Site icon The Bangladesh Chronicle

তল্পিবাহক সাংবাদিক , কল্কিবাহক সংবাদপত্র

তল্পিবাহক সাংবাদিক , কল্কিবাহক সংবাদপত্র
============================
(দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত আজকের উপ-সম্পাদকীয় কলাম )

ভালো কথা বলার লোকের অভাব নেই। অভাব শুধু সেই কথামতো কাজ করার। ঢাকায় রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সাপ্তাহিক পত্রিকা পরিষদের আলোচনা সভায় তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু তার জীবনের সবচেয়ে ভালো কথাগুলো বলেছেন। কমরেড ইনু বলেন, ‘আমরা সরকারের তল্পিবাহক দালাল সাংবাদিক চাই না। আবার জঙ্গিদের উকিলও চাই না। আমরা পোষমানা সাংবাদিক চাই না। সাংবাদিকদের কোনো পক্ষ নাই। শেখ হাসিনার সরকার গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। আমরা সমালোচনাসহিষ্ণু সরকার।’

এই চমৎকার কথাগুলো শুনে সে দিন অনেক তৃপ্তি পেয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী বিমানে চড়লেই কিছু জয় করে নিয়ে আসেন। সেই গল্প শুনতে যেসব সম্মানিত সাংবাদিক আমন্ত্রিত হন, সেখানে নিশ্চয় তল্পিবাহক সাংবাদিক খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাজেই মন্ত্রীর মুখ থেকে না শুনে যদি কোনো জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক কিংবা টিভি চ্যানেলের প্রধানের মতো কারো মুখ থেকে শোনা যেত, তবে তৃপ্তির এই মাত্রাটি আরো অনেক গুণ বেড়ে যেত।

এই কথাগুলো শুনে অনেকের ভেতর থেকেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এসেছে। মনের জটিল এই কথাগুলো তুলে ধরার জন্য একটা যুতসই বাগধারা খুঁজে পাইনি। তবে আমার দাদার মুখ থেকে শোনা একটি গল্প বাগধারার অভাব কিছুটা পূরণ করতে পারে।

এক গ্রামে এক লোক উচিত কথা বা অপ্রিয় সত্য কথা বলতেন। তজ্জন্যে তার সুনাম বা বদনাম আশপাশের গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে। একদিন তার নিজের মা আক্ষেপ করে বলেন, বাবারে, সবার মুখে তোর উচিত কথা বলা নিয়ে কত প্রশংসা শুনি। সবাইকে এই উচিত কথা শোনালেও কোনো দিন তোর এই হতভাগা মাকে শোনাসনি।

মায়ের এই আক্ষেপ শুনে ছেলে বলে, মা, তুমি আমার উচিত কথা সহ্য করতে পারবে না। মা-ও নাছোড়বান্দা। যে করেই হোক ছেলের মুখ থেকে আজ উচিত কথা শুনবেনই। ছেলে পড়েছে মহাবিপদে।

মায়ের তাগাদায় বিরক্ত হয়ে ছেলে বলে, ‘মা, আমাদের বাবা মারা গেছেন সেই কবে। তার পর থেকেই দেখে আসছি, লতু চাচা আমাদের বাড়ি এলেই তুমি কেমন যেন হয়ে যাও। তখন তোমার সাজগোজ ও খুুশির ভাবটি বেড়ে যায়।’ এটুকু শুনেই মা গালি দিয়ে বলেন, গোলামের পুত গোলাম। বন্ধ কর তোর উচিত কথা। হায় হায়! একি কুপুত্র নিজের পেটে ধরেছিলাম গো।

কথিত সমালোচনাসহিষ্ণু সরকার- এই মায়ের মতোই। এক দিকে সাংবাদিকদের সরকারের তল্পিবাহক না হয়ে সমালোচনার পরামর্শ; অন্য দিকে ‘উচিত কথা’টি একটু কড়া হয়ে যাওয়াতে একজন সম্পাদককে গোলামের পুত (বাইচান্স সম্পাদক) ডেকে সাড়ে ১৩০০ দিন লাল দালানে আটকে রাখা। অন্য একজন সৃষ্টিশীল মানুষের কী দুর্দশা হয়েছে, তা আর উল্লেখের প্রয়োজন পড়বে না। কতজনকে যে কৈফিয়ত তলব করা হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।

হাসিনা-ইনুরা তাদের সরকারকে গণতান্ত্রিক সরকার হিসেবে দাবি করতেই পারেন। এতগুলো আলেম নির্যাতন, গ্রেফতার কিংবা হতাহত করে এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বোধবিশ্বাসকে হামানদিস্তায় পিষে যদি গণতান্ত্রিক ও মুক্তবিশ্বে গণতান্ত্রিক সরকার হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়া যায়, সেটাই অবাক হওয়ার ব্যাপার। বিরোধী দলের জন্য এক ফুট স্পেস না রাখলেও সরকার শতভাগ গণতান্ত্রিক। কারণ তারা সাহিত্য-সংস্কৃতি-সঙ্গীতসহ উচ্চমার্গের কলা দিয়ে দেশের সব চটের ছালা ভরে ফেলেছেন। এখন বিমানবন্দরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গান গেয়ে বরণ করা হয়। রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানকে এই কিছিমে বরণ করার উদাহরণ বোধ হয় শুধু উত্তর কোরিয়াতেই রয়েছে। সেখানেও এভাবে বরণ করার মতো যুতসই সঙ্গীত রয়েছে এবং তা বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে গাইবার মতো শিল্পীও রয়েছেন। লাখ লাখ মানুষের একত্রে সঙ্গীত গাওয়ার ধারাও ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এখন বাকি সুপ্রিম লিডারের একখানা খোলা জিপ নিয়ে স্টেডিয়ামের ভেতরে চক্কর দেয়া এবং গ্যালারিতে বসা জনগণের হর্ষধ্বনি উপভোগ করা।

এই সরকার প্রকৃত অর্থেই গণতান্ত্রিক। কারণ যারা গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তা নিয়ে জাতিকে অহরহ জ্ঞানদান করেন সেই সুশীল নামক ব্রাহ্মণদের ম্যাজোরিটি অংশ এমন সরকারকে পছন্দ করে। গণভবন কিংবা বঙ্গভবনে দাওয়াত করে এসব বুদ্ধিজীবী কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিককে পিঠামুখ কিংবা মিষ্টিমুখ করানো হয়। পিঠামুখ করে আসা সুশীল সাংবাদিকেরা তো আর বেরসিক সাংবাদিক হবেন না। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে গেলে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করবেন না -,যে প্রশ্নগুলো আমজনতার মনে উত্থিত হয়।

আব্রাহাম লিংকন তার গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় বেশ বড় গলদ করে ফেলেছেন। গভর্নমেন্ট অব দ্যা পিপল বাই দ্যা পিপল অ্যান্ড ফর দ্যা পিপল-এর শেষে ‘অ্যান্ড টু বি এন্ডোর্সড বাই দ্যা কালচারাল এলিট অব দ্যা কান্ট্রি’ এই কথা ক’টি যোগ করা উচিত ছিল।

একসময়কার তুখোড় কমরেড এখন আলহাজে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু আগের সেই বিশ্বাসটি একেবারে ছাড়তে পারেননি। ‘দেয়ার ইজ নো গড’ বলা থামিয়ে দিলেও ‘দেয়ার উইল বি নো অপোনেন্ট পার্টি’ বলাটা থামাতে পারেননি। এই কমরেডদের ভাবনায় সব সময় দু’টি পক্ষ থাকে- হয় তাদের পক্ষ, না হয় শত্রুর পক্ষ। এই দুয়ের মাঝখানে অন্য কাউকে দেখতে পান না। ১৮০ ডিগ্রি টার্ন করে হজ করে এলেও মনের এই অংশে কোনো টার্ন (turn) বা টানা পড়েনি। আগে হুঙ্কার ছুড়তেন পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, এখন সেই হুঙ্কার ছোড়েন মৌলবাদী বা জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। জঙ্গিবাদ অনেকের রাজনৈতিক ব্যবসার অত্যন্ত লোভনীয় পণ্য হয়ে গেছে। আর পুঁজিবাদ হয়ে পড়েছে জানি দোস্ত। যতবার একা একা এমপি নির্বাচন করেন প্রাপ্ত ভোট কখনোই চার ডিজিটে উঠাতে পারেন না কেউ কেউ। তারাও এ দেশের রাজনীতিকে জঙ্গিবাদের চক্করে ফেলে আজ এমপি-মন্ত্রী হয়ে দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে গেছেন।

ছাগল দিয়ে যেমন হালচাষ করা যায় না, তেমনি কমিউনিস্ট কমরেডদের দিয়ে কখনো সত্যিকারের বাকস্বাধীনতা কিংবা গণতন্ত্রের চর্চা হয় না। অথচ গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে এবং গণতন্ত্রের কিছু দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে এরা জাতির ঘাড়ে সওয়ার হয়ে পড়েছেন।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী একদা ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘হা হা হা, এখন এই ইনুদের কাছ থেকে আমাদেরকে গণতন্ত্র শিখতে হবে?’ এই কথাটি বঙ্গভবনের এক অনুষ্ঠানে তিনি ঘরোয়া পরিবেশে উচ্চারণ করেছিলেন এবং অসাবধানতাবশত প্রধানমন্ত্রীর সেই কথাটি অন ইয়ারে প্রচার হয়ে গিয়েছিল। তার ফলে এই বামদের সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর প্রকৃত ধারণাটিও দেশবাসীর জানার পরম সৌভাগ্য হয়েছে।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যে এ জাতীয় বাম ইনুরা শুধু আওয়ামী লীগকেই গণতন্ত্র শিখাচ্ছেন না, পুরো জাতিকেই তাদের গণতন্ত্রের পাঠশালায় ভর্তি করে দিয়েছেন। সকাল বিকেল এখন এদের মুখ থেকেই গণতন্ত্র এবং বাকস্বাধীনতার সবক গিলতে হয়। রাজনীতি জগতের এই দিকপালেরা সাংবাদিকতাকে আজ কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তা ভাবলেও আফসোস করতে হয়। দেশে এতগুলো সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল থাকার পরেও কার্যত একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রশাসনসহ সব জায়গায় দুর্বৃত্তায়নের চরম নমুনা দেখা যায়। বেশির ভাগ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া কোনো-না-কোনো করপোরেট হাউজের মালিকানাধীন। তারা মূলত গণমাধ্যম না হয়ে সেই সব করপোরেট প্রতিভূর স্বার্থ রক্ষার মাধ্যম হয়ে পড়েছে এবং নিজ নিজ করপোরেট দৈত্যের কল্কি বহন করছে।

কোন কোন ভূত যেমন জলাশয়ের কাছে থেকে রাত-বিরাতে কোনো পথচারীকে একা পেলে পথ ভুলিয়ে অন্য পথে নিয়ে যায়, একইভাবে এরা নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার্থে পাঠককে বিভ্রান্ত করে, পথ ভুলিয়ে প্রায়ই অন্য পথে নিয়ে যায়। তাদের কারণেই দেশের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্ব আজ হুমকির মুখে। তাদের কারণেই গণতন্ত্র আজ নির্বাসিত। জনগণের স্বার্থে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনকে সমর্থন না জুগিয়ে স্বেচ্ছাচারতন্ত্রের প্রোপাগান্ডা যন্ত্র হয়ে পড়েছে।

গণতন্ত্রকে ঠিক জায়গায় ফিরিয়ে আনতে বিএনপির পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া তার দলের পক্ষ থেকে সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। সর্বাধিক প্রচারসংখ্যার দাবিদার একটি পত্রিকা বেগম জিয়ার বক্তৃতায় সাথে সাথেই অন্য কিছু আবিষ্কার করে বসলেন!

বেগম খালেদা জিয়া তার প্রস্তাবে কোথায়ও জামায়াতকে রাখার কথা বলেননি। নিজের দল সংসদের বাইরে থাকায় সম্ভবত স্বাধীনতার পর থেকে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কথা বলেছেন। এখানে সংসদের বাইরে থাকা নিজের দলকে রাখার গরজটিই বেশি কাজ করেছে। জামায়াতের কোনো প্রতিনিধিকেও সেই সংবাদ সম্মেলনে রাখা হয়নি। কিন্তু পত্রিকাটি দেশের অত্যন্ত বিশিষ্ট একজন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার ছাপিয়ে শিরোনাম করে বসল, বেগম জিয়ার প্রস্তাব কৌশলে জামায়াতকে রাখার অপচেষ্টা! বেগম জিয়ার কয়েক পাতার প্রস্তাব থেকে এটাই পত্রিকাটির আবিষ্কার প্রসূত শিরোনাম হয়ে পড়ল। গণতন্ত্রমনা প্রত্যেকটি মানুষ বেগম জিয়ার এই উদ্যোগটি নিয়ে যতটুকু আশান্বিত ছিলেন, পত্রিকাটি একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে সাথে নিয়ে ততটুকু ঠাণ্ডা পানি ছুড়ে দিলেন।

দেশে অনেক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি থাকলেও এই পত্রিকাগুলো পছন্দের কাউকে ‘বিশিষ্ট’ বানিয়ে ফেলেন। এ ব্যাপারে এই দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বিশেষভাবেই সচেতন। এমন মিডিয়ার বদৌলতে জাতি অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি পেয়েছে- কিন্তু হতভাগা জাতি তেমন কোনো অভিভাবক পায়নি। বিবেকের তাড়নার চেয়ে, ‘মুই কার খালু হওয়ার’ ভয়ে কিংবা সেই ধরনের তাগিদ বা বিবেচনা থেকেই এরা কথা বলেন। কিংবা পত্রিকাগুলো কৌশলে সেই ধরনের কথাই এদের মুখ থেকে বের করে এনে শিরোনাম করেন।

পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি জগতের দিকে নিরন্তর চোখ যে রাখছেন মাঝে মধ্যেই তা স্পষ্ট হয়ে পড়ে। একটি সমাজে সংবাদপ্রবাহের স্বাভাবিক গতিপথ যখন রুদ্ধ হয়ে যায়, তখন অস্বাভাবিক পথ কিংবা গুজব অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে পড়ে। নিজের হাতে সৃষ্ট এই অস্বাভাবিক পদ্ধতির শিকার হয়ে পড়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী (মিডিয়া) সদ্য প্রয়াত মাহবুবুল হক শাকিল। তার মৃত্যু সম্পর্কে যেসব সংবাদ বা গুজব ছড়িয়ে পড়েছে তা কোনোটিই তার জন্য প্রীতিকর নয়।

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, অতিরিক্ত পানের কারণে এটাকে আত্মহত্যা বলে প্রচার করতে এগিয়ে রয়েছেন সরকার ও শাকিলের ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকেরাই। রাত ৩টার সময়েও সদ্যপ্রয়াত এই কবি নাকি কিংবদন্তিতুল্য এক সাংবাদিক ও লেখককে ফোন করে জাগিয়ে তার সদ্য লেখা কবিতা শুনিয়েছেন। পারস্পরিক সম্পর্ক কতটুকু গভীর হলে কিংবা একজন কবির প্রভাব কতটুকু জোরালো হলে এই ধরনের আবদার দেশের অত্যন্ত ক্ষমতাধর সাংবাদিক ও লেখক সহ্য করেন তা সহজেই অনুমেয়। নিশীথ রাতে তিনি যখন পদ্য শুনেছেন ভিন্নমতাবলম্বী সতীর্থদের অনেকেই তখন শুনেছেন অন্য ধরনের গদ্য। এই দেশের বাকস্বাধীনতা পুরোপুরি ফিরে এলে এসব তথ্যের অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে বলে আশা করা যায়।

সরকারঘনিষ্ঠ একই করপোরেট গ্রুপের দুটি পত্রিকা আবার একজন বিবাহিত মহিলার অনৈতিক সম্পর্ককে হাইলাইট করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। নারী-স্বাধীনতার এই প্রবক্তারা একজন কর্মজীবী নারীর জীবনকে সত্যিই বিষিয়ে দিয়েছেন। উচ্চপদস্থ সেই সরকারি কর্মকর্তা গ্র্যান্ড হায়াট হোটেলে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছিলেন- পত্রিকাটি সেই সংবাদটিও পাঠকদের স্মরণ করাতে কসুর করছে না। সদ্যমৃত একজন মানুষের ক্ষেত্রে বিষয়টি নিঃসন্দেহে অবমাননাকর ও অনাকাঙ্ক্ষিত। তার পরেও পত্রিকা দুটি এই মন্দ কাজটি করছে কি আরো বড় ড্যামেজ কন্ট্রোলের নিমিত্তে?

সামাজিক মাধ্যমে শাকিলের নিজের কিছু লেখা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। নিজের একজন অতি প্রিয় মানুষের হাতে পরিকল্পিতভাবে নিহত হতে পারেন- এই ধরনের একটি আশঙ্কার কথা তার ফেসবুক পেইজে পোস্ট করে গেছেন। লেখাগুলো এখন মুছে দিলেও স্ক্রিন শট অনেকের কাছে রয়ে গেছে। আসন্ন মৃত্যুর কাছে, অত্যন্ত ক্ষমতাধর এই কবির অসহায় আত্মসমর্পণ অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। সেই প্রশ্ন খোঁজার স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ হলে গুজব আরো শক্তিশালী হয়ে পড়বে।

বাকস্বাধীনতাসম্পন্ন একটি মোটামুটি সভ্য জাতিকে বর্তমানে অর্ধসভ্য ও বাকরহিত জাতিতে পরিণত করা হয়েছে। মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার সাথে যুদ্ধরত সরকারের সঙ্গে এমবেডেড হয়ে এ দেশে যে জার্নালিজমের উদয় হয়েছে তাতে বিশেষ দফতরের বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির একটি শক্তিশালী ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা, গুম, হুমকি-ধমকি, জেল-জরিমানা যে কম্যান্ড সেন্টারটি থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো সেসবের অনেক কিছু তাদের মেমরিতে থাকা স্বাভাবিক। ‘আমার ফাঁসী চাই’-এর দ্বিতীয় পর্ব লেখার একটা হুমকি বা সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছিল বলে অনেকে সন্দেহ করছেন। ফেসবুকের এই যুগে এসব ঢেকে রাখা কঠিন বৈকি।

এই পৃথিবীর অনাচার-অবিচার একটা অলৌকিক মেকানিজমে নিয়ন্ত্রিত হয়। এই দুনিয়ায় আমরা কেউই মহান সৃষ্টিকর্তার সেই মেকানিজমের বাইরে নই। সৃষ্টিজগতের ঐকতান বা সুসমন্বয়ের স্বার্থে সর্বশক্তিমানের ধৈর্যকে আমরা তার উদাসীনতা বলে ভুল করি। কিন্তু নির্যাতিতের অভিশাপ সরাসরি তার আরশে পৌঁছে যায়।

ঐশ্বরিক জগৎ থেকে মাঝে মধ্যে সঙ্কেত বা অ্যালার্ম পাঠানো হয়। এই সঙ্কেত দেখে অন্যরা সাবধান হয়ে পড়লে সেই জনগোষ্ঠীর ওপর কালেক্টিভ পানিশমেন্ট বা গজব আপতিত হয় না। কিন্তু এই অ্যালার্মের পরেও যদি কোনো কালেক্টিভ অ্যাকশন না নেয়া হয়, তখন সেই অথর্ব ও বিপথগামী জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দেয়াকেই যথাযথ মনে করেন ঊর্ধ্ব জগতের বাসিন্দারা। বাকস্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার পক্ষের একজন নগণ্য কর্মী হিসেবে একান্ত কামনা করি, ক্ষমতাধর নায়কের করুণ পরিণতি থেকে আশা করি বাকিরা প্রয়োজনীয় শিক্ষাটি নিতে সক্ষম হবেন।

যাহোক, মরহুম শাকিলের মেয়ের কান্না যেমন আমাদের ব্যথিত করছে, একইভাবে ব্যথিত করুক সাগর-রুনির মেঘের কান্না, সমভাবে ব্যথিত করুক ইলিয়াসকন্যা সাইয়ারার বুকফাটা কান্না। একই কানে ও মনে বাজুক ব্রিগেডিয়ার আজমী, হুম্মাম ও ব্যারিস্টার আরমানের সন্তানদের বুকফাটা আর্তনাদ। মানবতা কখনোই খণ্ডিত হতে পারে না।

আসুন, মানবতার সেই পূর্ণাঙ্গ রূপটিই প্রিয় জন্মভূমিতে ফিরিয়ে আনি।

Exit mobile version