈতিক পরিবেশকে  ক্রমবর্ধমান মেরুকরণের দ্বারা চিহ্নিত করা হয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই অভিযোগে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে যে তিনি শক্তিশালী কৌশল অবলম্বন করেন এবং বিভাজনমূলক নীতিকে সমর্থন করেন। সরকার নাগরিক স্বাধীনতা, মুক্ত গণমাধ্যম এবং সংখ্যালঘুদের অধিকারের উপর অভূতপূর্ব আক্রমণ শুরু করেছে, পাশাপাশি বৈষম্যমূলক আইন প্রবর্তন করেছে। এই সরকারের অধীনে, ভারতকে বার্ষিক ফ্রিডম হাউস সূচকে- “মুক্ত গণতন্ত্র” থেকে “আংশিকভাবে মুক্ত গণতন্ত্র”-এ নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।

গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি এ ধরনের অঞ্চলব্যাপী চ্যালেঞ্জ অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে। তারা নিরাপত্তাহীনতা বাড়ায় এবং চরম দারিদ্র্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনসহ জরুরি সমস্যা মোকাবেলায় সম্মিলিত রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করে। দক্ষিণ এশিয়া চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশর  প্রতিনিধিত্ব করে।  বন্যা থেকে খরা এই অঞ্চলে  পরিবেশগত ঘটনাগুলি  প্রচলিত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে । গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ থেকে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এই সমস্ত চ্যালেঞ্জকে আরও কঠিন করে তোলে।

manabzamin

Exit mobile version