Site icon The Bangladesh Chronicle

তাপমাত্রাজনিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়

তাপমাত্রাজনিত প্রাকৃতিক বিপর্যয় – ছবি : সংগ্রহ


বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত তাপে অনেক বন্য প্রাণী ও গাছপালা বিলুপ্তির পথে, বন্যা পরিস্থিতির ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। অন্য দিকে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ও এর ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা বাড়ছে। যে মাসে ঘূর্ণিঝড় হওয়ার রেকর্ড নেই; সে মাসেও ঘূর্ণিঝড় তৈরি হচ্ছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে বাড়িতেই হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। এমনকি ক্ষেতখামারে কাজ করতে গিয়ে অতিরিক্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে না পেরে মাঠেই পড়ে যাচ্ছেন কৃষক। তাপমাত্রাজনিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে।

তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। বেশি তাপমাত্রায় শ্রমিকরা কাজ করতে পারেন না নিরবচ্ছিন্নভাবে। কিছুক্ষণ পর পর কিছুটা বিশ্রাম নিতে হয়। এতে সার্বিক উৎপাদন কমে যাচ্ছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রায় কাজ করলেও পুরোদমে কাজ করা শ্রমিকদের পক্ষে সম্ভব হয় না। বাংলাদেশে শ্রমঘন পোশাক কারখানার অবস্থাটা এমনই। এখানে অল্প জায়গায় বেশি শ্রমিক কাজ করেন বলে একজনের শরীরের উত্তাপ আরেকজনের গায়ে লাগে। তা ছাড়া মেশিন থেকে নির্গত তাপ সবচেয়ে বেশি। সে চেয়ে পোশাক কারখানায় কুলিং সিস্টেম (ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা) নেই বললেই চলে। মাথার উপরে যে বৈদ্যুতিক পাখাটি বাতাস দেয় গ্রীষ্মের খরতাপে তাও অসহ্য ঠেকে। অতিরিক্ত তাপমাত্রায় কাজ করতে গিয়ে কর্মদক্ষতাও কমছে। বেশি গরমে পর্যাপ্ত পানি না পেয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন ডায়রিয়ায়। কৃষি ও নির্মাণশিল্পের শ্রমিকদের অবস্থা আরো খারাপ। উন্মুক্ত মাঠে কাজ করেন বলে, কাজের ফাঁকে তাদের বিশ্রামে যেতে হয়। এমনকি করপোরেট অফিসগুলোতে এয়ার কন্ডিশনার মেশিনগুলোও ঠিক কাজ করতে পারে না অতিরিক্ত গরমে। অতিরিক্ত তাপ পর্যটনে, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য খাতে খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। তেল পোড়াতে হচ্ছে অধিক তাপমাত্রা থেকে মানুষকে রক্ষা করতে। উৎপাদন কমে যাওয়ায় আয়ও যাচ্ছে কমে।

উচ্চ তাপমাত্রায় ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শহরগুলোর একটি। দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ত পানি ফসলের মাঠে ঢুকে পড়ায় আশ্রয় ও কাজ হারিয়ে সেখানকার মানুষ পাড়ি জমাচ্ছেন শহরাঞ্চলে। অধিক বন্যা ও নদীভাঙনেও বাস্তুহারা হয়ে মানুষ শহরমুখী হচ্ছেন। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় জলবায়ুজনিত উদ্বাস্তুর পরিমাণ অনেক বেশি। অন্য দিকে অধিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দিন দিন শহরাঞ্চলের সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবনতি হচ্ছে। এ কারণে ঢাকা বিশ্বের দরিদ্র শহরগুলোর একটিতে পরিচিতি পেয়েছে। জনসংখ্যা এত বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, ঢাকা হয়ে উঠেছে বিশ্বের উচ্চ জন-ঘনত্বপূর্ণ একটি শহর। ১৯৮৩ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৪০ লাখ। বর্তমানে প্রায় দুই কোটির ওপরে।

বিজ্ঞানীদের ‘ওয়েট বাল্ব গ্লোব টেম্পারেচার’ স্কেল অনুযায়ী ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে এক্সট্রিম হিট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গবেষণা অনুসারে, চরম তাপমাত্রা মানুষের কাজ করার সামর্থ্য কমিয়ে দেয়ার পাশাপাশি গড় উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয়। বাংলাদেশ এখন অতিরিক্ত গরমের দেশ। উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় দীর্ঘ গ্রীষ্ম, উষ্ণ শীতকাল এবং প্রলম্বিত মৌসুমি বায়ু সারা দেশে সংক্রামক রোগও বাড়াচ্ছে। আবহাওয়ার অনিশ্চিত অবস্থায় ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটে মহামারী আকারে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন ঢাকা মহানগরীর মানুষ। মধ্য অক্টোবরে মানুষের প্রত্যাশা থাকে গরম সরে গিয়ে সহনীয় পরিবেশ বিরাজ করবে, সামনেই শীত মৌসুম। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অক্টোবরেও তাপমাত্রা কমছে না। বিশ্বব্যাংকের এ বিষয়ক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এখন ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গিয়ে ঠেকছে। আগে জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ধরা হতো মৌসুমি বায়ুর সময়। এখন জুন থেকে আগস্ট মাসের পরিবর্তে গড় বৃষ্টিপাত বেশি হচ্ছে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা বেড়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে ১.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ১.৮ থেকে ১.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা বেড়েছে।

অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৭০০ কোটি শ্রমঘণ্টার ক্ষতি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক ইউনিভার্সিটির গবেষণায় উঠে এসেছে এসব তথ্য। ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, যদি তাপমাত্রা বর্তমানের চেয়ে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে, তা হলে বছরে ২১ বিলিয়ন (দুই হাজার ১০০ কোটি) শ্রমঘণ্টার ক্ষতি হবে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী ২০৩৭ সালের মধ্যেই বর্তমান তাপমাত্রা থেকে অতিরিক্ত ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে। ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়বে ২০৫১ সালের মধ্যে। গবেষণায় বলা হয়েছে, অনেক দেশ এবং মানুষ গ্রিনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধির জন্য দায়ী নয়, তা সত্ত্বেও সেসব দেশ জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের কথা বলা যায়। জলবায়ুজনিত কারণে বাংলাদেশ বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ এক শতাংশের জন্যও দায়ী নয়। গ্রীষ্মের তপ্তদুপুরে ঢাকার তাপমাত্রা ৩৫-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে বিরাজ করে। বেশি তাপমাত্রায় প্রতিটি শ্রমিকের শ্রমঘণ্টা গড়ে ১০ মিনিট করে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রত্যেক শ্রমিকের বছরে ২৫৪ ঘণ্টা শ্রম নষ্ট হয়ে যায়। অন্য দিকে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বছরে ২৮০ থেকে ৩১১ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়ে থাকে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায়।

এসব ক্ষতির শিকার হয়ে থাকে বাংলাদেশের মতো নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে যেখানে শ্রমিক মেশিন ব্যবহারের বদলে হাতে কাজ করেন। বাংলাদেশে প্রধানত কৃষি ও নির্মাণ শিল্পের কাজ হাতে হয়ে থাকে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের কিছু এলাকাকে হিট আইল্যান্ড হিসেবেও ঘোষণা করেছেন গবেষকরা। এ দু’টি বড় শহরে গ্রামের চেয়ে সবসময় ২-৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রা থাকে। ফলে এ দু’টি শহরকে হিট আইল্যান্ড বলা হচ্ছে। তাপের সাথে আর্দ্রতাও বাংলাদেশে উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিচ্ছে। তাপ ও আর্দ্রতায় একজন শ্রমিক এক জায়গায় ৬ ঘণ্টার বেশি কাজে টিকে থাকতে পারেন না। কারণ মাঝে মধ্যে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি উঠে যাচ্ছে। গ্রীষ্মকালে দেশের কোনো কোনো এলাকায় তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। সেসব এলাকায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অথবা এর চেয়ে বেশি উঠে যায়। এ তাপমাত্রায় খোলা আকাশে তপ্ত রোদে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

জলবায়ু পরিবর্তনে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের খাবার পানিতেও লবণ ঢুকে গেছে। ফলে সেখানকার মানুষের বিশাল একটি অংশ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। পরিবেশ অধিদফতরের তথ্যানুসারে, ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র উপকূলের নদীতে লবণের মাত্রা বেড়েছে ৩-৫ পার্টস পার ট্রিলিয়ন (পিপিটি)। বিশ্বব্যাংকের আশঙ্কা, ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশে নদী ও ভূগর্ভের পানির লবণাক্ততা আরো বাড়বে। এ কারণে মানুষের স্বাস্থ্যসহ জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। বিশ্বের ১৬টি দেশ জলবায়ু পরিবর্তনে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের মানুষ চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন বলে যুক্তরাজ্যের ম্যাপলক্র্যাফটের গবেষণায় বলা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, একই কারণে বাংলাদেশে তাপমাত্রার বৃদ্ধিতে সংক্রামক ও মানসিক রোগ বাড়াচ্ছে। যেমন, ম্যালেরিয়া। বাংলাদেশ ম্যালেরিয়া নির্মূল হওয়ার পথে থাকলেও তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে তা আবার ফিরে আসবে বলে গবেষণায় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে।

রকফেলার ফাউন্ডেশনের একটি গবেষণা অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয় তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে। ২০৩০ সালে এ ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ২০০ বিলিয়ন ডলারে। ২০৫০ সালের মধ্যে দেশটিতে বছরে এখনকার চেয়ে পাঁচগুণ বেশি আর্থিক ক্ষতি হবে। গবেষকরা বলছেন, তাপমাত্রার বৃদ্ধিতে এ ক্ষতির পরিমাণ বাড়তেই থাকবে যদি না গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গতের পরিমাণ কমিয়ে আনা যায়। অথবা জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপখাওয়ানোর কৌশল রপ্ত করা না যায়। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে শুধু হ্যারিকেনের আঘাতে ৬০-৬৫ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। পেশাগত জীবনে অতিরিক্ত তাপমাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রে বছরে এক লাখ ২০ হাজার মানুষ আহত বা আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশে এ ধরনের হিসাব রয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।

Exit mobile version