Site icon The Bangladesh Chronicle

তিন বছরে বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকি এক লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা!

ইসমাইল আলীকয়েক বছরে ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে চলেছে। যদিও চাহিদা সে অনুপাতে না বাড়ায় প্রায় অর্ধেক সক্ষমতা বসেই থাকছে। এছাড়া কয়েক বছর ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও বাড়ছে দ্রুত। ফলে বিদ্যুৎ বিক্রি করে বড় অঙ্কের লোকসান দিচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এ ঘাটতি পূরণে পিডিবিকে নিয়মিত ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। তবে সর্বশেষ তিন অর্থবছর (২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪) ধরে এ খাতে সরকারের ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।

পিডিবির তথ্যমতে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও কয়লার মূল্যবৃদ্ধিতে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। যদিও ফেব্রুয়ারির পর থেকে ব্যয় কমতে শুরু করে। তবে সার্বিকভাবে পুরো অর্থবছরের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আদানি, রামপালসহ নতুন কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাড়তি ক্যাপাসিটি চার্জ। এতে ২০২২-২৩ অর্থবছর রেকর্ড লোকসানের মুখে পড়েছে পিডিবি।

এর পরিপ্রেক্ষিতে গত অর্থবছরের জন্য রেকর্ড ৩৯ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা ভর্তুকি চাওয়া হয়েছে। যদিও ছাড় করা হয়েছে অনেক কম। আর ২০২১-২২ অর্থবছর পিডিবির ভর্তুকি চাহিদা ছিল ২৯ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছর সংস্থাটির ভর্তুকি চাহিদা এক লাফে বেড়ে যায় ৯ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা বা ৩৩ দশমিক ৩০ শতাংশ।

চলতি অর্থবছর জানুয়ারি পর্যন্ত পিডিবির ভর্তুকি চাহিদা ছিল ২১ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা। তবে অর্থবছর শেষে তা ৩৯ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা দাঁড়াবে বলে প্রাক্কলন করেছে সংস্থাটি। অর্থাৎ চলতি অর্থবছর ভর্তুকি বাড়ছে না, বরং ১২৯ কোটি টাকা হ্রাস পেতে পারে। মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লা ও তেলের দাম কম থাকায় চলতি অর্থবছর জ্বালানি ব্যয় কিছুটা হ্রাস পেতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ হিসাবে ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪ পর্যন্ত তিন অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থাটির ভর্তুকি চাহিদা দাঁড়িয়েছে এক লাখ আট হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা। ভর্তুকির এ পরিমাণ পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও টানেলের সম্মিলিত নির্মাণব্যয়ের চেয়েও বেশি।

এদিকে বিদ্যুৎ খাতে উচ্চ ভর্তুকি নিয়ে দিশাহারা অর্থ মন্ত্রণালয়। তাই ভর্তুকির চাপ সামলাতে বছরে চারবার বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর মাধ্যমে আগামী তিন বছরে বিদ্যুৎ খাতে মোট ভর্তুকি কমিয়ে আনা হবে। এই সময়ে মোট ১২ দফা বাড়ানোর মাধ্যমে বিদ্যুতের দামকে উৎপাদন খরচের সমান বা কাছাকাছি নিয়ে আসা হবে। সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ ঢাকা সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদলকে এ কথা জানিয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে আসা আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগের বৈঠকে ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের বিষয়টি বৈঠক উঠে আসে। এ সময় বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ খাতে সরকার কীভাবে এবং কতটা ভর্তুকি কমাবে, তা জানতে চায় আইএমএফ প্রতিনিধিদল। জবাবে বিদ্যুৎ বিভাগ বলেছে, বিদ্যুতের দাম প্রতি বছর চার দফা সমন্বয় করা হবে।

এর আগে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত ফেব্রুয়ারিতে সাংবাদিকদের একই ধরনের আভাস দিয়েছিলেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, উৎপাদন খরচের চেয়ে এখন অনেক কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করা হয়। ঘাটতি মেটাতে দাম সমন্বয় করা হচ্ছে। আগামী তিন বছর ধরে ধাপে ধাপে দাম সমন্বয় করা হবে। এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনা হবে।

এর অংশ হিসেবে গত ফেব্রুয়ারিতেই সরকার বিদ্যুতের দাম একবার বাড়ায়। এর আগে গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে তিন দফায় বাড়ানো হয়েছিল বিদ্যুতের দাম। গত দেড় দশকে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও খুচরায় ১৪ দফা বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। এছাড়া চলতি মাসে বা জুনে বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়ানো হতে পারে বলে পিডিবি সূত্রে জানা গেছে।

যদিও বিদ্যুৎ খাতে উচ্চ ভর্তুকির জন্য সরকারের ভুল পরিকল্পনাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, ভর্তুকি কমাতে দাম না বাড়িয়ে বরং দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমানো সম্ভব। তিনি বলেন, বিকল্প তো ছিলই। আইনের চোখে অন্যায় ও অযৌক্তিক ব্যয়বৃদ্ধি প্রতিরোধ করলেই হতো। সরকার সে পথে হাঁটেনি। যখন-তখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ভোক্তার ওপর জুলুমের শামিল।

অধ্যাপক শামসুল আলম আরও বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সময় তারা ভোক্তাদের জিজ্ঞেস করে না। বিইআরসি বা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি আইন তো বহাল আছে। গণশুনানির মাধ্যমে দাম বাড়ালে জনগণ জানতে পারত সরকার কোন খাতে কী খরচ করেছে, কেন সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। গণশুনানিতে ক্যাবের পক্ষ থেকে কয়েকবারই অপ্রয়োজনীয় খরচের খাতগুলো চিহ্নিত করে দেখানো হয়েছে।

সেগুলো বাদ দিলে দাম বাড়ানোর পরিবর্তে উল্টো কমানো সম্ভব বলেও প্রস্তাবনা দেয় ক্যাব। তবে তা কখনোই সরকার আমলে নেয়নি। বরং সহজ পন্থায় দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে খরচের বোঝা জনগণের কাঁধে চাপানো হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ অনেক কম ছিল। ২০০৮-০৯ থেকে ২০২০-২১ পর্যন্ত ১৩ অর্থবছর পিডিবির ভর্তুকি চাহিদা ছিল ৭২ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০০৮-০৯ অর্থবছর ভর্তুকির পরিমাণ ছিল এক হাজার সাত কোটি টাকা ও ২০০৯-১০ অর্থবছর ৯৯৪ কোটি টাকা। তবে সংস্থাটির লোকসান বাড়তে শুরু হয় মূলত ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে। সে অর্থবছর পিডিবিকে ভর্তুকি দেয়া হয় চার হাজার কোটি টাকা।

পরের (২০১১-১২) অর্থবছর পিডিবির লোকসান আরও বাড়লে ভর্তুকি দেয়া হয় ছয় হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা। লোকসান কিছুটা কমায় ২০১২-১৩ অর্থবছর ভর্তুকি চাহিদা কমে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছর পাঁচ হাজার ৬২১ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থছর পিডিবির লোকসান আরও বেড়ে যায়। সে অর্থবছর সংস্থাটিকে ভর্তুকি চাহিদা ছিল সাত হাজার ৮৭১ কোটি টাকা।

২০১৫-১৬ অর্থবছর পিডিবির লোকসান অর্ধেকে নামায় ভর্তুকি চাহিদা দাঁড়ায় চার হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছর পিডিবির লোকসান আরও কমায় ভর্তুকি দরকার ছিল তিন হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা। ওই অর্থবছর পর্যন্ত ভর্তুকির অর্থ ঋণ হিসেবে দেয়া হতো।

২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে সরাসরি অনুদান হিসেবে ভর্তুকি দেয়া শুরু হয়। ওই অর্থবছর ভর্তুকি চাহিদা ছিল পাঁচ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। পরের (২০১৮-১৯) অর্থবছর ভর্তুকি দরকার হয় সাত হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে সাত হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা। আর ২০২০-২১ অর্থবছর পিডিবির ভর্তুকি চাহিদা ছিল ১১ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা।

sharebiz

Exit mobile version