জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবারের নাটাই নিজের হাতে রাখতে চলছে আধিপত্যের লড়াই। গেল ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ক্যাম্পের দখল নিতে আরও আগ্রাসী কারবারিরা। দেড় মাসে অন্তত ২০ দিন তারা সংঘাতে জড়িয়েছে। প্রতিপক্ষ ঘায়েলে বাড়িয়েছে অস্ত্রের মজুত। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর সহিংস পরিস্থিতির মধ্যে থানা থেকে লুট করা কিছু আগ্নেয়াস্ত্র তারা নানাভাবে সংগ্রহ করেছে। পাশাপাশি কিনেছে দেশি-বিদেশি অস্ত্র। তথ্য বলছে, ক্যাম্পের চারটি মাদক কারবারি চক্রের কাছে এখন ১৮টি আগ্নেয়াস্ত্র আছে। তাদের সংঘর্ষ ও গুলিতে এ পর্যন্ত শিশুসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে মারা গেছেন মো. সাগর (২৫) নামে এক যুবক। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ১৫ জনের বেশি।
ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানান, শীর্ষ মাদক কারবারি ভূঁইয়া সোহেল ওরফে বুনিয়া সোহেল ও চুয়া সেলিমের বিরোধ দীর্ঘদিনের। কয়েক মাসে এই শত্রুতা আরও দানা বেঁধেছে। ফলে মাঝেমধ্যেই সংঘর্ষে জড়াচ্ছে তারা। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে আরও কয়েকটি মাদক চক্র। এর মধ্যে সোহেলের সঙ্গে রয়েছে মোল্লা জাহিদের পৃষ্ঠপোষকতায় চলা সৈয়দপুরিয়া বাবু ওরফে আমজাদ আলী বাবু ও তার ভাই আলতাফ বামের দল। দিল্লি সাঈদ ও তার ভাগনে ইরফান বিরিয়ানির দলও রয়েছে একই পক্ষে। ইরফানের বাবা মো. কামালের বিরিয়ানির দোকান থাকায় তাঁকে লোকজন ‘কামাল বিরিয়ানি’ নামে চেনে। সেই সূত্রে ইরফানের নামের সঙ্গেও বিরিয়ানি শব্দটি যুক্ত হয়েছে। অন্যদিকে, সেলিম চক্রকে সব রকম সহায়তা করে মোল্লা আরশাদ ও পেলু আরমান। সংঘর্ষে সেলিমের পক্ষে রয়েছে কোপ মনু, আকরাম ও গেইল হীরার দল।
কার কাছে কত অস্ত্র
ক্যাম্পে এখন সবচেয়ে প্রভাবশালী ভূঁইয়া সোহেলের চক্র। তাদের কাছে আছে আটটি আগ্নেয়াস্ত্র। এর মধ্যে তিনটি বিদেশি অস্ত্র তারা কিনেছে। মিরপুরের কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পের মোহাম্মদ আলীর মাধ্যমে জনৈক আরমানের কাছ থেকে অস্ত্রগুলো কেনা হয়। রয়েছে থানা থেকে লুট করা দুটি বন্দুক। এগুলো সোহেলের সহযোগীরা লুট করেছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশের তখনকার কয়েক কর্মকর্তা সোহেলের সহযোগিতা নেন। সোহেলের অনুসারী মাদক বিক্রেতারা পুলিশের সহযোগী হিসেবে মাঠে ছিল। সেই সময় তাদের হাতে কিছু অস্ত্র দেয় পুলিশ। সেগুলো সরকারি, নাকি অবৈধ অস্ত্র তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সেসব অস্ত্রের তিনটি সোহেলের অনুসারীদের কাছে রয়ে গেছে। সংঘর্ষের সময় সোহেল নিজে, তার ভাই টুনটুন, রানা, রাজন ওরফে কালু, কলিম জাম্বু, মোহাম্মদ আলী, আহম্মদ আলী ও বানর আরিফ অস্ত্রগুলো ব্যবহার করে।
এদিকে সোহেলের সহযোগী হিসেবে কাজ করা সৈয়দপুরিয়া বাবুর কাছে তিনটি অস্ত্র আছে। এর মধ্যে দুটি পুলিশের, যা থানা থেকে লুট করা। আর একটি দেশে তৈরি পিস্তল তারা কিনেছে। বাবু ছাড়াও তার সহযোগী সাজ্জাদ, ইরফান ও তিল্লি শাহিদ এসব অস্ত্র ব্যবহার করে।
অন্যদিকে, সোহেলের প্রতিপক্ষ চুয়া সেলিম গ্রুপের কাছে অস্ত্র আছে চারটি। এর মধ্যে দুটি থানা থেকে লুট করা। বাকি দুটি বিদেশি পিস্তল তারা কিনেছে। সেলিম ছাড়াও তার সহযোগী উল্টা সালাম, শান্ত, পিচ্চি রাজা, ফাট্টা আবিদ, পিস্তল নাঈম ও শাহজাদা গুলি চালনায় পটু। সম্প্রতি শান্ত ছররা গুলিতে আহত হয়। সেলিমের পক্ষের আরেক চক্র আকরাম ও গেইল হীরার কাছেও আছে তিনটি অস্ত্র। এর মধ্যে একটি স্থানীয়ভাবে লেদের তৈরি এবং দুটি বিদেশি পিস্তল। তিনটিই কিনেছে তারা। আর কোপ মনুর কাছে কোনো অস্ত্র আছে কিনা, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে আকরামের অস্ত্র দুই গ্রুপের সদস্যরাই ব্যবহার করে। তাদের মধ্য রয়েছে মনির, শরীফ, কুরাইশ ও হাসিব।
শক্তির উৎস কোথায়
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগসাজশের কারণে বিগত বছরগুলোয় ক্যাম্পে শক্ত অবস্থান ছিল সোহেলের। ঢাকা-১৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচিত বিপ্লব ও জয়নাল আবেদীন জয় এই চক্রকে সহায়তা করতেন। বিনিময়ে বিপ্লব প্রতিদিন ৫ হাজার টাকা নিতেন। সেই সঙ্গে নানকের ‘ঘনিষ্ঠজন’ হিসেবে পরিচিত স্থানীয় ৩২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের নেতা মো. আরমানও নানাভাবে সোহেলকে সহায়তা করতেন।
অন্যদিকে, চুয়া সেলিম চক্র রাজত্ব করেছে মূলত বিএনপির সময়কালে। দলটির স্থানীয় কয়েক নেতাকর্মীর সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। এ কারণে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কিছুটা বেকায়দায় পড়ে সেলিম। পরে সে বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের সাধারণ সম্পাদক তামজিদ বিন রহমান তূর্যর সহায়তা পায়। তূর্য সৈনিক লীগের প্রতিষ্ঠাতা বজলুর রহমান ও সংরক্ষিত আসনের সাবেক এমপি শিরীন আহমেদের সন্তান।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এই নেতাকর্মীকে আর এলাকায় দেখা যাচ্ছে না, ফোন নম্বরও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
স্থানীয়রা জানান, সেলিমের বিরুদ্ধে অন্তত ২০টি মামলা রয়েছে। আর সোহেলের বিরুদ্ধে গত চার মাসে তিনটি হত্যা, দুটি অপহরণ ও বিস্ফোরক মামলা হয়েছে। এ ছাড়া তার নামে সাত-আটটি মাদক মামলা রয়েছে।
কারবারিরা বেপরোয়া, প্রাণ গেছে চারজনের
জেনেভা ক্যাম্পে বছরে অন্তত ১০০ কোটি টাকার মাদক বিক্রি হয় বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। তাই এই ‘মধুর হাঁড়ি’ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় সব মাদক কারবারি। একটা সময় পর্যন্ত নাদিম ওরফে পঁচিশ ও ইশতিয়াক নিয়ন্ত্রণ করত এই সাম্রাজ্য। ২০১৮ সালে র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নাদিম নিহত হয়। এর দুই বছর পর ভারতে পলাতক অবস্থায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইশতিয়াকের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়। তাদের শূন্যস্থান দখল করতে প্রতিযোগিতায় নামে সোহেল-সেলিমরা। কয়েক বছর ধরে চলে আসা এই লড়াই এ বছর তীব্র রূপ নেয়। সর্বশেষ ৫ আগস্ট রাত থেকেই শুরু হয় তুমুল সংঘর্ষ। দিনরাত থেমে থেমে ৯ আগস্ট পর্যন্ত চলে এ ঘটনা। এর মধ্যে ৬ আগস্ট কলিম জাম্বুর গুলিতে মারা যান শাহেন শাহ নামে এক যুবক। একই দিনে গলায় গুলিবিদ্ধ হন শুভ। পরে ১৭ আগস্ট আবারও সংঘর্ষ শুরু হয়, যা চলে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত। আরেক দফা বিরতির পর আবার ৩০ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংঘর্ষ হয়। এ দফায় শেষের দিন (৪ সেপ্টেম্বর) সোহেলের গুলিতে মারা যান অটোরিকশাচালক সাদ্দাম হোসেন সনু। আহত হন কুরাইশ। সর্বশেষ ২২ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে গতকাল সকাল পর্যন্ত চলে দু’পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি ও গোলাগুলি। এর মধ্যে গতকাল চুয়া সেলিমের স্ত্রী নাগিন বেগম ও ২৩ সেপ্টেম্বর চারকো ইরফান গুলিবিদ্ধ হয়। আর ২৪ সেপ্টেম্বর গুলিবিদ্ধ সাগর চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল ভোর ৫টার দিকে মারা যান। তিনি পেশায় কসাই ছিলেন। এর আগে ৩১ মে ককটেল বিস্ফোরণে মারা যায় রাসেল নামে এক শিশু। সে ও সাগর ছাড়া নিহত অন্য দু’জন সেলিমের পক্ষের লোক ছিলেন।
সংঘর্ষের কিছু ছবি-ভিডিও সমকালের হাতে এসেছে। তাতে দেখা যায়, দু্’পক্ষের পাল্টাপাল্টি হামলায় ক্যাম্প যেন রণক্ষেত্র। ছবি দেখে গুলি ছোড়া কয়েকজনকে শনাক্ত করা যায়। তারা হলো– কলিম জাম্বু, ভূঁইয়া সোহেল ও মোহাম্মদ আলী। এ ছাড়া চুয়া সেলিম ও শুটার আকরামকে গুলি ছুড়তে দেখেছে বলে জানান অনেকে।
জানা যায়, ক্যাম্পের ৪ নম্বর সেক্টরের ডি-ব্লক ও ৮ নম্বর সেক্টরের এইচ-ব্লকে সেলিম-আকরামদের শক্ত অবস্থান। অন্যদিকে, ৭ নম্বর সেক্টরের জি-ব্লকে সোহেলের ঘাঁটি। তাদের সংঘর্ষের কারণে ক্যাম্পের সাধারণ বাসিন্দাদের জীবন ঝুঁকিতে রয়েছে।
ধরা পড়ছে না শীর্ষ মাদক কারবারি
ক্যাম্পে মাদকবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী জিয়া উদ্দিন বলেন, যারা সংঘর্ষে জড়াচ্ছে, তারা সবাই চিহ্নিত মাদক কারবারি। তাদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা আছে। কেন তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না, তা জানি না। পুলিশ চেষ্টা করছে বলছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) ভূমিকাও দৃশ্যমান নয়।
তিনি জানান, ক্যাম্পের নন-লোকাল রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান এস কে গোলাম জিলানীর বিরুদ্ধেও মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। তাঁর ছেলে, ভাইসহ পরিবারের চারজন এ কারবারে যুক্ত। এ কারণে মাসখানেক আগে ক্যাম্পের বাসিন্দারা তাঁর ওপর চড়াও হন। তখন থেকে তিনি পলাতক এবং চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করতে চাচ্ছেন না।
গোলাম জিলানীর মোবাইল ফোন নম্বর চালু পাওয়া গেলেও কেউ কল ধরেননি। ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে অ্যাডভোকেট আইয়ুব আলীর নাম শোনা গেলেও তিনি জানান, এখনও তিনি দায়িত্ব পাননি।
ডিএনসির পরিচালক (অপারেশন্স ও গোয়েন্দা) অতিরিক্ত ডিআইজি তানভীর মমতাজ বলেন, ক্যাম্প এলাকায় প্রায়ই অভিযান চালানো হচ্ছে। সম্প্রতি তালিকভুক্ত শীর্ষ মাদক কারবারি কালুসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ রুহুল কবির খান বলেন, মাদক কারবারিদের গ্রেপ্তার ও অস্ত্র উদ্ধারে ক্যাম্পের ভেতরে-বাইরে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। অনেক অভিযানে সেনাবাহিনীর সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। তবে চিহ্নিত মাদক কারবারিরা এখানে থাকে না, মাঝেমধ্যে এসে সংঘর্ষে জড়ায়।
samakal