Site icon The Bangladesh Chronicle

তবুও নাকি তিনি সৎ!

তবুও নাকি তিনি সৎ! – ফাইল ছবি

যেকোনো দেশের মানুষকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়ে থাকে। যথা- উৎকৃষ্ট, নিকৃষ্ট ও বিষুবকৃষ্ট। সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ, নীতিবান ও মহৎ ব্যক্তিরা উৎকৃষ্টের পর্যায়ভুক্ত। অসৎ, দুর্নীতিগ্রস্ত, নীতিহীন, নীচ ব্যক্তিরা নিকৃষ্ট হিসেবে পরিগণিত। উৎকৃষ্ট ও নিকৃষ্টের মাঝে যাদের অবস্থান এদের বলা হয় বিষুবকৃষ্ট। এদের সততাকে বলা হয় নির্লিপ্ত সততা। এরা নিজেরা মোটামুটি সৎ হলেও অপরের সততা ও দুর্নীতির বিষয়ে নিরুদ্বেগ। এদের ধারণা, সমাজে দুর্নীতিবাজ ও অসৎদের শক্ত অবস্থান। তাই এদের দুর্নীতিতে বাধা হয়ে দাঁড়ালে না জানি নিজের জীবনে বিপত্তি নেমে আসে অথবা পদই খোয়া যায় এ আশঙ্কায় এরা সচরাচর দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকে।

উৎকৃষ্ট ব্যক্তিরা শত বাধা ও প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজের নৈতিক মান অক্ষুণ্ণ রেখে সততার ব্যাপারে অনড় ও আপসহীন থাকেন। বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বর্তমান সমাজে এ ধরনের ব্যক্তির সংখ্যার দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। নিকৃষ্ট ব্যক্তিরা নিজের দুর্নীতিলব্ধ অর্থ-সম্পদ ভোগ করার বিষয়ে যেন কখনো কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন না হন সে কথা ভেবে সবসময় আশঙ্কাগ্রস্ত থাকেন ও এ বাস্তবতায় তারা সবসময় অপরকে দুর্নীতিতে সহায়তা করে থাকেন। তাদের বদ্ধমূল ধারণা, সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়লে তাদের দুর্নীতির বিষয়ে আর কেউ কথা বলবে না। এ ধরনের ব্যক্তির সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কিন্তু বাস্তবে কি নিকৃষ্ট ব্যক্তিরা দুর্নীতির বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ থেকে সমাজের বিবেকবান, সচেতন ও সৎ ব্যক্তিদের নিবৃত্ত করতে পারছে? পারছে না বলেই তো প্রায়ই চাঞ্চল্যকর, অভিনব ও অবিশ্বাস্য দুর্নীতির নিত্যনতুন ঘটনার প্রকাশ পাচ্ছে এবং আমরা সাহসী সাংবাদিক ও কলামিস্টদের বদৌলতে তা জানতে পারছি।

যেকোনো দেশের নির্বাহী প্রধানের চার পাশে যত বেশি সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ, নীতিবান ব্যক্তির অবস্থান নিশ্চিত করা যাবে তার সফলতার হারও সার্বিকভাবে সেভাবে ঊর্ধ্বমুখী থাকবে। আর যখন শীর্ষ নির্বাহী অসৎ, দুর্নীতিগ্রস্ত ও নীতিহীনদের দিয়ে পরিবেষ্টিত থাকবেন তখন এর বিপরীত চিত্রটিই পরিলক্ষিত হবে। শেষোক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা শীর্ষ নির্বাহীর চার পাশে এমন বলয় তৈরি করে রাখেন যা ভেদ করে সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ ও নীতিবানদের তার সান্নিধ্যে আসা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এসব ব্যক্তি পদে থাকাকালীন তাদের ক্ষমতার দাপটে অযথা হয়রানি হওয়ার ভয়ে কেউ এদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস করেন না। এরা সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ, নীতিবান ও দক্ষদের অপছন্দের মূল কারণ তারা শীর্ষ নির্বাহীর সান্নিধ্যে এলে এদের সততা ও দক্ষতা ম্লান হয়ে যাবে।

আমাদের শীর্ষ নির্বাহীর কার্যালয় থেকে বিদায় নেয়া প্রশাসন ক্যাডারের জনৈক প্রভাবশালী কর্মকর্তাকে তার সহজ সরল জীবন যাপনের জন্য আমার মতো অনেকেই সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ ও নীতিবান হিসেবে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। যে দিন ওই কর্মকর্তার শীর্ষ নির্বাহীর কার্যালয় থেকে অন্যত্র বদলির আদেশ বের হয় সে রাতে জনৈক প্রভাবশালীর ভাগ্নির বিয়ের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে তাকে সস্ত্রীক নাতনীসহ দেখতে পেলাম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত অভ্যাগত ও আয়োজকরা তখনো বদলির বিষয়ে অবহিত ছিলেন না। যেহেতু ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুর গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা তাই তার সস্ত্রীক উপস্থিতি অনুষ্ঠানের যে ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করেছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই। আয়োজক ও অভ্যাগতদের অনেকে তার সান্নিধ্যে ধন্য হয়েছিলেন আর ক্ষমতাধর হিসেবে তার দিকে সবার বিশেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। খাবার টেবিলে তাকে বেশ চিন্তামগ্ন ও মলিন দেখাচ্ছিল। খাবার টেবিলে আলাপচারিতার একপর্যায়ে তিনি নিজেই তার বদলির বিষয়টি জানালেন এবং এও বললেন যে, দুর্নীতিবাজরা তার পিছে লাগায় তিনিও আর এ পদে থাকতে চাচ্ছেন না। তবে এ পদে অন্য কারো পদায়ন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত হয়তো তাকে অবমুক্ত করা হবে না। খাবার টেবিলে দু’জন সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন যারা শীর্ষ নির্বাহীর কার্যালয়ের সাথে সংযুক্ত। দেখা গেল, তারা অনেক আগাম তথ্য জানেন ও তারাই বললেন কাকে তার পদে দেয়া হচ্ছে এবং তিনি তার যোগদানের আগেই অবমুক্ত হতে পারবেন। দুর্নীতিবাজ কারা তার পেছনে লেগেছে, এ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হলে তিনি জানালেন- মূলত তার ক্যাডারেরই কিছু ক্ষমতাধর কর্মকর্তা ও অপরাপর কিছু ব্যক্তি যারা তার কারণে দুর্নীতিতে সফলতা পাচ্ছেন না।

ওই কর্মকর্তার শীর্ষ নির্বাহীর কার্যালয় থেকে বিদায়ের তিন মাস অতিক্রান্ত হওয়ার কিছু দিন পর চার টাকা মূল্যমানের একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের প্রথম পাতায় লাল হরফের শিরোনামে প্রকাশিত সেই সৎ কর্মকর্তার আকাশছোঁয়া ভবন সংক্রান্ত চাঞ্চল্যকর ও অবিশ্বাস্য সংবাদটির বিষয়ে প্রথম জানতে পারি পত্রিকাটিতে সংবাদটি প্রকাশিত হওয়ার পরদিন। ওই তারিখে আমার জনৈক সহকর্মী আমার বাসায় এসে আমাকে না পেয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। আমি বাসায় ঢোকার পর দেখতে পাই, আমার ওই সহকর্মী খুব মনোযোগ সহকারে একটি পত্রিকা পড়ছেন। পত্রিকা পাঠে তিনি এতই মনোযোগী ছিলেন যে, আমার কক্ষে প্রবেশ তিনি খেয়াল করতে পারেননি। এত মনোযোগ দিয়ে কী পড়ছে জিজ্ঞেস করা হলে সহকর্মী পত্রিকার একটি সংবাদের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে সে দিনের চার টাকা মূল্যমানের পত্রিকায় ওই সৎ কর্মকর্তার বিষয়ে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনির লিখিত নিবন্ধটি পড়তে বলল।
পটুয়াখালী-৩, দশমিনা-গলাচিপা আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে আমার অনুজ। তাকে অনুজ হিসেবে এমনিতে আগে থেকেই পছন্দ করতাম। আর সে পছন্দের মাত্রা বর্তমানে তার নির্ভীকতা, সাহসিকতা, বস্তুনিষ্ঠতা, ন্যায়পরায়ণতা ও স্পষ্টবাদিতার কারণে অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।

অতি সম্প্রতি দেখা গেছে, যেকোনো অনুষ্ঠানে পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ ও টকশো সংশ্লেষে গোলাম মাওলা রনির প্রসঙ্গ এলে তার নামটি সবার কাছে একান্ত পছন্দনীয় ও আস্থাভাজন হিসেবে আলোচিত হয়। সহকর্মী আলাপকালীন আগে ও সে দিন সৎ কর্মকর্তা বিষয়ে যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে সংক্ষেপে তার বর্ণনা দিয়ে বিদায়ের সময় পত্রিকাটি আমাকে দিয়ে গেল। পত্রিকাটিতে প্রতিভাবান সংসদ সদস্যের লেখা নিবন্ধটি পড়ে আগের দিনের নিবন্ধটি পড়ার জন্য আগ্রহান্বিত হলাম। যেহেতু এক দিন আগের পত্রিকা তাই পত্রিকাটির কাগুজে সংস্করণ জোগাড় করা সময়সাপেক্ষ বিধায় ইন্টারনেটের বদৌলতে পত্রিকাটির ইন্টারনেট সংস্করণ থেকে ওই কর্মকর্তা-সংক্রান্ত সংবাদটি পড়লাম।

উভয় দিনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত নিবন্ধ দু’টি পড়ে যা জানা গেল তা হচ্ছে- ২০০৩ সালে জোট সরকারের আমলে ওই সৎ কর্মকর্তা উত্তরা আবাসিক এলাকার ১৭-ডি সেক্টরের ৩ নং সড়কের তিন কাঠাবিশিষ্ট ৩২ নং প্লটের বরাদ্দ পেয়েছিলেন ও বরাদ্দপ্রাপ্তির পর দু’টি কিস্তিও পরিশোধ করেছিলেন। ২০০৯ সালে সরকারের শীর্ষ নির্বাহীর একান্ত সচিব নিয়োগ পরবর্তী তিন কাঠার আবাসিক প্লটের পরিবর্তে ১১ নং সেক্টরের ১০০ ফুট প্রশস্ত সোনারগাঁও জনপথ সড়কের পাঁচ কাঠা প্লটের জন্য আবেদন করেন। তার আবেদন মোতাবেক এ সড়কের ৩৪ নং প্লটটি তাকে বরাদ্দ দেয়া হয় এবং তাকে বরাদ্দ দেয়ার আগে এ প্লটটিসহ ওই সড়কের আরো ১০টি প্লটকে বাণিজ্যিক প্লট থেকে আবাসিক প্লটে রূপান্তর করা হয়। পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, সরকারের শীর্ষ নির্বাহীর কার্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্বে থাকার সুবাদে তিন বছরের মধ্যে আবাসিক প্লটটির উপর ১০ তলাবিশিষ্ট একটি সুরম্য অত্যাধুনিক বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করেন যার সম্মুখভাগ রঙিন কাচ দিয়ে আবৃত।

সংবাদসূত্রে প্রকাশ- ১০ তলা ভবনটির তিনটি তলা তিনি জনৈক মহিলার কাছে বিক্রি করেছেন এবং ওই তিনটি তলাসহ সম্পূর্ণ ভবনটি দেশের স্বনামধন্য একটি প্রথম সারির আসবাবপত্র প্রস্তুতকারী কোম্পানির কাছে ভাড়া দিয়েছেন।

পত্রিকায় সংবাদটির সাথে ভবনটির ছবিও ছাপা হয়। ছবি দৃষ্টে স্বাভাবিক বুদ্ধিজ্ঞানসম্পন্ন যেকোনো মানুষের পক্ষে অনুমান করা সম্ভব এ ধরনের ভবন নির্মাণে কী বিপুল অর্থ ব্যয় হতে পারে এবং ওই সৎ কর্মকর্তার পদবির সারা জীবনের উপার্জন দিয়ে এ ধরনের ভবনের ভিত নির্মাণ যে সম্ভব নয় তা বোধকরি সরকারের বিভিন্ন পদধারী কারো অজানা থাকার কথা নয়। বাণিজ্যিক প্লটকে আবাসিক প্লটে রূপান্তরের পর সেখানে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ দেশের প্রচলিত আইন ও নীতি নৈতিকতায় সমর্থন করে কি না তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। আর যদি সমর্থন না করে তাহলে এখানে যে গুরুতর অন্যায় হয়েছে তা ভেবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আইনানুগ পদক্ষেপ নিলে ন্যায়পরতা সমুন্নত হবে। সে দিনের সংবাদে ওই সৎ কর্মকর্তার ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট থাকার বিষয়েও ধারণা দেয়া হয়।

সহকর্মীর দিয়ে যাওয়া পত্রিকাটির কাগুজে সংস্করণে লিখিত সংসদ সদস্যের নিবন্ধ থেকে জানা যায়, ওই সৎ কর্মকর্তার ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় একটি ফ্ল্যাট ছাড়াও বাংলাদেশের একমাত্র সামুদ্রিক দ্বীপ সুদূর সেন্টমার্টিনে বেশ কিছু ভূ-সম্পত্তি রয়েছে।

আমার ধারণা ছিল, নিবন্ধ দু’টি প্রকাশিত হওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যে হয়তো কথিত সৎ কর্মকর্তার পক্ষ থেকে প্রতিবাদলিপি দেয়া হবে। কিন্তু সংবাদ দু’টি প্রকাশের দীর্ঘ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরও প্রতিবাদলিপি না আসায় সংবাদ দু’টির বস্তুনিষ্ঠতা সুসংহত হয়।

পত্রিকায় নিবন্ধ লিখা ও টকশোতে অংশগ্রহণের কারণে নিজের অজান্তেই পরিচিতির যে কিছুটা বিস্তৃতি ঘটেছে তা রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে গেলে টের পাই। অনেকসময় পরিচিত-অপরিচিত বিভিন্ন ব্যক্তি থেকে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে নিবন্ধ লেখার জন্য অনুরোধ আসে। তা ছাড়া দীর্ঘ দিন সরকারি চাকরি করার সুবাদে নিজ বিভাগ ছাড়াও অন্যান্য বিভাগের বেশ কিছু কর্মকর্তার সাথে সখ্য গড়ে উঠেছে। এ সখ্যতার কারণে উল্লিখিত সৎ কর্মকর্তা বিষয়ে নিবন্ধ দু’টি প্রকাশিত হওয়ার পর তার ক্যাডারের কিছু কর্মকর্তার সাথে দেখা হলে তারা নিবন্ধ দু’টিতে ওই কর্মকর্তার প্রকাশিত সম্পদের বহির্ভূত আরো কিছু সম্পদের তথ্য দেন এবং বিশেষভাবে অনুরোধ করেন- একজন সৎ কর্মকর্তা যদি এমন বিপুল সম্পদের মালিক হন তাহলে একজন অসৎ কর্মকর্তা কী পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে পারেন সে বিষয়টি তুলে ধরে যেন নিবন্ধ লিখি। ভিন্ন বিভাগের বন্ধুবৎসল কর্মকর্তাদের অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়ে ক্ষুদ্র অথচ তথ্যনির্ভর এ নিবন্ধটি লেখার প্রয়াস ও লেখা শেষ করতে গিয়ে এ কথাটিই বারবার মনে জাগে- নিজ পদমর্যাদাকে অবলম্বন করে কেন সম্পদের পিছে ছোটাছুটি আর কেনই বা নিজেকে চালাক ভেবে সবাইকে বোকা বানিয়ে সম্পদের পাহাড় সৃষ্টির এ অভিনব প্রচেষ্টা? আর তাই তো নিজ দাবিতে এত কিছুর পরও তিনি নাকি সৎ!

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com

Exit mobile version