Site icon The Bangladesh Chronicle

তিন গভর্নরের আমলে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে

দেশের ব্যাংক খাতে গত ১৫ বছর তিন গভর্নর দায়িত্ব পালন করেছেন। এই তিন গভর্নরের আমলে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে, যার পরিমাণ এক লাখ ২৩ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। তিন গভর্নর হলেন ড. আতিউর রহমান, ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার (বর্তমানে দায়িত্বরত)।

জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ১২তম গভর্নর হিসেবে ২০২২ সালের ১২ জুলাই দায়িত্ব নেন আব্দুর রউফ তালুকদার। ওই সময় অর্থাৎ ২০২২ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের আকার ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৯ শতাংশ। অর্থাৎ আব্দুর রউফ তালুকদার দায়িত্ব নেয়ার দেড় বছরের মাথায় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২০ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগ দিয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, অস্থিতিশীল ডলার বাজার স্থিতিশীল এবং ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমানোসহ নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। যদিও দায়িত্ব নেয়ার পর পৌনে দুই বছরে তেমন কোনো বিষয়ে অগ্রগতি দেখাতে পারেননি তিনি। বরং এ সময় ডলারের বাজার উল্টো অস্থিতিশীল হয়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ও সার্বিক মূল্যস্ফীতি রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছায়।

আব্দুর রউফ তালুকদারের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন ফজলে কবির। তিনি দুই মেয়াদে সাত বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন। তার দুই মেয়াদে সবচেয়ে বেশি ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে, যার পরিমাণ ৬৫ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা। তিনি গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেন ২০১৬ সালের ২২ মার্চ। ওই সময় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। তার দুই মেয়াদের দায়িত্ব শেষ হয় ২০২২ সালের ৩ জুলাই। অবসরে যাওয়ার আগে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা।

ফজলে কবিরের আগে ২০০৯ সালের ১ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের দশম গভর্নর হিসেবে যোগ দেন ড. আতিউর রহমান। প্রথম মেয়াদে চার বছর পূর্ণ হলে সরকার তার মেয়াদ আরও বাড়ায়। তার প্রথম মেয়াদের চার বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পায় প্রায় ২০ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। দ্বিতীয়বার আরও চার বছরের জন্য দায়িত্ব পেলেও মেয়াদ শেষ করতে পারেনি তিনি। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তাকে আগেই পদত্যাগ করতে হয়।

তার দুই মেয়াদে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ৩৬ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা। তিনি দায়িত্ব নেয়ার সময় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। পদত্যাগ করার সময় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ রেখে যান ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি টাকার। ব্যাংক খাতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ বেড়েছিল এ গভর্নরের আমলে।

এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নবম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ২০০৫ সালের ১ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেন। ওই সময় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। তিনি বিদায় নেন ২০০৯ সালের ৩০ এপ্রিল। বিদায় নেয়ার সময় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই গভর্নরের আমলে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছিল চার হাজার ৯৭০ কোটি টাকা।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অষ্টম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ড. ফখরুদ্দীন আহমদ। ২০০১ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে ২০০৫ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত গভর্নরের হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তার সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ছয় হাজার ৯০ কোটি টাকা। এর আগে ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের আমলে খেলাপি বাড়ে তিন হাজার ৬৯৭ কোটি। লুৎফুর রহমান সরকারের সময় আট হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা এবং খোরশেদ আলমের সময়ে চার হাজার ৪৮০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পায়।

এদিকে গভর্নর হিসেবে বৈশ্বিক র?্যাংকিংয়ে ‘ডি গ্রেড’ পেয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক গ্লোবাল ফিন্যান্স ম্যাগাজিনের র‌্যাংকিংয়ে তিনি ‘ডি’ গ্রেড পান। এর আগের গভর্নর ফজলে কবির তিন বছর যথাক্রমে বি, ডি ও সি মাইনাস গ্রেড পান। আর ড. আতিউর রহমান দুই বছর সি গ্রেড পেয়েছিলেন।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব দিচ্ছে, তাও আবার প্রকৃত তথ্য নয়। কারণ প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি। মামলার কারণে অনেক ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। আবার অবলোপন করা ঋণও খেলাপি হিসাবে নেই। এছাড়া পুনঃতফসিল করা ঋণও খেলাপি হিসাবে দেখাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পুনঃতফসিল করা ঋণ, অবলোপন করা ঋণ এবং আদালতের স্থগিতাদেশ দেয়া ঋণকে খেলাপি হিসেবে দেখানোর পক্ষে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে দেশে পুনঃতফসিল করা ঋণের স্থিতি ছিল দুই লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। এর বাইরেও মামলার কারণে আটকা আছে আরও দুই লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা এবং অবলোপনকৃত ঋণে ৪৯ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা। ফলে সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ হবে ছয় লাখ কোটি টাকার বেশি, যা মোট ঋণের ৩৮ শতাংশ।

সম্প্রতি খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক রোডম্যাপ বা পথনকশা ঘোষণা করেছে। এই পথনকশা বা রোডম্যাপের মাধ্যমে আগামী ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে ব্যাংক খাতের সার্বিক খেলাপি ঋণ আট শতাংশের নিচে নামানো হবে, যা এখন ৯ শতাংশে রয়েছে। আর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ এবং বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ পাঁচ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে, যা ডিসেম্বর শেষে যথাক্রমে ২০ দশমিক ৯৯ ও ৫ দশমিক ৯৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

sharebiz

Exit mobile version